আতাউল হক সিদ্দিকীর সনেট সমগ্র
রাগীব হাসান
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:২০ এএম
আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৩১ এএম
বর্তমান সময়ের কবিদের সনেট লেখায় খুব এটা প্রবৃত্ত হতে দেখা যায় না। সনেট প্রকাশ হতেও খুব একটা দেখা যায় না। বাংলা ভাষার অনেক প্রথিতযশা কবি প্রচুর সনেট লিখেছেন, যা কবি যশঃপ্রার্থীদের প্রলুব্ধ করে। দশকে দশকে প্রচুর কবিতা লেখা হয়। সনেট লেখা কি বাদ যায়? তেমনটাও ঘটে না। পাঠক হিসেবে আমার নিজের যেটা মনে হয়, সনেট পড়ে যে বিস্ময় জাগে এ বিস্ময় ভালো লাগা থেকে বারবার সনেট কাছে টানে। সনেটের ওই যে দুর্বিনীত টান, তা সহজে এড়ানো যায় না।
ফিরে আসি আতাউল হক সিদ্দিকীর সনেট সমগ্র প্রসঙ্গে। বইটি হাতে পেয়ে চমকে উঠেছি, একটার পর একটা সনেট পড়তে গিয়ে ঘোরের মধ্যে পড়তে হয়েছে। তবে এটা সত্য, সনেট সমগ্রের গহিনে ঢুকতে হলে আয়োজন করে পড়তে হবে। হাতে সময় নিয়ে পড়তে হবে। সনেটপাঠের অভিজ্ঞতায় হৃদয়ের আর্তি জেগে ওঠে। বিস্ময় শুধু নয়, মোহাবিষ্ট করেও রাখে সনেট। আমার ধারণা, এ সনেট সমগ্রটি বাংলা কবিতায় চিরস্থায়ী আসন করে নেবে।
আতাউল হক সিদ্দিকী ঢাকার কবিসমাজের বাইরে থেকে উত্তরবঙ্গের জলহাওয়ায় বিচরণ করেছেন। কবিতা লেখা ও কর্মে নিবিষ্ট থেকেছেন। তার কবিতাযাত্রা সম্বন্ধে জানা যায়, কলেজ ম্যাগাজিনে ১৯৬৮-তে তার একটি কবিতা প্রকাশ হয়। এরপর ধীরে ধীরে কবিতার পানে ছুটেছেন। দীর্ঘ সময়জুড়ে কবিতার সুবাস ও সৌন্দর্য তাকে কবিতা লেখায় সক্রিয় রেখেছে। এতে ছেদ পড়েছে বলে মনে হয় না। তার কবিতা ও সনেট রচনার সংখ্যা নেহাত কম নয়। ২৩৮ পৃষ্ঠার সনেট সমগ্র, এক সোনালি শস্যের গোলাঘর। এতে কতটা চিটা আছে, বিদগ্ধ সমালোচকরাই বলতে পারবেন। তবে আমার ধারণা, প্রতিটি সনেটের সৌরভে মাতোয়ারা হয়ে উঠবেন পাঠক।
আতাউল হক সিদ্দিকী একজন শিক্ষাবিদ। একজন শিক্ষাবিদ হওয়ার কারণে তার মধ্যে পাণ্ডিত্য ও বুদ্ধিদীপ্তির প্রখর ঝলকানি থাকাই স্বাভাবিক। এতে তার কবিতার কি কোনো ক্ষতি হয়েছে? সে বিচার করার যোগ্য আমি নই। তবে তিনি উত্তরবঙ্গের জলহাওয়ায় পুষ্ট। উত্তরবঙ্গ জনপদ সম্বন্ধে নানা কিংবদন্তি প্রচারিত আছে। নানা বচন ঘুরে বেড়ায় এ জনপদের হাওয়াবাতাসে। তিনি এখানকারই সন্তান। অনেক বিখ্যাত লেখকের জন্ম এখানে। তাদের স্মরণে রেখে আতাউল হক সিদ্দিকী তার নিজস্ব পথ তৈরি করেছেন। তার সম্পর্কে বিশদ জানতে না পারলেও কিছুটা জানার সুযোগ হয়েছে। উত্তর জনপদের পথে ঘাটে, শহরে নগরে, হাটে বাজারের মানুষের সঙ্গে মিশে তিনি হয়ে উঠেছেন তারকাখচিত। তা বুঝতে আমাদের হয়তো আরও সময় লাগবে। তবে এটুকু বলা যায়, এ ‘সনেট সমগ্র’র পাঠ অভিজ্ঞতা পাঠককে বরেন্দ্রভূমি ভ্রমণের স্বাদ দেবে। কেননা, কবি নির্মোহভাবে অস্তিত্বের উৎস সন্ধানে হেঁটেছেন শব্দশস্যের ভেতর দিয়ে।
আতাউল হক সিদ্দিকীর ছয়টি সনেটগ্রন্থ থেকে সনেট সমগ্রে ঠাঁই পেয়েছে ২১১টি সনেট। প্রতিটি সনেটের শেষে কবি যেখানে বসে এটি লিখেছেন, সেই স্থানের নাম জুড়ে দেওয়া আছে। সনেটটির লেখার তারিখও সংযুক্ত। দেখা যাচ্ছে, প্রায় সব কটি সনেটই নওগাঁয় বসে লেখা। উত্তর জনপদের এ অঞ্চলের প্রতিটি অণুকণা কবিকে কবিতা লেখায় উদ্ভাসিত করেছে। এ থেকে এক একটি মহাপৃথিবী গড়ে তুলেছেন তিনি।
আমার নক্ষত্র তুমি। যদি আমি চলি নিরুদ্দেশেÑ‘কালের কপোলে এসো দুজনে চিহ্ন এঁকে দিই/কুসুমে কুসুমে’ বলে পথে এসে দাঁড়িয়েছ হেসে/জনপদমোহ নিয়ে; তারপরে ঠিকানা তুমিই।’ (আমার নক্ষত্র তুমি)
জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা যারা পাঠ করেছেন, তারা কতটা মানবেন জানি না। এ বইয়ের প্রতিটি অনুষঙ্গ জীবনানন্দ দাশের চেনা জগৎ থেকেই আহরিত। আর তা তার ফেলে যাওয়া বরিশাল অঞ্চল। চেনা জিনিস হলেই তাকে শিল্পমণ্ডিত করে তোলা যাবে তার কোনো মানে নেই। এখানে কবির নিজস্ব দক্ষতার বিষয়টি জড়িত। যেমন ধরা যাক, কলকাতার ৭০-এর কবি মৃদুল দাশগুপ্তের প্রথম কবিতার বই ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’-এর শেষ দিকে বেশ কটি সনেট আছে। পরবর্তী সময়ে এ কবি সনেট লেখার দিকে ঝোঁকেননি। জলপাই কাঠের এসরাজের ওই কটি সনেট বারবার পড়েও স্বাদ মেটে না। মাঝে মাঝে মনে হয় মৃদুল দাশগুপ্ত আরও কেন সনেট লিখলেন না!
দশক বিভাজনের মধ্য দিয়ে একটি কালপর্ব ধরার চেষ্টাও থাকে বলে অনেকে মনে করেন। দশকে দশকে যে কবির আগমন হয়, তার মধ্য থেকে পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠার শিরোপা অর্জন করে নেন কেউ কেউ, অনেকে ঝরে যান। কবি নগরে না থেকে নগরের বাইরে থাকলে কি তার কবিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়? এ নিয়ে বাৎচিত করেন অনেকে। ফ্রান্সের একজন কবি আকাশ ও পৃথিবীর মাঝামাঝি স্থানকেই তার কবিতার বিষয় করে নিয়েছেন। কবির অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, তা কি খুব গুরুত্ব বহন করে? হয়তো করে আবার না-ও করতে পারে।
ভালোবেসে এ-দেশে সে কত পায় সুখ,/অন্ধকারে সূর্য জ্বেলে প্রাণের ভিতরে/
বলে কেন, স্বদেশের ভীষণ অসুখÑকিছুই জানো না তুমি; অনন্য প্রহরে/ (কিছুই জানো না তুমি)
স্বদেশে কত কী ঘটে। কবি বেশি সংবেদনশীল বলে সামান্যতে তিনি বিচলিত। আকাশের তারকারাজি যেমন কালো মেঘে ঢেকে যায়। কবির মুখও ম্লান হয়। কবিতায়, সনেটে তার ছাপ নেই তা বলা যাবে না। আতাউল হক সিদ্দিকীর সনেটের ঐশ্বর্য বাংলা কবিতা আরও সংহত করবে, শীর্ষে নিয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।