× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পথের গল্প

হামিম কামাল

প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:৪৩ পিএম

আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:৫৩ পিএম

পথের গল্প

তুরগ

শেরাটন হোটেলের পশ্চিম পাশের রাস্তা। শখানেক গাড়ি ধুঁকে ধুঁকে শাহবাগের দিকে এগোচ্ছে। আমার মিনিবাসটিও এ ক্যারাভানের অংশ। বিকট যানজট। চারপাশে কোলাহল-কালো ধোঁয়া। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, কানও ঝালাপালা। যেতে হবে মৎস্যভবন। রেলিং ধরে দুলছি। সামনে এক বাবা-ছেলে বসা।

আমাদের অবস্থান একদম সেই রাজসিক ভাস্কর্যটির পশ্চিম পাশে। সামনের বাবা-ছেলে বাইরে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি জানালার ধারে বসা যেহেতু, বালকসুলভ কৌতূহলে চিবুক উঁচিয়ে ‘রাজসিক’ নামে ওই ঘোড়াটানা গাড়ির ভাস্কর্যটি মন দিয়ে দেখছিল। ওর সঙ্গে আমিও দেখছিলাম। ভাস্কর মৃণাল হকের কাজ। সকালের সূর্য ধূসর মেঘের আড়ালে। মরচে-সোনালি রঙের ভাস্কর্যটি ম্লান। একটু মন খারাপ করে দেওয়া দেখাচ্ছে। আমার চোখে। হয়তো ছেলেটির চোখেও। ভাবছিলাম, এমন ঘোড়ার গাড়ি সে এতকাল বইয়ে দেখেছে।

এমন সময় অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। ঘোড়ার হ্রেষা শুনতে পেলাম। তা নিশ্চয়ই ভাস্কর্য থেকে আসছে না। ছেলেটিও চমকে উঠেছে। মুহূর্তে তার ক্ষুদ্র জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে বড় বিস্ময়টি চলে এলো। বাসের পাশে এসে দাঁড়াল এক ঘোড়ার গাড়ি। ওর তো পুরান ঢাকায় থাকার কথা। পরীবাগের এ জটজাড্য রাস্তায় এলো কেমন করে? ছিলই বা কোথায়? ছেলেটা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। যেন নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

দুটো ঘোড়ার একটি ভাস্কর্যের দিকে, আরেকটি ঘোড়া ছেলেটির জানালার দিকে। জানালার দিকের ঘোড়াটির গায়ের রঙ চুনঢালা সাদা। তার পাশের ঘোড়াটির সারা গায়ে সাদাকালো ছোপ। যেন পৃথিবীর মানচিত্র। কে জানে চুনসাদা ঘোড়াটির কোনো বালকের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে কি না। দিব্বি সে ছেলেটির জানালার দিকে তার লম্বা মাথা বাড়িয়ে দিল।

সাদা ঘোড়ার জানালার চৌকাঠ পেরিয়ে ছেলেটির দিকে এগিয়ে এলে বাবা ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলেটিকে আগলে নিল। কিন্তু বাবার বাহুর ভেতর থেকে হাঁসফাঁস করা ছেলেটি তখন প্রতিবাদ করে উঠেছে, ‘বাবা ছাড়ো, বাবা ছাড়ো!’ এমন সময় ঘোড়ার গাড়িটি সামনে আরও খানিকটা জায়গা পেল। সুতরাং জানালা ছাড়িয়ে আরও হাত দশেক এগিয়ে গেল ঘোড়াগুলো। দেখে বাবা ছাড়ল ছেলেকে। ছেলে আবার জানালা। এবার জানালার চৌকাঠ ছাড়িয়ে তার মাথা বাড়ানোর পালা। আমি মৃদু হেসে বিজ্ঞ পর্যবেক্ষকের মতো দেখছি। আমারও পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ল। চিড়িয়াখানা গিয়ে যখন প্রথম ঘোড়া দেখেছিলাম, অবাক হয়ে গিয়েছিলাম দেখে যে ওরা আমার কল্পনার চেয়ে উঁচু। আর ওদের কেশর, লেজ আমার আঁকা ছবির চেয়ে মসৃণ। ছেলেটাও মাথা বের করে রেখেছে। খুঁটিয়ে দেখছে গাড়ি। তার বাবার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলো। যেন বলছি, চলুক চলুক। আমরাও তো ছিলাম এমন।

এ সময় বাসটা ঘোড়ার গাড়ির চেয়ে এগিয়ে গেল। সাদা তুরগের সেই চেনা মাথাটা আবারও চলে এলো জানালার খুব কাছে। ছেলেটা এবার দুঃসাহসী। হাত দিয়ে ঘোড়াটার মাথা ছুঁয়ে দিত চাইল। আমি ভেবেছি বাবা বোধহয় তাকে পিছিয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু তা করল না ভদ্রলোক। কিন্তু কী অবাক কাণ্ড। ছেলেটি নিজ থেকেই চমকে পিছিয়ে এলো।

কী ব্যাপার, কী কারণ? তাকিয়ে দেখি ঘোড়াটা অস্বাভাবিক হাঁ করে আছে। মুহূর্তের জন্য আমারই মনে হলো, কামড়াবে নাকি! পরমুহূর্তে ভুল ভাঙল।

ঘোড়াটা ইচ্ছে করে মুখ এমন করে রাখেনি। লাগামের লোহার আংটা তার দাঁতের পাটি পেরিয়ে ঠোঁটের দুই কিনারে চলে গেছে। প্রথমবারের মতো লক্ষ করলাম, ঘোড়াটার ঠোঁটের দুই পাশে দগদগে ঘা। শুধু আমি নই, ছেলেটিও লক্ষ করেছে। ছেলেটি চোখে অবিশ্বাস নিয়ে দেখল, সহিস হাত যখন লাগাম টেনে ধরছে, তখন ঘোড়ার ঠোঁটের ওই জায়গা দুটোর লাল ক্ষত জলরক্তে ভিজে ভিজে উঠছে। কী কষ্ট।

বাস এগিয়ে গেল। ঘোড়ার গাড়িটা আবার পিছিয়ে পড়ল। বুড়ো সহিস লোকটা তখন বাতাস কেটে চাবুক মারল ঘোড়া দুটোর পিঠে। গায়ে পৃথিবীর মানচিত্র আঁকা ঘোড়াটা চিৎকার করে উঠল। সাদা ঘোড়াটা নীরব। নিঃশব্দে গতি বাড়িয়ে ছেলেটার জানালার কাছে চলে এলো আবার।

ছোট্ট ছেলেটার চোখে অশ্রু। বলল, ‘বাবা দেখো, ঘোড়াটাকে কষ্ট দিচ্ছে ওই লোকটা।’

বাবা ছেলেটার চোখের পানি মুছে দিল। বলল, ‘তারই তো ঘোড়া। সেও তার ঘোড়াকে খুব ভালোবাসে কিন্তু। তুমি যেমন বাসছ।’

রাষ্ট্রচালিত মূকাভিনয়

ভিক্ষুক ছেলেটা মুখচোখ বাঁকা করে তাকাল। বয়েস কুড়ির মতো হবে। তার হাত দুটো কি নিয়ন্ত্রণহীন? কেমন ভাঙা খেলনার মতো ঝুলছে। কাঁধে একটা নোংরা ঝোলা। পরনে একটা ময়লা টিয়েরঙা শার্ট। শরীর কাঁপছে থেকে থেকে। আসনগোনা বাসের সুবেশী যাত্রীরা তাকে দেখে নড়েচড়ে বসল।

বাসের ভেতর মধ্যপথ ধরে এগোতে শুরু করল ভিক্ষুককুল চূড়োমণি। কী দুর্গন্ধ গায়ে! ইচ্ছে করেই যেন ভদ্রজনদের সাদা পোশাকের সঙ্গে ঘষে ঘষে এগোচ্ছে। চোখে মুখে কষ্টের ছাপ। তাতে কী। সেই ছাপের নিচে চাপা পড়া একটা বিমলানন্দ। চোখ ঠিকই প্রকাশ করে দিচ্ছে। তাকে ভিক্ষা দেবে কী, শুরুতেই যে কথা মনে হচ্ছিল লোকের তা হলো, এ ব্যাটাকে তাড়ানো দরকার।

বাসের ভদ্রসকল হেলপারকে দুয়ো দিতে থাকল। একজন বলল, ‘এ ধরনের লোক বাসে তুলে তুমি কী বোঝাতে চাও? না উঠতে দিলে কি এরা না খেয়ে মরে যাবে?’

অন্য পাশের একজন বললেন, ‘এ বাসে ভদ্রলোকেরা চড়ে। এভাবে এদের তুলবে না। দেখো কেমন গায়ের সঙ্গে ঘেঁষে ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছে ইচ্ছে করে। তোমাদের এসব আচরণে কিন্তু মেজাজ খারাপ হয়।’

হেলপার তৎক্ষণাৎ মারমুখী। ভিক্ষুক ভাবছিল বাসের শেষ প্রান্ত থেকে মাধুকরী শুরু করবে। কিন্তু তরুণ হেলপার তার কাঁধ খামচে ধরল। উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিল তাকে। জোরালো টানে উল্টো দিকে ফেরায় হাতগুলো বিচিত্রভাবে নড়ে উঠল। একটা হাতের উল্টোপিঠ এক মসৃণ সুন্দরীর গালে গিয়ে লাগল। বেচারি বই পড়ছিল। শোরগোলে মন ছিল না। চমকে উঠল, পরমুহূর্তে জ্বলে উঠল, ‘উফ! এটা কী, এটা কে!’

ভিক্ষুকের ঠোঁটে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। সে তার ভাষায় খিস্তি করছিল হেলপারকে। সম্ভবত বাকপ্রতিবন্ধী। ভাষা বোঝা গেল না। তবে ভাব ধরা পড়ল।

বিজয় সরণির ফোয়ারার কাছে সিগন্যালে সে উঠেছিল। সিগন্যাল থাকতেই তাকে নামিয়ে দেওয়া গেল। একটি মেয়ে হাতে দুই টাকার নোট ধরে রেখেছিল। রানীগোলাপি রঙের শাড়ি তার পরনে। দৈবদক্ষতায় সেই টাকা আহরণ করল ভিক্ষুক ছেলেটা।

জানালা দিয়ে বাঁ পাশের যাত্রীরা সবাই দেখতে পেল : ভয়াবহভাবে এলোপাতাড়ি হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে সে সরলরেখায় এগিয়ে উঠে পড়ল পরের বাসে। ভয়ানক অধ্যবসায়ী।

কিছু সময় নীরবতা। এরপর টাকা দেওয়া সেই তরুণী দুর্বল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘গরিব মানুষ।’

পাশের মাঝবয়সি ভদ্রলোক বলল, ‘গরিব মানুষ ঠিক আছে। কিন্তু কিছু ব্যাপার তো সবাই জানে। আপনার টাকাটা সে পাচ্ছে না।’

পেছনের একজন বলল, ‘কে পাচ্ছে?’

লোকটা এক মুহূর্ত দম নিল। বলল, ‘এর ধনী মহাজন পাচ্ছে। যে মহাজনের নির্দেশে একে জন্মের পর হাত-পা মুচড়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল যেন এমন করে ঝুলে থাকে। এর মতো অনেককে হাঁড়িতে ভরে রেখে দেওয়া হয়েছিল এক বছর। যেন শরীরটা একটা হাড়মাংসের দলায় পরিণত হয়। যেন আপনি দশ বছর পর তাকে দয়া করে বলবেন, ‘আহা বেচারা, গরিব মানুষ, প্রতিবন্ধী, দিই না দুটি টাকা।’ লোকটা থামল। বোঝা গেল, কমবেশি বক্তৃতা রেখে তার অভ্যাস আছে। ‘এটা ব্যবসা,’ বলল পরমুহূর্তে। ‘পরিষ্কার ব্যবসা। ওই ভিক্ষুক মূলত শ্রমিক। তার মোচড়ানো হাত-পা মালিকের বিনিয়োগ। আপনার আবেগ তাদের পুঁজি। আপনি যত টাকা দেবেন, এ ব্যবসা তত দাঁড়াবে। আর এ ব্যবসা যত দাঁড়াতে থাকবে, এ গরিব প্রতিবন্ধীদের স্রোত কোনো দিন বন্ধ হবে না। এরা নিত্যনতুন তৈরি হবে। হ্যাঁ এবার বলুন কী বলতে চাচ্ছিলেন।’

পাশের যে লোক কিছু বলতে চাইছিল সে আগেই নিজেকে নিরস্ত করেছে। বাসের বেশিরভাগ মানুষের মাথা ওপরনিচ দুলতে থাকল। যে মেয়েটি বইয়ে মুখ ডুবিয়েছিল সে বলল, ‘আপনি নিশ্চিত?’ লোকটি বলল, ‘শতভাগ!’ মেয়েটি বলল, ‘কী আশ্চর্য। এটা আমি জানতাম না।’

‘যাক, বেশি দেরি হয়ে যায় নাই। এটা একটা দুষ্টচক্র। চক্রটাকে ভাঙতে হবে না?’

পাশের দাড়িগোঁফে ভরামুখ ছেলেটা হাসল। ‘এসব চক্র ভাঙার জন্য যাদের নির্বাচন করছি তারাই তো বানাচ্ছে এসব।’

রানীগোলাপি মেয়েটি বলল, ‘এখন করণীয় কী?’

ছেলেটা কিছু বলতে গিয়েও হঠাৎ নিজেকে সংযত করল। আশপাশে লোকেরা কান পেতে ছিল কেউ মেয়েটির কথার কোনো উত্তর দেয় কি না শোনার জন্য। শ্রবণযোগ্য সাড়াশব্দ না পেয়ে আবার হেলান দিল যার যার সিটে। সিগন্যাল ছাড়ল।

মানুষপোড়া ছাই

শাহবাগ। বেশ অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম। বাস বোধহয় রুট ভুলে গেছে। শীত পড়ছিল গতকালের প্রায় দেড় গুণ। ল্যাম্পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সঙ্গে আরও জনাবিশেক মানুষ।

অনেক বাস সবেগে চলে যাচ্ছিল। একটিও মিরপুরগামী নয়। উত্তরা বা এসব দিকের। শুনলাম মিরপুরের বাস নাকি সব মিন্টো রোড ধরে যাচ্ছে। কে যাবে আবার মৎস্যভবনের মোড়ে? তার চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। পথ ভুলে যদি কোনো বাস এসে পড়ে।

কিছুক্ষণ বাদেই ফল পেলাম। একটা ভাঙাচোরা মিনিবাস এসে থামল। গায়ে লেখা ‘ইটিসি’। কোনোভাবে পড়া যাচ্ছে নামটা। রঙ কবে ঘষে উঠে গেছে। দরজাটা ভাঙা, একপাশে ঝুলছে। আর সে দরজা ধরে ঝুলছে শীর্ণকায়া হেলপার। আধখাওয়া পরাস্ত যন্ত্রদানবটা থামতেই সবাই পিরানহার মতো জেঁকে ধরল। ঝপাঝপ উঠে পড়ল। ভাগ্যগুণে ছিলাম সবার সামনে। তাই জনস্রোতের ভালো একটা বল ও ঘাত অনুভব করলাম। বাসের একেবারে পেছনে পাঠিয়ে দিল।

হলুদ আলো। সিটগুলো ভেঙে কোনোটা সামনে হেলে পড়েছে, কোনোটা পেছনে ঝুলে পড়েছে। সিটকভার নোংরা, ছেঁড়া, ভেতরের ফোম মগজের মতো বেরিয়ে আছে। বসার গদিগুলো সিটের ফ্রেমের চেয়ে ছোট, কী কাণ্ড। যেন মাংসের বাইরে হাড়গোড়ের কাঠামো বেরিয়ে আছে। বিমূর্ত শিল্প। পায়ের নিচে নড়বড়ে মেঝে। পায়ের ঘষা লেগে ধাতুর পাত বোধহয় পাতলা হয়ে এসেছে। শরীরের ভর বদলের সঙ্গে সঙ্গে, ওমা, মেঝেও ওঠানামা করে। সব মিলিয়ে বোঝা গেল, এটিকে যে পোড়ানো হতে পারে, সে ব্যাপারে বাস কর্তৃপক্ষ টনটনে। অবরোধ চলছে। প্রচুর বাস পোড়ানো হচ্ছে। মানুষসহ। এ বাসের বয়স কত হবে? অন্তত কুড়ি বছর তো হবেই। দাম বহু আগেই উঠে গেছে। পুড়ে গেলে কোনো অসুবিধে নেই।

যা হোক, পেছনের সিটের মাঝামাঝি বসলাম। ডান দিকের জানালায় তাকিয়ে দেখি, ছোট করে ছাঁটা চুলের এক যুবক বসে আছে, মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক। অসম্ভব আঁটো তার টি-শার্ট। জিনসের প্যান্টও তাই। চোখে মুখে একটা সতর্কতার ছাপ। পেশি টানটান হয়ে আছে ডিসকোবোলাসের মতো। আমার দিকে তাকাল আর গঠাৎ কী হলো সে-ই জানে। মুহূর্তের জন্য চোখে একটা অপ্রস্তুতভাব খেলে গেল। এটা আমার চোখ এড়াল না।

আমি একটু হাবাগোবা কিন্তু গোঁয়ার ধরনের আছি। কেউ যা তা বুঝিয়ে যেতে পারে। আবার মাথাটাও এমন নিরেট শক্ত আমার, একবার কোনো চিন্তা ঢুকে গেলে আর বেরোয় না সহজে।

সেই ছেলের চোখমুখের ত্রস্ততা, অস্থিরতা কি আমাকে কিছু বোঝাতে চাইল? বোধহয়। আমি কিছুটা বুঝলাম, কিছুটা নয়। সে আমার চোখে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার অপ্রস্তুত হয়ে গেল যখন, তখন আমার মাথায় একটা কথা ঢুকে গেল, যেটা তাড়ানো গেল না। এ ব্যাটা তো তক্কে তক্কে আছে!

পত্রিকায় পড়েছি, কিছু আগুনবোমা বাইরে থেকে ছোড়া হয়, কিছু বাসের ভেতর থেকে। সাধারণত ভেতরের আগুনদাতা বসেন সবার পেছনে। জানালার পাশে। এর স্থানাঙ্ক তো সব মিলে গেছে। এবার? আমি তার দিকে ঠায় তাকিয়ে রইলাম। সে নড়েচড়ে বসল। মনে হলো তার অণ্ডকোষের কাছে একটু কিছু লুকিয়ে রেখেছে। আমার ভুলও হতে পারে। সেখানে হাত দিয়ে একটু মুচড়ে আবার আমার দিকে তাকাল। মুখের সার্জিক্যাল মাস্ক একটু ফুলছে, আবার চুপসে যাচ্ছে। বোধহয় তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে।

তুমি তো গভীর মিটশেফের আরশোলা হে যুবক! তোমাকে তো ছাড়া যাবে না।

চোখে চোখে তাকিয়ে রইলাম। সে চোখ সরিয়ে নিল। কিন্তু একবারও মাস্ক সরাল না। পুরু সার্জিক্যাল মাস্ক। বোধহয় ডাবল। হালকা সবুজ রঙের। একবার ভাবলাম, জিজ্ঞেস করি, কী ভাই, মুখোশ পরে আছেন কেন, অ্যালার্জি? নাকি মানুষ চিনে ফেলবে। থাক। হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। আহত-ভীত-ক্ষুধার্ত মাংসাশী জীব সবচেয়ে ভয়ানক।

বাস চলেছে সবেগে। এত বেগে যে পারলে নিজের হেডলাইটের আলো ছাড়িয়ে যায়।

আগারগাঁও পেরোলে আমার আর যুবকের পাশের লোকটি উঠে গেল। আমি মুহূর্তে যুবকের গা ঘেঁষে বসে পড়লাম। বাবা, মারোই যদি, তোমাকে নিয়েই মরব, ক্ষতি কী। আধমাস ধরে ব্যবহার করা আমার আধোয়া চাদর তার নিজস্ব গন্ধ ছড়াচ্ছিল। আমি বাতাসে চাদর নেড়েচেড়ে ব্যাটার দিকে গন্ধ দিলাম ঠেলে। শ্যাওড়াপাড়া আসতেই সে উশখুশ করতে লাগল। আমি বললাম, ‘কী ভাই, নামবেন?’ হ্যাঁ-না কিছু তো বলার কথা ছিল। কিন্তু না, সে কিছু বলল না। নীরবে হাঁটু দিয়ে আমার পা ঠেলতে লাগল, নামতে চায়।

আমি নামতে সুযোগ দিলাম। তথাপি তার দিকে নজর কড়া। তাকিয়ে থাকলাম তার অণ্ডকোষ বরাবর। ওরা ওখানেই বহু কিছু লুকিয়ে রাখে। আমার চোখ তাকে আগাগোড়া মেপে মেপে যাচ্ছিল। বাসের মাঝামাঝি পৌঁছে ছেলেটা ফিরে আমার দিকে তাকাল। একদম চোখে চোখে! তারপর মুখ ফিরিয়ে নেমে গেল দ্রুত। খুব সম্ভব মিশন অসম্পন্ন রেখেই। কেউ জানতেও পারল না। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা