শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস
আনু মুহাম্মদ
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:০৯ পিএম
পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বৈষম্য, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ফল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান গড়ার পর থেকেই দেশের মানুষের ওপর পশ্চিম পাকিস্থান বৈষম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক নিপীড়ন টিকিয়ে রাখার জন্য সামরিক-বেসামরিক নানা পন্থা তারা অনুসরণ করতো। সত্তরের নির্বাচন অস্বীকার থেকে শুরু করে নানাভাবে নিপীড়ন। এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতিগত ঐক্য ও বৈষম্যের চেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের বড় ভূমিকা ছিল। তাদের লেখা, সাংস্কৃতিক তৎপরতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীকে সচেতন করে তোলার কাজ করে গিয়েছেন। নতুন রাষ্ট্রের নির্মাণের জন্য তারা নিরলসভাবে করে গিয়েছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমরা জাতির এই কৃতি সন্তানদের ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে স্মরণ করি, বিষয়টী এমন নয়। আমরা তাদের স্মরণ করি এই সময়ের তাগিদেও।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বৈষম্যহীন একটি দেশ গড়ার স্বপ্নপূরণ হয়। এই স্বপ্নপূরণের জন্য লাখ লাখ মানুষ প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু স্বপ্নের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল তা স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫৩ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। ১৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদাররা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরেই নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তারা বিভিন্ন সময় নিধনযজ্ঞ চালিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে সাহিত্যিক—যে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকারীকে পাকিস্থানি হানাদার ও তাদের দোসররা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কাজটি নয় মাস ধরেই করেছে। বিশেষত বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনায় যারা দেশের মানুষকে সম্ভাবনা দেখিয়েছেন তাদের সবসময়ই নিশানার অগ্রভাগে রাখা হয়েছিল। বিশেষত ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর কার্ফিউ চলমান অবস্থায় ঘাতকরা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা অনুসরণ করে হত্যা করে। তাদের কেন হত্যা করা হয়? কারণ তারা বুদ্ধিবৃত্তিক ও ফলপ্রসূ পন্থায় মানুষকে বৈষম্যহীনতা এবং স্বাধীনতাকাঙ্খা বাড়ানোর তাগিদ বুঝতে শিখিয়েছেন।
জনযুদ্ধের মাধ্যমে একটি বৈষম্য ও নিপীড়নহীন বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিকামী মানুষ ও বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রের কাছে যে প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাশা করেছিলেন তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রকাঠামোয় ক্ষমতার পালাবদলে অনেক রূপ দেখা গেছে। ফলে দেশে স্থিতিশীল গণতন্ত্র কোনোদিন কার্যকর হতে পারেনি। আমরা সামরিক ও একদলীয় শাসন দেখেছি। দেখেছি নির্বাচিত সরকারের মধ্যেও বৈষম্য কতটা জাঁকিয়ে থাকে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বুদ্ধিজীবীরা যে পরিকল্পনা, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎভাবনা নির্মাণ করেছিলেন এবং জাতিগত চেতনা গড়ে তুলেছিলেন তার বিরুদ্ধে গেছে কোনো কোনো সরকার। এমনকি সংবিধানে উল্লেখিত বৈষম্যহীনতা দূরীকরণের পথ থেকেও সরে গিয়েছে কেউ কেউ। প্রতিবারই জনগণ তাদের উচ্ছেদ করেছে। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক, ন্যায়বিচারিক এবং সাম্প্রদায়িক বৈষম্য এবং সহিংসতা বেড়েছে, তা অসত্য নয়। এ বৈষম্য আমরা আমদানি-রপ্তানী, রেমিট্যান্স আয়, আর্থিক খাত, জিডিপির দিকে তাকালেই অনুধাবন করতে পারবো। দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে এবং সম্পদগত জায়গায়ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু মানবিক উন্নয়ন এবং কাঙ্ক্ষিত সুখী বাংলাদেশের উন্নয়ন ঘটেনি। বঞ্চনা, দারিদ্র, অপরাধ ও জালিয়াতি এবং ধর্ম সহিষ্ণুতার অভাবে সমাজ অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। শিক্ষা ও চিকিৎসা এখন অনেকেই তাদের মৌলিক অধিকার ভাবতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রামের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল তা শেষ হয়নি। হয়নি বলেই পরবর্তী প্রজন্ম তাদের উত্তরসূরীদের ধারাবাহিকতায় জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ আরেকটি গণঅভ্যুত্থান পরিচালনা করে। জুলাই অভ্যুত্থান তাই মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায়। এক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা, সম্ভাবনা ও বাস্তবিকতা যারা দেখিয়েছেন তারাই মূলত এর প্রধান কারিগর। তাদের সেই বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম আজও জাতির কাছে গ্রহনীয় ও আদরে বরণীয়। জাতির কৃতি ও শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হওয়ার একটি সুযোগ আবার আমাদের সামনে এসেছে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তাদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সমাজ-বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়