× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বৃষ্টি ও জারুল

আহমাদ শামীম

প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:৪৬ পিএম

চিত্রকর্ম : হাসুরা আকতার রুমকি

চিত্রকর্ম : হাসুরা আকতার রুমকি

আমাদের শৈশবের কোনো এক বর্ষায়, সুলতানের বাবা মারা গিয়েছিল। শ্রাবণের ধীরতাল অকৃপণ বৃষ্টির মধ্যে বাবার লাশ দাফনের সময় সুলতান কেঁদেছিল কি না সেদিন, তা জানা হয় নাই কখনও। শুধু বুঝতে পারলাম মোটামতন ডানপিটে মো. সুলতান হঠাৎ কেমন বড় হয়ে গেল।

আকাশের বাবার মৃত্যুও হয়েছিল বর্ষাকালে। ঘোরলাগা বৃষ্টির এক সন্ধ্যায় আকাশের বাবা, সবার প্রিয় জাফর চাচার হঠাৎ মৃত্যু প্রথমবারের মতো আমাদের মৃত্যুশোকে আচ্ছন্ন করল। আগরবাতির ধোঁয়ার ভেতর জাফর চাচার লাশের পাশে সারারাত ধরে কোরআন তেলাওয়াত করতে করতে, তার সাইকেলের পেছনে বসে দরগার মেলায় যাবার স্মৃতি রোমন্থন করেছি। বাবার মৃত্যু শোক কাটিয়ে দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে গেল আকাশ, শুধু মুখে মুখে ছড়া কাটার কুশলতা হারিয়ে ফেলল সে।

জাফর চাচার মৃত্যু-পরবর্তী বর্ষাকাল আমাদের জন্য আরেকটি মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে হাজির হবে, এ কথা আমরা কেউ ভাবতে পারি নাই। এক হাতে মৃত্যু আর অন্য হাতে বন্যার পয়গাম নিয়ে খুব সন্তর্পণে নেমে এসেছিল সেই বর্ষা। এবারের মৃত্যুকে অস্বাভাবিক মৃত্যুই বলা চলে। গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি, যাকে দেখে কৈশোরে প্রথম প্রেমের বোধ তৈরি হয়েছিল, সেই রোমানার বাবা দিলু চাচা সেবার মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়। শহর থেকে ফেরার পথে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হন তিনি। তীব্র আঘাতে তার মুখের একপাশ থেঁতলে যায় আর বাম চোখটি অদ্ভুতভাবে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। বাবার লাশ দেখে রোমানার ঘুরে পড়ে যাওয়া আর তার মায়ের বিকট বিলাপ আমাদের তাড়িয়ে বেড়াত, এরপর রাতে আমরা অনেকদিন ঘুমাতে পারি নাই। ওই বর্ষার অতিরিক্ত বৃষ্টিতে বন্যার প্রাদুর্ভাবে সারা গ্রামে পানি আর পানি। দিলু চাচার লাশ তাই তার নিজ ঘরেই দাফনের ব্যবস্থা করা হলো। ঠিক দু’দিন পর রোমানারা যখন নৌকা করে গ্রাম ত্যাগ করে, সেদিনও আমাদের সমবয়সিদের হৃদয়ে পাড় ভাঙার শব্দ; রোমানাকে আমরা কেউ ভুলতে পারি নাই।

তার পরবর্তী বর্ষাতেও আমরা আরেকটি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলাম। রমজানের বাবা গফুর কাকা সেই বর্ষায় মারা যান সাপের কামড়ে। মাছের নেশায় বর্ষার প্রায় পুরোটা সময় কাটত তার নৌকায়। বৃষ্টির মধ্যে কোনো এক রাতে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি তিনি। পরদিন সকালে তার লাশ পাওয়া যায় নৌকায়। সাপের বিষে কুচকুচে কালো হয়ে ফুলে ওঠে তার পুরো শরীর। হাত-পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে নৌকায় পড়ে থাকা গফুর কাকার লাশ আর কোনোভাবেই সোজা করা যায়নি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ভেতর জানাজার সময় খাটিয়ার ভেতর থেকে তার কালো হাতটি বেরিয়ে ছিল। এই দৃশ্যের ভয়াবহতার দরুনই বোধহয় রমজানের চোখে জল দেখা যায়নি।

এভাবে প্রায় প্রতিটি বর্ষায় মৃত্যু হানা দিয়ে যাচ্ছিল বলে আমরা বেশ শঙ্কিত ছিলাম। বর্ষা মানেই যেন মৃত্যুর হাহাকার আর শোকের মাতম। গ্রামের শেষ মাথায় খাল পাড়ের উঁচু জায়গায়, বড় আঁকাবাঁকা জারুল গাছটির ডালে বসে আমরা সমবয়সিরা বিকালের খেলা ফেলে প্রায় প্রতিদিনই নিশ্চুপ বসে থাকতাম। জারুল গাছটিকে আমরা বন্ধ্যা জারুল বলে ডাকতাম। কোনো ফুল বা ফল কিছুই দিত না গাছটি। কোনো এক অজানা কারণে গেল কয়েক বছর থেকে আমাদের সমাবেশস্থলের বন্ধ্যা জারুল গাছটি থেমে থেমে ফুল দেওয়া শুরু করল। গাছভর্তি ফুল, যেন বেগুনি রঙের আগুন লেগেছে সেখানে। আমাদের মধ্যে আকাশই প্রথম আবিষ্কার করল, প্রথম যেবার ফুল ফুটল গাছটিতে সেবারই সুলতানের বাবা মারা যায়। এবং আমরা আশ্চর্য হলাম গত কয়েক বছরে যখন জারুল গাছে ফুল ফুটেছে, তখনই কেউ না কেউ মারা গেছে।

গফুর কাকার মৃত্যুর পরের বর্ষা ঘনিয়ে আসতে আমরা আরেকটি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম মনে মনে। জারুল গাছটিতে বসে বসে ফুল ফোটার অপেক্ষায় থাকতাম। কিন্তু সেবার জারুল গাছে ফুল দেখা যায়নি। এই ঘটনায় আমরা কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেও এক অজানা আশঙ্কায় দুরুদুরু বুকে মৃত্যু সংবাদের জন্যই অপেক্ষা করতাম। 

বন্ধুদের বাবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে গিয়ে আমার নিজের বাবার কথা মনে পড়ে যেত। এই মানুষটিকে আমার দেখা হয় নাই কখনও। তিনি কে বা কেমন ছিলেন সেটাও জানা হয় নাই। বলা যায়, তিনি অপরিচিতই ছিলেন আমার কাছে। কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমার জন্মের কয়েক মাস আগে তিনি হঠাৎ নিরুদ্দেশ হন। ফলে তাকে দেখা হয় নাই কখনও, এমনকি তার কোনো খোঁজও পাওয়া যায় নাই এরপর। ছোটখালার কাছে শুনেছি, তিনি বেশ সুপুরুষ আর আনন্দপ্রবণ মানুষ ছিলেন। তার নাম ছিল আনোয়ার হোসাইন। আনোয়ার হোসাইন নামের মানুষটির প্রতি আমার এক ধরনের আগ্রহ ছিল, কিন্তু তার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানানো হতো না আমাকে। মায়ের কাছ থেকে জানব সেই সুযোগটাও আমার বাবা ভদ্রলোকটি করে যাননি। তার নিরুদ্দেশ হবার পর থেকেই সঙ্গী হারানোর বেদনা হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে হোক তিনি মানসিক সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ফলে মাকেও দেখতাম গৃহবন্দি অবস্থায়।

দুই.

নিরুদ্দেশ বাবা আর উন্মাদ মায়ের সন্তান হিসেবে যতটা ভোগান্তি পোহানোর কথা ছিল, তার কিছুই আমাকে দেখতে হয়নি। শৈশব-কৈশোর কেটেছে নানাবাড়িতে। নানাবাড়িই ছিল আমার ঠিকানা। জন্মের পর নানিই আমাকে নিজ সন্তানের মতো বড় করে তুলেছেন। এ কারণে তাকে নানিআম্মা বলে ডাকতাম। আর ছিল ছোটখালা। এই দুটি মানুষ ছাড়া নানাবাড়ির আর কারও সঙ্গেই আমার সখ্যতা ছিল না। নানাকে দেখেছি আমাকে এড়িয়ে চলতে। ছোটখালা বলতেন আমি না কি দেখতে বাবার মতো। সে কারণেই হয়তো নানা আমাকে পছন্দ করতেন না। আমার বাবা সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি সেটাও ছোটখালার মুখেই। তার কাছে শুনেছি বাবা-মায়ের ছিল প্রেমের বিয়ে। কলেজে পড়ার সময় তাদের প্রেম হয়। এবং নানার অমতে তারা একসময় বিয়েও করে ফেলেন। বাবার পরিবারও নাকি এই বিয়ে মেনে নেয়নি। নানার অনিচ্ছাসত্ত্বেও নানিআম্মার কল্যাণে তারা এ বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। বছর খানেক ভালোই কাটল তাদের। বিয়ের দুই বছরের মাথায় যখন মা অন্তঃসত্ত্বা হলেন তখনই শুরু হলো টানাপড়েন। আমার নানা তাকে নিজ বাড়িতে যাবার তাড়া দিতে লাগলেন। কিন্তু বাবার বাবা অর্থাৎ আমার দাদার কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। ওই পরিবারের একমাত্র সন্তান আমার বাবা, তার পরিবারের অমতে বিয়ে করেছে এই দুঃখবোধ থেকে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করা হয়। ফলে তার পক্ষে সেখানে ফিরে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছিল না। সদা আনন্দপ্রবণ আমার বাবা গান ভালোবাসতেন আর ছিলেন অলসপ্রকৃতির। কোনো কাজেই তার মন ছিল না। বেকার স্বামী তারপর আবার ঘরজামাই, এসব নিয়ে নানার নিত্য খোঁটায় বাবার সঙ্গেও মায়ের ঝামেল শুরু হলো। আমি যখন গর্ভে তখন মায়ের সঙ্গে বাবার তুমুল ঝগড়ার কোনো এক রাতে বাবা ঘর ছাড়েন। তিনি আর ফিরে আসেননি। এই ঘটনার কয়েক মাস পর আমার জন্ম। মা তখনও না কি ভালোই ছিলেন। চুপচাপ থাকতেন, ঘর হতে বের হতেন না আর কারও সঙ্গে তেমন কথাও বলতেন না। আমার বয়স যখন এক বছর, তখন থেকেই না কি মায়ের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। নানান সময়ে ছোটখালার সঙ্গে খুচরো খুচরো আলাপে বাবা আর মা সম্পর্কে এসব জেনেছি আমি।

তিন.

বাবা-মা ছাড়া খারাপ ছিলাম না আমি। ছোটখালা, নানিআম্মা আর গ্রামের সমবয়সিদের সঙ্গে ভালোই কাটত সময়। শুধুমাত্র বর্ষাকাল এলেই মৃত্যুর শোক আর আতঙ্ক নিয়ে দিন পার করতাম। খালপাড়ের বন্ধ্যা জারুল গাছটিও একসময় আমার বন্ধু হয়ে ওঠে। গফুর কাকার মৃত্যুর পর দুই বছর জারুল গাছে ফুল আসেনি। সে কারণেই হয়তো ওই দুটি বছর আমাদের কোনো মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়নি। এভাবে যখন সময় কেটে যাচ্ছিল তখনই গ্রীষ্মের শেষে হঠাৎ একদিন জারুল গাছে ফুল আবিষ্কার করলাম আমরা। এক অজানা আশঙ্কায় আক্রান্ত হলাম আমরা সমবয়সিরা সবাই। গ্রামের মুরুব্বিরা আমাদের এই কথা আমলে নেবেন না, তাই বলাও যাচ্ছিল না কাউকে। সেবার বর্ষা কোনো প্রকার দুঃসংবাদ ছাড়াই চলে যাচ্ছিল বলে আমরা স্বস্তিতে ছিলাম। কিন্তু বন্ধ্যা জারুল গাছে যখন ফুল ফুটেছে সে তো শোকের বার্তা দেবেই। ওই বর্ষায় মারা গেল শেখ ফরিদের বাবা। বর্ষার একেবারে শেষে বিদেশ থেকে তার মৃত্যুর সংবাদ এলো। উঁচু দালানের ওপর থেকে দুর্ঘটনাক্রমে ইট পড়ে তার মাথায়। সেখানেই মৃত্যু হয়। কালো রঙের বিশাল এক কফিনে করে তার লাশ আনা হয় দেশে। মাথায় ইট পড়ার দরুন তার শরীরে ওপরের অংশ কালো একটি পিণ্ডের মতো হয়ে যায়। সেখানে চেহারা বলে অবশিষ্ট কিছুই ছিল না। দাফনের পর লাশবাহী কফিনটি পুড়িয়ে ফেলা হয়। কফিন পোড়ানো বিকট সেই গন্ধ গ্রামের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। বর্ষার শেষ কয়টি দিন গন্ধের এই দুর্ভোগ নিয়েই আমাদের কেটে যায়।

শেখ ফরিদের বাবার মৃত্যুর পর আমাদের সমবয়সিরা কেউ তেমন জারুল গাছটির ছায়া মাড়াতো না। শুধুমাত্র আকাশকেই দেখতাম আমার মতো নিয়মিত গাছটির কাছে গিয়ে বসে থাকত। আকাশ কেন যায় জারুল গাছটির কাছে, এই প্রশ্নের উত্তর পাইনি কখনও। আমি নিজে কেন যেতাম সেটারও কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছিল না। আকাশ হয়তো তার বাবার মৃত্যুর সঙ্গে জারুল গাছটির কোনো সূক্ষ্ম যোগাযোগ খুঁজত। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কারণ ছিল কোনটি? আমার নিরুদ্দেশ বাবার খোঁজ জানার জন্যেই হয়তো।

আমার সমবয়সিরা যখন একে একে প্রায় সকলেই বাবার স্মৃতি বলতে মৃত্যুর কথাই স্মরণ করত, তখন আমি চুপচাপ শুনে যেতাম। বাবার কোনো স্মৃতি নেই, এমনকি মায়েরও না। কখনও কখনও একা একা যখন জারুল গাছের নিচে যেতাম, তখন কেমন এক দুঃখবোধ আমাকে গ্রাস করে নিত। বাবার মুখ আমি কল্পনা করার চেষ্টা করতাম। মায়ের কথা ভাবতাম।

মানসিক সমস্যা প্রকট হবার পর নানাবাড়ির পাশাপাশি বড় দুটি ঘরের একটিতে একাই থাকতেন মা। কাউকে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। এমনকি আমাকেও না। একমাত্র ছোটখালাকে ছাড়া। অন্য কেউ তার কাছে গেলে তিনি হিংস্র হয়ে উঠতেন। ভয়ে কেউ যেত না ওই ঘরে। ছোটখালাই তাকে খাওয়াতেন, গোসল করিয়ে দিতেন। ছোটখালা যখন মায়ের চুল আঁচড়ে দিতেন মা তখন গুনগুন করে গান গাইতেন। মা দেখতে অনেকটা পরীর মতো ছিল, ছোটবেলায় তাকে দেখে আমার তেমনই মনে হতো। চুরি করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মাকে দেখতাম প্রায় প্রতিদিনই। খুব ইচ্ছে হতো ছোটখালার মতো মায়ের পাশে বসে তার চুল আঁচড়ে দিই আর তিনি ছোট্ট মেয়ের মতো আদুরে ভঙ্গিতে পা নেড়ে নেড়ে গান গাইবে গুনগুন করে। 

কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না। মা যেদিন আমার গলাটিপে ধরেছিলেন, ছোটখালা পাশে না থাকলে হয়তো মারাই যেতাম, সেদিন থেকে নানিআম্মার কড়া নিষেধ আমি যেন ওই ঘরের পাশেও আর না যাই। মা-ই নাকি ছোটখালাকে বলেছিলেন, আমাকে দেখতে চান তিনি। তার স্বাভাবিক আচরণ ও ছেলেকে দেখতে চাওয়ার ইচ্ছায় ছোটখালা সরল মনেই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার কাছে। আমার জ্ঞান হবার পর সম্ভবত সেটাই ছিল মায়ের মুখোমুখি হবার প্রথম ঘটনা। এলোমেলো চুল আর আলুথালু বসনের এক পরীর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেদিন আমি যেন। মনে পড়ে, তিনি আমাকে কাছে টেনে নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। তারপর হঠাৎ করেই আমার গলাটিপে ধরলেন শক্ত হাতে। মায়ের চিকন আঙুলগুলো আমার গলায় বসে যাচ্ছিল, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না কিন্তু কোনো আওয়াজ করতে পারি নাই; মন্ত্রমুগ্ধের মতো অবাক দৃষ্টিতে তাকে দেখছিলাম। ছোটখালার চিৎকারে নানিআম্মা ছুটে এসেছিলেন। দুজনে জোর করে আমাকে তার হাত থেকে ছাড়িয়ে নেন। নানিআম্মা মাকে ‘ডাইনি’ বলে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে আমাকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যান। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। বেরিয়ে আসবার সময় মায়ের উঁচুগলায় হাউমাউ করে কান্নার আওয়াজ ছাড়া পরবর্তী আর কিছুই মনে নেই আমার। এই ঘটনার পর নানিআম্মার কড়া নিষেধ অমান্য করে মায়ের সামনে এমনকি একা একা ওই ঘরের পাশেও যেতাম না। শুধু দুপুরবেলা ছোটখালা যখন মায়ের কাছে যেতেন তখনই জানালা দিয়ে লুকিয়ে মাকে দেখতাম।

দ্বিতীয়বার মায়ের কাছে গিয়েছিলাম গ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে আসবার দিন। প্রায় আট বছর আগে। মা তখন নিথর-নিস্তব্ধ, চুপচাপ বসে থাকেন আর নিজ মনে বিড়বিড় করে কথা বলেন। ছোটখালাকেই বলেছিলাম মায়ের কাছে নিয়ে যেতে। প্রথমে তিনি রাজি হলেন না, পরে আবার কী ভেবে যেন রাজি হলেন। মায়ের কাছে যেতেই তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। খুব ইচ্ছে করছিল মায়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিই একবার। কিন্তু হাত দুটো পাথর হয়ে গিয়েছিল, নড়ছিল না। আমার ছোটবেলার পরীর মতো মা ততদিনে দেখতে কেমন যেন হয়ে গিয়েছেন। এ যেন অন্য কোনো মানুষ যাকে আমি দেখি নাই কখনও।

আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বড় মামা আমাকে ঢাকা নিয়ে আসেন। সেটা হয়তো আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে এখন একাই থাকি শহরে। কিন্তু গ্রামে আর যাওয়া হয়নি কিংবা বলা চলে ফেরার ইচ্ছাই হয়নি কখনও। মাঝের এতগুলো বছর কীভাবে কেটেছে, তা আমি বলতে পারব না। কখনও কখনও মাকে দেখতে ইচ্ছে করত, জারুল গাছের নিচে বসতে মন চাইত, আমার সমবয়সি বন্ধুদের কথা মনে হতো। কিন্তু এসব কোনো কিছুই আমাকে শেষ পর্যন্ত সেখানে নিয়ে যেতে পারেনি।

চার.

আমার শৈশবের বর্ষাকালগুলো কেটেছে মৃত্যুর মুখরতায়। সেখানে ছিল এক বন্ধ্যা জারুল গাছ। সেই গাছে ফুল ফুটলেই মৃত্যু নেমে আসত লোকালয়ে। আট বছর পর এমনি এক বর্ষাকালেই আমাকে ফিরতে হয়েছিল সেখানে। উপলক্ষ আর কিছুই নয়, মৃত্যু। মা মারা গিয়েছেন বৃষ্টির এক সন্ধ্যায়। ছোটখালা ফোনে জানিয়েছিলেন। মায়ের মৃত্যুর সংবাদে আমার ভেতর কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়নি। পৃথিবীর সঙ্গে আমার সংযোগ স্থাপন হয়েছিল যার মাধ্যমে, সেই মানুষটি আজ নেই। কেমন যেন হালকা লাগছিল নিজেকে।

আমার পরীর মতো মাকে শেষবারের জন্য দেখবার তাড়নায় থেকেই হয়তো আমি গিয়েছিলাম গ্রামে। মধ্যরাতে চন্দ্রপুর বাজারে নেমে ঝুম বৃষ্টির ভেতর অনেকদিন আগের চেনা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম নানাবাড়ি। সবই আগের মতোই আছে। নানা মারা গেছেন, সেও অনেকদিন হলো। নানিআম্মা চোখে দেখেন না এখন, ছোটখালা বুড়িয়ে গেছেন। আমার সমবয়সি বন্ধুরাও বড় হয়ে গেছে। সুলতান, আকাশ, রমজান, শেখ ফরিদÑ সবাই উপস্থিত ছিল সেদিন। আগরবাতির ঘ্রাণে আমি শৈশবে ফিরে গেছিলাম। যেদিন আকাশের বাবা মারা গেছিল। কেমন একটা ঘোরের জগতে প্রবেশ করেছি মনে হলো। 

ছোটখালার অনুরোধে মায়ের লাশের পাশে কিছুক্ষণ বসেছিলাম। সাদা কাপড় সরিয়ে মায়ের মুখের দিকে যখন তাকালাম, ঠোঁটের কোনায় লেগে থাকা হাসির কারণে তাকে চিনতে কষ্ট হয়নি একবিন্দু। পরদিন সকালে মায়ের লাশ কাঁধে করে নিয়ে গেছিলাম দাফনের উদ্দেশ্যে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিনও। মায়ের লাশ কবরে নামানোর জন্য যখন হাতে তুলে নিয়েছিলাম, আমার সারা শরীরে হঠাৎ বিদ্যুৎ স্পর্শের অনুভূতি টের পেলাম। এই প্রথম মায়ের জন্য আমার খারাপ লাগতে শুরু করল। তার লাশ হাতে নিয়ে আমি শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে গেলাম। কিংবা তারও আগে চলে গেলাম। দেখতে পেলাম মা বাবার হাত ধরে এক সবুজ মাঠের মধ্যে হাঁটছে। অনেক অনেক দিন পর বাবার কথাও মনে পড়ে গেল। মায়ের মুখটি একবার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করল। তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে মন চাইল। কিন্তু এখন আর কিছুই সম্ভব নয়। মায়ের লাশ কবরে নামিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। এ বছর জারুল গাছে ফুল ফুটেছে কি না আমি জানি না। মৃত্যু যখন এসেছে, তখন জারুল গাছে ফুল ফুটেছে নিশ্চয়ই। 

সেদিনই ঢাকা চলে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নানিআম্মার অনুরোধে থেকে যেতে হলো দু’দিন। দু’দিন পর চলে আসবার সময়, ছোটখালা একটি ডায়েরি হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা তোর বাবার ডায়েরি’। লেখায় ভরা পৃষ্ঠাগুলোর ভেতর একটি তার ছবি আবিষ্কার করলাম। সাদা কালো সেই ছবির মধ্যে ঝাঁকড়া চুলের একজন মানুষ নায়কোচিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। এই মানুষটিই আমার বাবা। এই প্রথম বাবাকে দেখতে পেলাম। ছোটখালা ঠিকই বলতেন, আমি দেখতে অনেকটা বাবার মতোই। চলে আসবার আগে জারুল গাছটির নিচে গিয়ে বসেছিলাম কিছু সময়ের জন্য। গাছটি আগের মতোই আছে। অবাক করার বিষয় হলো, জারুল গাছে এবার কোনো ফুল ফোটেনি। বাবার ছবিটি গাছের নিচে মাটি চাপা দিয়ে এসেছিলাম। মায়ের মৃত্যুর পর অদেখা এই মানুষটির প্রতি আমি সব আকর্ষণই হারিয়ে ফেলেছিলাম। তিনি যদি মারা গিয়ে থাকেন, তবে তো শেষই হয়ে গেল। আর যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে যেন জারুল গাছে অন্তত একবার ফুল ফুটুক। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা