রেজাউদ্দিন স্টালিন
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১৪:২৭ পিএম
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা কবিতার লাইন : ‘নিইনি কি খেজুর রসের ঘ্রাণ?’ যতবারই এ লাইনটি পাঠ করি ততবার মনের অজান্তেই বলে ফেলিÑ হ্যাঁ, অবশ্যই নিয়েছি। এখনও স্মৃতির ঘ্রাণেন্দ্রিয় সেই সৌরভ রোমন্থন করে। আমি জন্মেছি গ্রামে। বলতে গেলে শহর থেকে ৫ ক্রোশ দূরে নলভাঙায়। বৃহত্তর যশোরে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের স্মৃতির মধ্যে শীত আর কুয়াশার রংধনু ওঠে। পথের ধুলোর ওপর গোধূলির লাল আভা। কৃষক কাঁধে নিয়ে যাচ্ছে মাটির ভাঁড়। খেজুর গাছ কাটবে সে ভাঁড় পাতবে। পিঠে তার গাছিদা। গোধূলিবেলায় কাটা শেষ হবে খেজুর গাছ। ভাঁড়ের মধ্যে শিশিরের ফোঁটার অনুরণনে টপটপ করে পড়বে রস। মাঠের মাঝখানে। জমির আইলের কোনায় খেজুর গাছ। আর হলুদ ফুলের আগুনে পুড়ে যাওয়া দৃষ্টি। মৌমাছির গুঞ্জন। শীতের মিঠে রোদে শুয়ে আছে শালিক পাখি। নীলাকাশ চিরে উড়ে যাচ্ছে বাদুড়ের ঝাঁক। সেই স্বর্গীয় স্মৃতি আমার চিত্তাকাশে জাগরূক। যতবার শীত নামে সেই কৈশোরের স্মৃতি আমার হৃদয়ে প্রতিধ্বনি তোলে। ইংরেজ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস বলেছিলেন, ‘যে কবির আনন্দময় শৈশব নেই, সে কবি হিসেবে অসফল।’ আমার খুব ভালো লাগে এ আনন্দময় শৈশব আবাহন করতে। মনে পড়ে ১৯৭১ সালের শীতকাল। আমরা সপরিবার পালাচ্ছি যশোর শহর থেকে গ্রামে মামাবাড়ির দিকে। প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার পথ। ডিসেম্বরের শীত। গ্রামে পাকিস্তান আর্মিরা যাতে ঢুকতে না পারে এজন্য রাস্তার চৌমাথায় বসেছে মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের পাহারা। মুক্তিবাহিনীর মুখ চাদরে ঢাকা। কাঁধে স্টেনগান।
হাত উঁচু করে আমাদের থামতে বললেন। তোমরা কারা? আমি বললাম, রেজাউদ্দিন স্টালিন। নলভাঙা থাকি। কার ছেলে? বোরহান উদ্দিন আহমেদের ছেলে। তোমার নামটা কে রেখেছে? জানতে চাইলেন এক মুক্তিযোদ্ধা। আমার বাবা-মা। বাঃ যাও। পথে কি রাজাকার-আলবদর দেখেছ? না, দেখিনি। তবে হাজার হাজার শরণার্থী দেখেছি। অনেকে অসুস্থ। বৃদ্ধ বাবা-মাকে কাঁধে নিয়ে তারা এদিক আসছে। মনে হচ্ছে তারা ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। হ্যাঁ, একজন কমান্ডার গোছের লোক বললেন, ওদের নিরাপত্তা দিতে হবে। স্টালিন শোনো, তুমি শরণার্থীরা এলে ওদের মথনপুর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। কেউ যদি উৎপাত করে এসে আমাদের খবর দিও। কথা বলার মধ্যে এসে হাজির হলেন ভিকু মামা। মুক্তিযোদ্ধাদের লিডার। আমাকে দেখে বললেন, তুই এখানে? বললাম বারোবাজার গিয়েছিলাম। আচ্ছা, কাল আমরা দশজন মুক্তিযোদ্ধা দুপুরে খাব। কারও বাসায় খাওয়া ঠিক করবি। আমি বললাম, মুসলিম লীগের শুকো ওস্তাগারের বাসায় ঠিক করব। ভিকু মামা হেসে বললেন, ঠিক আছে যাও। মামার হাতে ছোট্ট রেডিও। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ভেসে আসছে গানÑ ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি শিশুর হাসির জন্য অস্ত্র ধরি’। গানটি এর আগেও শুনেছি। কিন্তু ভিকু মামা মুক্তিযোদ্ধার রেডিও থেকে গানটি অন্যরকম একটা দ্যোতনা তৈরি করল। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি নিজে মনে মনে গানটি গাইতে গাইতে বাড়ির পথ ধরলাম। শীত ঘন হয়ে উঠছে। কুয়াশা দৃষ্টির শূন্যস্থান পূরণ করে চলেছে। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা মনে হচ্ছে। পাশের খেজুর গাছ থেকে ডানা ঝাপটে একটা বাদুড় উড়ে গেল। একটা ধূর্ত শেয়াল এদিক-ওদিক দেখে দৌড়ে পার হয়ে গেল রাস্তা।
আমি ঢাকা মহানগরীর কোনো চায়ের স্টলে বসে সেই স্মৃতির শেকড় ধরে টান দিই। উঠে আসে বর্ণিল ঋতুপ্রবাহের চিত্র। আমার কৈশোর ও তারুণ্যে সবচে প্রভাব সৃষ্টিকারী ঋতু বসন্ত আর শীত। বসন্ত এলে কামনা করতাম কোনো সঙ্গিনী। একটা শূন্যতা বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠত। যে মানবীকে ভালোবাসতাম তারুণ্যে; তাকে পাশে পেতে ইচ্ছে করত। মনে হতো এ শহরের কোনো ব্যস্ততম সন্ধ্যায় চৌরাস্তায় রিকশায় তার দেখা পাব। তাকে চিৎকার করে ডাকব… এই শোনো। হয়তো সে শুনবে না। কিন্তু আমার স্মৃতিস্বর পৌঁছে যাবে শহরের সব গলিতে, জানালায়। শহরের জানালা থেকে আলোগুলো ময়ূরপুচ্ছ এলিয়ে দিয়েছে। কোনো সুন্দরী গৃহবধূ বাইরে তাকিয়ে নীলাকাশ দেখার চেষ্টা করছে। কৃষ্ণচূড়ার শাখায় শাখায় ল্যাম্পপোস্টের আলো। কী অসাধারণ সেই রক্তিম দৃশ্য, সেই অভূতপূর্ব অনুভব। মাঝে মাঝে বর্ষার একঘেয়ে কান্না আমার ভালো লাগে না। আমি আড্ডাপাগল মানুষ। বাইরে যেতে চাই। বর্ষাকাল আমাকে ঠেকিয়ে দেয়। ঘরে বন্দি করে ফেলে। আমি বরং স্মৃতির দরজা খুলে ঢুকে পড়ি জ্যৈষ্ঠের দীঘল দুপুরে খাঁখাঁ রোদের অট্টহাসি। ঘাম দরদর দেহের ক্লান্তি। কিন্তু আম জাম কাঁঠালের আহ্বানে দুলে ওঠে মন। আমার প্রিয় ফল আম আর লিচু। প্রচণ্ড গরমের ভেতরও জীবনের অর্থ খুঁজে পাই। বাংলাকে গভীর মমতায় ভালোবাসতে থাকি। মনে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাÑ নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম/চির মনোরম চির মধুর…।’ নজরুলের এ কবিতার মধ্যে যেন বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা। ষড়ঋতুর এ বাংলাদেশ। আজ থেকে একশ বছর আগে নজরুল বাংলাদেশের নাম দিয়ে দিলেন। কবিরা দ্রষ্টা। তারা জানে ভবিতব্য। একদিন বাঙালি জাতির একটা মানচিত্র হবে, একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশ হবে। কোনো দিন মুক্তিযুদ্ধ হবে। বাঙালির তরুণ ছেলেরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। একটা মানচিত্র পাবে পরাধীন জাতি। কেউ জানত কি? কিন্তু কবি স্বপ্ন দেখেছিলেন। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কপোতাক্ষ কত শত নদ-নদী। কত অনুপম সব নদ-নদী। আর অনিন্দ্য তার ঢেউরাশি। পলি আর রক্তের ধারায় উর্বর এ ভূমি। আর আমরা ভূমিপুত্র। বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই, পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’। জীবনানন্দের এ অমোঘ লাইনটি কী যে প্রেরণা জোগায়, কী যে শেকড়সঞ্চারী। কিন্তু সুকান্তের সেই প্রজ্বলন্ত কবিতা আমাদের জীবনের সত্য তীব্র করে তোলে : ভাঙা ঘর ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো/হে মহামানব এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।’
যে প্রেম, যে ভালোবাসা বুকে নিয়ে বাঙালির আপামর মানুষ ঋতুমুগ্ধ বাংলাকে বাঁচাতে নির্ভয়ে প্রাণ দিয়েছিল, তারা আজও ক্ষুধার্ত। তাদের প্রিয়জন এখনও নিখোঁজ। এ বাংলায় কবে ফিরবে নিখোঁজ ভাই। কবে পবিত্র হবে নির্যাতিত বোন। কবে মা চোখ খুলে দেখবে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে তার বুকের মানিক। মা বলবেন, বাবা, হাতমুখ ধুয়ে আয়; রসের পিঠা খেয়ে নে। কতদিন পায়েস খাসনি। এই হলো আমার বাংলাদেশ। আমার প্রিয় মাতৃভূমি। আমি ভালোবাসি আর নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকি বাংলার অপরূপ মুখের দিকে।