× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শীতের উজ্জীবনী শক্তি

রফিকুন নবী

প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১৪:৩৫ পিএম

চিত্রকর্ম : হাসুরা আকতার রুমকি

চিত্রকর্ম : হাসুরা আকতার রুমকি

শীতে কুয়াশার চাদরে মোড়ানো থাকে চারদিক। অসাধারণ এক দৃশ্যপট তৈরি হয়। যদিও কুয়াশা আমাদের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু শিল্পীর দৃষ্টিতে দেখলে কুয়াশা আমার কাছে ভালোই লাগে। কাছের জিনিস আবছা দেখায়। এটা আঁকাও খুব কঠিন।

শীত নামলে কুয়াশা দেখার স্মৃতি ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। মনে আছে ১৯৬৫ সালের কথা। চতুর্থ বর্ষে পড়ি। শীতের সময় আমাদের চারুকলার শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হলো কক্সবাজারের উখিয়ায়। এ উখিয়া এখন নানানভাবে বিখ্যাত। কিন্তু সে সময় ওই জায়গাটি ছিল বেশ দুর্গম এলাকা। যাওয়াটা সহজ ছিল না। সেখানে অনেক হাতির আনাগোনা ছিল। অনেক খেদা ছিল। খেদা হলো হাতি ধরার এক ধরনের ফাঁদ। বিশাল এলাকাজুড়ে হাতির জেলখানার মতো ছিল। সেখানে হাতিদের পোষ মানানো হতো। এমন একটা প্রকৃতিমগ্ন জায়গায় চারুকলার স্যারেরা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন কুয়াশা দেখাতে। আমার শিক্ষক খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী আনোয়ারুল হক সঙ্গে ছিলেন। স্যার বললেন, সন্ধ্যায় যে ঘন কুয়াশা দেখলাম তার ছবি জলরঙে আঁকতে হবে। আমরা ছবি আঁকতে শুরু করলাম। সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না। হ্যারিকেন আর মোমবাতি জ্বালিয়ে ছবি আঁকলাম। আমরা প্রত্যেকে ১৫-১৬টি করে ছবি এঁকেছিলাম। সেই যে কুয়াশার ছবি এঁকেছিলাম, স্যারেরা শেখালেন কেমন করে কুয়াশা আঁকতে হয়। একদম হুবহু হবে না। তবে রসটুকু থাকলেই হলো। সেই যে মাথায় ঢুকল, সেই যে স্মৃতি এবং শিক্ষা, এখনও কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতি দেখলে তখনকার দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

আবহাওয়াগত যেকোনো পরিবর্তন ভালোই লাগে। আমাদের ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির রূপও পাল্টে যায়। এ বদলটা মানুষের একঘেয়েমি দূর করে। বৃষ্টি আমার কাছে ভালো লাগে। এমনকি ঝড়ও ভালো লাগে। নিজেই ভাবি এগুলো তো ভালো লাগার কথা না। তাৎক্ষণিক ভালো লাগে। শুধু আমার একার যে লাগে তা কিন্তু নয়। বাংলা কবিতায়, ছবিতে, সংগীতে ঝড়বাদল আছে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনেরই কবিতায় যেমন ঝড় আছে, তেমন শীত ও কুয়াশার বর্ণনাও রয়েছে।

এত কিছুর মধ্যে শীতের সময় গ্রামে-গঞ্জে সংগীতের আসর বসে। পল্লীগান হয়। আমার জন্মজেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে গম্ভীরা, আলকাপ গানের আসর বসে। এগুলো আমি ছোটবেলায় দেখেছি

কুয়াশা এমন একটা জিনিস। এ শব্দটির মধ্যে রহস্যময় একটা ব্যাপারস্যাপার লুক্কায়িত থাকে। যেমন বলে, এ এক কুয়াশাচ্ছন্ন জীবন। আমাদের সাহিত্যে কুয়াশা ব্যাপক জায়গা দখল করে আছে। শীত ভালো না লাগার কোনো কারণ নেই। আমাদের বাঙালিদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে। সেটা হলো, আমরা সব ঋতুর মধ্যেই আনন্দের কিছু কিছু জিনিস খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। এর জাতিগত অথবা অবস্থানগত কারণও থাকতে পারে। আমরা প্রকৃতির পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে ভালো লাগার অনুষঙ্গটি বেছে নিই। তবে আমাদের যতগুলো ঋতু আছে তার মধ্যে শীত হলো ভোগান্তির। তার মধ্যে থেকেও মানুষ ঠিকই কিন্তু জীবনের একটা রসালো সময় পার করার চেষ্টা করে। প্রাণের সঞ্চার ঘটায়।

যদিও ইউরোপ-আমেরিকার মতো শীত আমাদের দেশে নামে না। বরফও পড়ে না। তবু আমরা তো গরিব দেশের নাগরিক। শীতে অভাব-অনটনে থাকা মানুষের অনেক কষ্ট হয়। তাদের কাছে শীতবস্ত্র থাকে না। চূড়ান্ত ভোগান্তি পোহাতে হয়। কখনও অবধারিত মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটে যায় শীতের প্রকোপে। এত কষ্টের মধ্যেও মানুষ আনন্দ খুঁজে পায়। আনন্দের ব্যাপার হলো, খেজুরের রস হবে। তা দিয়ে গুড় হবে। রবিশস্যের মাঠজুড়ে নানান জাতের সবজির প্রাচুর্য থাকে। এত কিছুর মধ্যে শীতের সময় গ্রামে-গঞ্জে সংগীতের আসর বসে। পল্লীগান হয়। আমার জন্মজেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে গম্ভীরা, আলকাপ গানের আসর বসে। এগুলো আমি ছোটবেলায় দেখেছি। এগুলো সাধারণত শীতের সময় হতো। কারণ শীতের সময় একসঙ্গে বসে আগুন পোহাবার মতো ব্যাপার আছে। আগুন পোহানো হয়। আবার ছোলা, আলু পুড়িয়ে খাওয়াও হয়। তাই আমার মনে হয়, শীত মানুষের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয়। এ সময় সংস্কৃতির একটা সংযোগ ঘটে। এ বিষয়টি একটু ভাবলেই অনুভব করতে পারা যাবে। হয়তো অত গভীরভাবে আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখি না। গানের আসরের পাশে আগুন পোহানো।

মাঠের কাজ বলি আর ঘাটের কাজ বলি, অন্য সময়ের চেয়ে শীতের দিনে বেশি হয়। বলা যায় শীত অনেকটা শ্রমসাধ্য ঋতু। আমি নিজেই গ্রীষ্মের চেয়ে শীতে বেশি ছবি আঁকতে পারি। বেশি মনোযোগ দিতে পারি। গ্রীষ্মে গরমে শরীরে অতিষ্ঠ ভাব থাকে। এমনকি সব ধরনের সৃজনশীল কাজই এ সময়ে ভালো করা যায়। আমাদের বরেন্দ্র জনপদে একসময় মাটির ঘরের চল ছিল। এখন তো গ্রামেও ইটের দালান উঠেছে। আগে ঘরামিরা মাটির ঘর তুলতেন ধাপে ধাপে। এ কাজটি সাধারণত শীতকালেই করা হতো। শীতের সময় শ্রমসাধ্য কাজগুলো করা হয়।

শীতের সময় তৈরি হয় নানা রকম মজাদার পিঠা। এগুলোর আবার বাহারি নাম। আঞ্চলিক পিঠাও রয়েছে। জিনিস হয়তো একই। পিঠা তৈরির উপকরণও প্রায় অভিন্ন। সামান্য হেরফের থাকতে পারে। তবে নারীরা সে পিঠাগুলোতে আলাদা একটি শৈল্পিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। নামের বৈসাদৃশ্য হয়ে যায় একেক জেলায়। বাঙালি নারীদের এ পিঠা তৈরির রীতি এবং নৈপুণ্যও একটা শিল্পকর্ম। উত্তরবঙ্গে একরকম পিঠা। পূর্বাঞ্চলে এক ধরনের পিঠা। বাঙালির জীবনে শীত নামে সৃজন চর্চার মৌসুম হিসেবে। যতগুলো ঋতু আছে তার মধ্যে আমার শ্রেষ্ঠতম মনে হয় শীতকাল। এ সময়ে গ্রামীণ মেলা বসে। আমাদের লোকসংস্কৃতির অনেক রকম কার্যক্রম দেখা যায়। যা অন্য ঋতুতে হয় না। যা গ্রীষ্মে সম্ভব হয় না।

নকশিকাঁথার শিল্পীদের কথা বলি। কাঁথাও কিন্তু একটি শীতকেন্দ্রিক ব্যাপার। যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ময়ময়নসিংহ, জামালপুরসহ দেশের অন্যান্য জেলায়ও কমবেশি নকশিকাঁথার বুনন হয়। প্রতিটি এলাকার এ লোকশিল্পীদের কাজগুলোর মধ্যে নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমাদের মা-বোনেরা নকশিকাঁথায় তুলে ধরেন নানান মোটিফ। লোকশিল্পের বিশাল অংশজুড়ে আছে নকশিকাঁথা। কাঁথায় তারা যে বিষয়গুলো আঁকেন সেগুলোও আমাদের সংস্কৃতির অংশ। মানে একটি লোকশিল্পের মধ্যে অন্য লোকশিল্প তুলে আনা। কাজেই শীত বাঙালির কাছে সৌন্দর্যের ঋতু। সৃজনসম্ভারে ভরে তোলার মৌসুম।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা