আবদুন নূর
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৪১ এএম
বুদাপেস্টের হোটেল গ্যালেটের সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯২৬
শহর বুদাপেস্ট যাওয়ার শখ আমাদের অনেকদিনের। যাব যাব করে যাওয়া হয়নি। বুদা ও পেস্ট ইউরোপের দুটো ছোট জনবসতি দানিয়ুব নদীর দুপারে। শতাব্দীর পর শতাব্দী নৌকো ও নানা সেতুর বন্ধনে একটি ঐতিহাসিক শহর গড়ে উঠেছে ক্রমে ক্রমে আপন বিশিষ্টতা ও রোমাঞ্চে। নামের সঙ্গে রয়েছে রহস্য। অজানাকে জানার উদগ্রীব স্পৃহা।
বুদাপেস্ট নাম কেন একত্রিত হলো? কীভাবে এলো। সেসব নিয়ে নানারকম কথা প্রচলিত রয়েছে। তবে একটি গল্প খুব সুন্দর। ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই না করেই লেখকের সৃষ্টিশীল মননের দোহাই দিয়ে ওটা বিবৃত করা যায়। তবে প্রশ্নবিদ্ধ হলে পাঠক নিজেই আপামর গবেষণায় রত হবেন।
দুই
অন্য আরেকটি কারণও ছিল। ভারত উপমহাদেশের বাংলার সমাজ ঘিরে একটি অনবদ্য রচনা লিখেছেন রজা হারনয়ী। তিনি ১৯২৮ সাল হতে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত বাংলায় শান্তিনিকেতনে অবস্থান করেছেন। তিনি তখন একুশ বছরের গৃহবধূ। স্বামী আন্তর্জাতিক খ্যাতি প্রাপ্ত আরবি সাহিত্য ও ইসলাম ধর্মের গবেষক। রবীন্দ্রনাথ তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনায় যোগদান করতে। অধ্যাপক জুলিয়ান জায়ামানাকোস। ভিন্ন ধর্ম ও অসম বয়সের দুজনের মাঝে প্রেম ও বিয়ের কাহিনীও একটি অনবদ্য আখ্যান।
গৃহবধূ রজা হারনয়ী শান্তিনিকেতনে থাকার সময় প্রতিদিনের কথা দিনপঞ্জিতে লিখে রেখেছেন। হাঙ্গেরিতে ফিরে গিয়ে লিখতে শুরু করেন তার স্মৃতিগ্রন্থ। বেঙ্গলী তূর্য। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে। প্রথম মুদ্রণের এক লাখ কপি ছয় মাসে শেষ হয়ে যায়। পর পর পরিসংখ্যান অনুযায়ী পরের সাত বছরে ছয়টি মুদ্রণে সাত লাখ কপি বেঙ্গলী তূর্য তুলে ধরে আদৃতনা হাঙ্গেরির সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক মহলে। কিন্তু লেখিকা সেই সমাদর থেকে যেতে পারেন। ১৯৪৩ তার মৃত্যু ঘটে। কিন্তু থেমে যায় না গ্রন্থ বেঙ্গলী তূর্যের যাত্রা। প্রথম দশ বছর সেই যাত্রার প্রথম ধাপ। ১৯৩২-১৯৮২ দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর সেই যাত্রার পরের ধাপ। দ্বিতীয় ধাপটি সরেজমিনে পরখ করতেও চেয়েছি আমার ভ্রমণকালে। সমৃদ্ধ লেখার যাত্রা কখনও থেমে যায় না। কখনও কখনও থমকে যায়। কখনও কখনও প্রতিহত হয়। কিন্তু সৃষ্টিশীল লেখা বেঁচে থাকে। সময়ের সিঁড়ি ধরে এগিয়ে যায়। কালজয়ী হয়। ‘বেঙ্গলী তূর্য’ সেই বিশ্বাসের দুর্লভ নজির।
তিন.
হাঙ্গেরি ভ্রমণের প্রাক্কালে দেখা হলো ওয়াশিংটনে আয়োজিত ৪র্থ বইমেলায় তার প্রধান উপদেষ্টা রোকেয়া হায়দারের সঙ্গে। বহুকাল হতে তাকে চিনি ও শ্রদ্ধা করি। তিনি ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা সম্প্রচার বিভাগের প্রধান ছিলেন। তার স্বামী হাঙ্গেরির সন্তান। স্বামী-সন্তানসহ নিয়মিত ওরা হাঙ্গেরি ভ্রমণ করেন। অতীব উৎসাহে তিনি উপদেশ দিলেন বুদাপেস্ট শহরের কোথায় কোথায় যেতে হবে। ততোধিক উৎসাহ তার জন্যই দীনার টেক্সট করে জানানো বুদাপেস্টের কোন কোন রেস্তোরাঁয় কোন কোন খাবার উপাদেয়। এমনকি গুগল প্রযুক্তির মাধ্যমে রেস্তোরাঁ ও দর্শনীয় জায়গাগুলোর লোকেশন এবং করণীয় কর্তব্য পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন বিদ্যুতি মাধ্যমে। ওয়াশিংটন বইমেলায় ২০২৩ সালে অপূর্ব আন্তরিকতায় আয়োজিত হয়েছে নেতৃত্ব দিয়েছিল সাংবাদিক দস্তগীর জাহাঙ্গীর, গবেষণাবিদ ডক্টর নজরুল ইসলাম এবং আমার বাল্যবন্ধুর কৃতী কন্যা সামীয়া আমীন। ওরা সম্প্রতি ‘বাংলা কেন্দ্র’ স্থাপনা করেছেন সম্মিলিত প্রয়াসে।
অনুষ্ঠান গভীর রাতে শেষ হলো। বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন রোকেয়া হায়দার। ‘রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যকে অবশ্যই দেখে আসবেন।’ বইমেলার গত বছরের স্মারক গ্রন্থে লিখেছি সেই ভাস্কর্য নিয়ে।
চার.
বুদাপেস্টে আমাদের হোটেল ছিল দানিয়ুব নদীর পোর্ট তীরের ওপরে। জানালা থেকে নদীর প্রবাহিত স্রোতে এবং ওপারের তীরে পুরোনো রাজপ্রাসাদের দীপ্ত প্রদীপমালা দ্বীপান্বিত করে রাখে অনেক পর্যটকের মনন। গভীর রাত পর্যন্ত চলে ওদের নদীতীরে পথচলা। একজন গাইডকে ইংরেজিতে বলতে শুনেছি এই চত্বরে এবং সংলগ্ন সেতুর নিচে বহু ইউরোপীয় ছবির শুটিং হয়েছে। এবং ভারতের বলিউড শিল্পীদের আনাগোনা ইদানীং বৃদ্ধি পেয়েছে। দলবেঁধে সারা রাত জেগে থাকা পথিকের কোলাহল ভোরতক চলে।
গুগল ম্যাপ নির্দেশ করল হোটেলের পেছনের স্কোয়ার পেরিয়ে সরু ধবল পাথরের গলি দিয়ে হাঁটলে একটি পুরোনো বইয়ের দোকান পাব। প্রতিদিন একাকী দু মাইলের ওপর পায়ে হাঁটা আমার ব্রত। আপনমনের পদচারণায় বিবিধ সৃজনশীল ধারণা অনুরণিত হয়। সব ধরে রাখতে না পারলে একটি বা দুটো সূত্র রিন রিন করে বাজে। মন প্রফুল্ল হয়। সকালের নাস্তার পরে বেরিয়ে পড়লাম সেই পুরোনো বইয়ের দোকানের খোঁজে।
সবে দোকান খুলেছেন তিনি। প্রায় সত্তর বা পঁচাত্তর বছরের তরুণের বুদ্ধিদীপ্ত নয়ন। চশমার ফ্রেমলেস লেন্স পরিষ্কার। সাজানো পুরোনো বইগুলো ঝকঝক করছে। নতুন বইয়ের মতো। মনে হলো না ধূলিগাঁথা পুরোনো বইয়ের দোকান হবে। তবু আশ্বস্ত হলাম। অভিজ্ঞ এই মানুষটির কাছে খবর পাওয়া যাবে। তথ্য মিলবে। জানালাম আমি ‘বেঙ্গলী তূর্জ’ গ্রন্থের পুরোনো একটি কপি খুঁজছি। মাগার ভাষায়।
প্রশ্ন শুনে অবাক হলেন। ভাঙা ইংরেজিতে অনুরোধ জানালেন ‘লিখে দিন আপনার প্রশ্ন। আমার ইংরেজি দুর্বল।’
আমি লিখে দিলাম তার এগিয়ে দেওয়া ছোট চিরকুটে।
চিরকুট পড়ে তিনি এক ঠায় আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমারও বয়স কম হয়নি। আল্লাহর রহমতে তিরাশিতে পা দিয়েছি।
‘রজাকে হাঙ্গেরির মানুষ ভুলে গেছে। হারিয়ে ফেলেছে। আধুনিক সাহিত্যের হালকা জোয়ারে গভীর সাহিত্য খালের পাড়ে পাড়ে জমছে। পচে যাচ্ছে।’ তিনি ভাঙা ইংরেজিতে বেদনার কণ্ঠে আমাকে জানান। ‘উনিশশ পঞ্চাশ দশকের প্রিয় লেখিকা এখনও নাকি জীবিত?’
আমি স্বীকার করি। প্রতিটি লেখক-লেখিকার লেখার আকর্ষণ স্বল্পকালীন সময়ের জন্যে। কিন্তু কিছু কিছু রচনা কালজয়ী হয়। যেমন টলস্টয়, শেক্সপিয়ার। রজা হারনয়ী সেই স্তরের লেখিকা নন। সেই মাপের নন।
জিজ্ঞেস করি অধ্যাপক জারমানসের কথা। ইসলামের ওপর তার গবেষণা গভীর এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃত। কোথায় পেতে পারি তার গবেষণালব্ধ রচনাবলি। অবশ্য তার রচনা একাডেমিক মহলে আদৃত হওয়ার কথা। পাওয়ার কথা।
‘আন্তর্জাতিক মহলে তার পরিচিতি এখনও রয়েছে। ওর লেখা বইপত্র প্রযুক্তির মাধ্যমেই খুঁজে পাবেন। আন্তর্জাতিক ভাষা ও অনুবাদের মাধ্যমে।’ জানালেন তিনি।
‘এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডলে তাকে অনুসন্ধান করুন। নিশ্চয়ই খুঁজে পাবেন।’ কথাটা সত্য।
“ইচ্ছা ছিল রজার ‘বেঙ্গলী তূর্যের’ একটি পুরোনো সংস্করণ সঙ্গে নিয়ে যাব। সুভ্যেনির হিসেবে।”
কিছুক্ষণ ভাবলেন ভদ্রলোক। পরে খস্ খস্ করে একটি ঠিকানা লিখলেন।
‘রজার আদি গ্রামে একটি পুরোনো বইয়ের লাইব্রেরি আছে। এ ছাড়া ওই গ্রামে প্রতি রবিবার সকাল দশটায় মেলা বসে। নানা অঞ্চলের লোকজন নিয়ে আসেন পুরোনো চিত্রকলা, হ্যান্ডিক্র্যাফটস, আর্টিফেক্টস। বেশি দূরে নয়।
হয়তো বিশ বা তিরিশ কিলোমিটার। ওখানে খুঁজলে কারও না কারও স্টলে বা ঘরে পেলেও পাবেন।’ আমি চিরকুটটি পকেটে রাখি। ধন্যবাদ জানাই। ‘রজার যেখানে এখন আছেন, সেখান হতে আমাদের এই ধরাভূমিকে দেখতে পেলে, আপনার অনুসন্ধিৎসায় অবশ্যই প্রসন্ন হবেন। সার্থক হয়েছে তার লেখা।’
ভদ্রলোক জানালেন।
‘আমার শুভ কামনা আপনার প্রতি।’
মাথা ঘুরিয়ে বেরিয়ে এলাম।
পাঁচ
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ! ফিরে আসতে আসতে মনে এলো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাকে কোনো প্রশ্ন করিনি। রবীন্দ্রনাথ কি হাঙ্গেরির মননে এখনও সযত্নে রক্ষিত নয়। হাসি পেল। নিজ দেশের লেখিকা রজারকে হাঙ্গেরির প্রজন্ম মনে রাখেনি। বিদেশি কবি রবীন্দ্রনাথ প্রায় একশ বছর আগে ১৯২৬ সালে দু সপ্তাহের জন্য হাঙ্গেরি ভ্রমণ করেছিলেন। বিশাল অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন। সেই যুগে। সেই সময়ে। আজকে রবীন্দ্রনাথ ওদের স্মরণে থাকবে কেন?
মন জয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি খ্যাত হলেন হাঙ্গেরির জনসাধারণের কাছে ‘পূর্ব দিকের উদিত সূর্যের ঋষির রূপকে।’ কারণ ছিল। তিনি তার প্রবন্ধ কথা ও কর্মের মাঝে চেয়েছিলেন পূর্ব ও পশ্চিমের সভ্যতার সঙ্গে ক্রমবৃদ্ধিমান আদর্শিক বিভেদকে বিমোচন করবেন। প্রতিটি সভ্যতার সনাতনী মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটিয়ে।
পরস্পরের মাঝে আলোচনা ও সমঝোতার মাঝে। তিনি চেয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল আরবীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ যেন পশ্চিমি উপনিবেশকারীদের শক্তিতে নিষ্পেষিত না হয়। উপেক্ষিত না হয়। বরং সকল রূপায়িত হয়। তিনি চেয়েছিলেন স্পেনের কর্ডোভা শহরের মতো একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবে বাংলার মাটিতে। সৃষ্টি করবে বহু সংস্কৃতি, জাতি ও ধর্মের মিলনক্ষেত্র। শান্তিনিকেতন গ্রামে ক্রমে গড়ে উঠবে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী। ১৯২৬ সালে তার ইউরোপ ভ্রমণ আয়োজিত হলো সেই উদ্দেশ্য সাধন প্রয়াসে।
নোবেল বিজয়ের পরপরই রবীন্দ্রনাথ ক্রমান্বয়ে হাঙ্গেরির বিদগ্ধ মহলে আদৃত নাম হয়ে ওঠেন। গীতাঞ্জলি অনূদিত হয় ১৯২০ সালে। পোর্ট অফিস অনূদিত হলো ১৯২২ সালে। ঘরে বাইরে প্রকাশিত হলো ১৯২৪ সালে নায়িকা ‘বিমলা’ নামে। উচ্ছলতা রবীন্দ্রনাথের জন্যে উপচে পড়ল।
রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করলেন ‘মানুষ সৃজিত হয়েছে এবং প্রতিটি মানুষ সৃষ্টি করেছেন মহান সৃষ্টিকর্তা। সেই মানুষের বিনাশ ঘটবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা অবিনশ্বর। এবং মানুষ্য জাতি পৃথিবীতে দাসত্বের জন্যে নিবেদিত হয়নি। নিবেদিত হবে না। বরং নিবেদিত হবে পৃথিবী এবং তার প্রতিটি অংশকে ভালোবাসায়। শ্রদ্ধায়।’
ছয়.
হোটেল টাগোর। লেক বালাটন ফোর শহরে। লেকের ওপর সুন্দর ছোটখাটো হোটেল। হয়তো তিন তারকা হবে। রিসেপশন উল্টোদিকে। তর তর করে ঢুকে গেলাম। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি তুমুল আগ্রহে উঠে দাঁড়াল। মনে হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সামার জব করছে।
‘তুমি কি রুম চাইছ লেকের পাড়ে?’ প্রথমে মাঞ্চেরি ভাষায় জানতে চেয়ে, অল্প পরেই ভাঙা ইংরেজি ঘুরে এলো। ‘আজ রাতে লেকের পাড়ের রুম খালি নেই।’
‘আমি জানতে চেয়েছি টাগোর ভাস্কর্যটি কোথায় আছে? থাকতে আসিনি। শুধু দেখতে এসেছি।’ আমি জানাই।
‘টাগোর কে?’ নির্মল প্রশ্ন তার।
‘বুঝতে পারছ না। যার নামে তোমার এই হোটেলের নাম রেখেছ হোটেল টাগোর।’
‘টাগোর তাহলে মানুষের নাম? আমি ভেবেছিলাম ইউরোপের কোনো একটি শহরের নাম। যেমন ধরো ভেনিস বা বার্সেলোনা।’ রিসেপশনিস্ট সরল মনে বলে।
‘টাগোর হলেন একজন কবি। বাংলার কবি। তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রায় একশ বছর হলো।’
‘মনে হচ্ছে তার কথা স্কুলে পড়েছিলাম। ঠিক খেয়াল করতে পারছি না।’ মেয়েটি চিন্তিত চোখে বলে। ‘সেই কারণেই তোমাদের মতো ভারতীয় আমাদের হোটেলে থাকতে আসে।’
‘আমি বাঙালি। আমার দেশ বাংলাদেশ।’ আমি ওর কথা শুধরে দিই। ‘তোমার কখনও মনে হয়নি টাগোর কে? হোটেলটি টাগোরের নামে হলো কেন?’
‘আমি ধরে নিয়েছি রাস্তার ওপাশেই টাগোর প্রমোনড। সেই কারণেই হোটেলের নাম হোটেল টাগোর।’
‘টাগোরের কি কোনো ছবি আছে তোমার হোটেলে? তিনি কি এখানে থেকেছিলেন একশ বছর আগে।’
‘বুঝতে পারছ না হোটেলটি সবে নতুন বানানো হয়েছে। হয়তো বছর কুড়ি হবে। ম্যানেজমেন্টকে জিজ্ঞেস কর। ওরা হয়তো বলতে পারবে কেন হোটেল টাগোর নাম হয়েছে। আমি টাগোরের কোনো ছবি আমার হোটেলে দেখিনি। আমি জানতাম না বাংলাদেশের এক নামি কবির নাম টাগোর।’
‘তবে টাগোরের ভাস্কর্য কোথায় রয়েছে বলতে পার?’
‘ওই ভারতীয় কবির ভাস্কর্য আছে প্রসেনডে? আমি জানতাম না।’ মেয়েটি সরল হাসে। ‘তুমি খুঁজে পেলে আমাকে জানিয়ো। আমিও শ্রদ্ধা জানিয়ে আসব ভারতীয় কবিকে।’
‘তিনি বাংলার কবি। তিনি বাঙালির কবি। তিনি বাংলাদেশের কবি। তিনি ভারতের কবি। তিনি এই ধরায় অবস্থিত ৩৫ কোটি বাঙালির কবি।’ আমি প্রবল আবেগে বলি তাকে। সে আমার অনুভূতি অনুধাবন করতে না পারলেও বেরিয়ে আসি আমি।
সাত
গাইড আদন গাড়ি পার্ক করে অপেক্ষা করছিল। জায়া নাজমা একাগ্র মনে লেকের পানে তাকিয়েছিল।
‘আমাদের খুঁজতে হবে প্রসেনডের পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরে। দুপুর একটা হয়েছে। বেশ গরম পড়েছে। কিন্তু পেয়ে যাব।’
লেককে বাম দিকে রেখে আমরা মৃদু পায়ে এগিয়ে যাই নুড়ি মেলে দেওয়া সরু হাঁটা পথ ধরে। বাম দিকে লেকের পাশ ঘিরে অনেকগুলো বিপণি গড়ে উঠেছে। হস্তশিল্প, পাশে রেস্তোরাঁ ও নানারকম পর্যটক প্রয়োজনীয় সামগ্রী। ডানদিকে সবুজ লনে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য গাছ। এবং মাঝে মাঝে মাটিতে গ্রথিত রয়েছে নানা নামের মাইলফলক। এবং কোথাও আবার পাথরের বেদিতে রক্ষিত ভাস্কর্য। প্রতিটিতে নাম আছে। বর্ষফলকও আছে কয়েকটিতে।’
‘এই পথ ধরে এগিয়ে গেলে নিশ্চয়ই আমরা রবি ঠাকুরকে পাব।’ নাজমা বলে।
‘প্রমেনেড্টি বেশ সরু। লম্বায় দু মাইলের ওপরে হবে। হাঁটতে পারবে?’
‘দেখতে এসেছি যখন, তখন হাঁটতেই হবে। মাঝপথে না দেখে চলে যাব।’ জানালেন তিনি।
কিন্তু অর্ধেক পথ পেরিয়ে এসেছি। চলতে চলতে পথে পড়েছে নানা নামফলক।
আমরা ডানপাশে অনুসন্ধিৎসু চোখ রেখে এগিয়ে যাই। কোথায় রবীন্দ্রনাথ অপেক্ষা করছেন ধৈর্য ধরে?
‘দ্যাখো দ্যাখো। উল্টো পথে আমাদের দিকে আসছে ছোট একটি দল। দুটো ছেলে। দুটো মেয়ে। ওদের সবার হাতে সংগীত যন্ত্র। সংগীতপ্রিয় ওদের কাছে নিশ্চয়ই রবি ঠাকুরের খোঁজ পাব।’ আমি গভীর উৎসাহে মন্তব্য করি।
হাত বাড়িয়ে ওদের দাঁড় করিয়ে দিই।
‘বলতে পারবেন রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য এখানে কোথায় আছে?’
‘উনি আবার কে?’ মেয়েটি প্রশ্ন করে।
‘আমরা বুদাপেস্ট থেকে এসেছি। আগামীকাল এখানে মিউজিক ফেস্টিভ্যাল হবে। এই টাগোর প্রমেনেডে। প্রতি বছর আসি। এবারেও এসেছি।’ সঙ্গের যুবক বন্ধুটি বলে।
‘গত তিন বছর ধরে আমাদের ব্যান্ড আসছে। আমরা গান করি। হাঙ্গেরির প্রাচীন গানগুলো যন্ত্রে তুরে ধরি। প্রচুর দর্শক আমাদের প্রশংসা করে। ধৈর্য ধরে শোনে।’ অন্য যুবকটি বলে।
‘তোমরা কারও একজনের খোঁজ করছিলে? নামও বলেছ। কে সে?’ অন্য মেয়েটি জানতে চায়।
‘তোমাদের এই প্রমেনেডের নাম কার নামে হয়েছে জান?’
ওরা যুগপৎ মাথা নাড়ে।
‘তিনি রবীন্দ্রনাথ টাগোর। তিনি সংগীতের সাধক ছিলেন। শত সহস্র সংগীত তিনি রচনা করেছেন। তিনি বাংলার কবি। তিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন একশ বছর আগে। আমরা জেনেছি এই প্রমেনেড তার নামে হয়েছে। এবং তার একটি ভাস্কর্য এই প্রমেনেডে স্থাপিত হয়েছে। সেটি আমরা খুঁজছি।’
‘তিন বছর ধরে আমরা আসছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ছাত্র। অথচ নোবেল বিজয়ী এই কবির নাম আমরা শুনিনি। সংগীতজ্ঞ হয়েও।’
‘পাবে ইউটিউবে ট্যাগোর ইংরেজিতে খুঁজবে।’ আমি জানাই।
আমি আমাদের পথ ধরতে উদ্যত। ওরা সময় দিতে পারবে না।
‘ইনিই কি তিনি? আমরা জানি উনি ঋষি।’ মেয়েটি তার মোবাইল তুলে ধরে।
‘উনি ঋষি এবং সংগীত রচয়িতা। তোমরা ওর গান অনুসরণ কর।’ আমার কথায় প্রচ্ছন্ন রুক্ষতা।
আমি দ্রুত হাঁটতে শুরু করি। গিন্নি ততক্ষণে শত ফুট এগিয়ে গেছেন। তার ত্বরা নেই। কিন্তু অনুসন্ধান স্পৃহা তার তৎপর হয়েছে। দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে দীনারকে টেক্সট করলাম।’ কোনো খোঁজ কবির এখনও পাইনি।
‘তুমি অত কথা সবার সঙ্গে বল কেন? আমি জানতাম ওরা জানবে না।’ জায়া অনুযোগ করেন।
নাজমা ডান হাত ডান দিকে বাড়িয়ে দিল। ‘দ্যাখো ওখানে বড় বড় গাছ রয়েছে। মালার মতো। ওখানেই থাকবে ভাস্কর্য মনে হয়।’
তিনি দ্রুত এগিয়ে যান। তার পিছু ধরি। পরক্ষণেই তিনি সটান ফিরে দুহাত দিয়ে আমাদের হাতছানি দিতে থাকেন। ‘পেয়েছি। তাকে পেয়েছি। এসো। এসো।’
উত্তেজনা জড়ানো তার মধুর সফলতার মৃদু হাসি। পরক্ষণেই মোবাইল ফোন টিং করে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যের পাশে দাঁড়িয়ে ওর মা।
৮.
ইউরোপ ভ্রমণে তিন মাসের পরিকল্পনা নিয়ে ১৯২৬ সালে কবি এলেন ইউরোপ। বয়স তার এখন ৬৫ বছর। চার-পাঁচটা দেশে তার আমন্ত্রণ রয়েছে। সাংগঠনিক এবং সাংস্কৃতিক। জার্মানি। অস্ট্রিয়া।
কবির সুপ্ত ইচ্ছা তিনি হাঙ্গেরি পরিদর্শন করবেন। ১৯২০ সালের ভ্রমণে বার বার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন সুধী মহল হতে। কিন্তু এবারে তা হয়ে ওঠেনি। ইংল্যান্ডের একটি বাণিজ্যিক প্রকাশনা সংস্থা প্রস্তাব দিয়েছে ইউরোপ থাকাকালীন তারা হয়তো বুদাপেস্ট শহরসহ তিন-চারটা দেশে বক্তৃতা সফরের আয়োজন করতে পারে। সম্মানীর বিনিময়ে রবীন্দ্রনাথ পাবেন ৪০০ ডলারÑ চারটি বক্তব্যের জন্যে। প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন কি যখন তিনি ভাবছেন তখন হঠাৎ আমন্ত্রণ এলো হাঙ্গেরির মহিলা সমিতি থেকে। কবির ইচ্ছার কথা হয়তো রটে গিয়েছিল হাঙ্গেরির সাংস্কৃতিক মহলে। প্রায় সমসময়ে এলো আমন্ত্রণ বুদাপেস্টের মেয়রের পক্ষ হতে। সকল খরচ বুদাপেস্ট কর্তৃপক্ষ বহন করবে। সময় অক্টোবরের প্রথম দিকে।
গৃহবধূ রজা হারনয়ী শান্তিনিকেতনে থাকার সময় প্রতিদিনের কথা দিনপঞ্জিতে লিখে রেখেছেন। হাঙ্গেরিতে ফিরে গিয়ে লিখতে শুরু করেন তার স্মৃতিগ্রন্থ। বেঙ্গলী তূর্য। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয়
কবির শরীর ভালো যাচ্ছিল না। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। দুই মাসের ওপরে ইউরোপে ছুটছেন। শহর থেকে শহরে। গ্রাম থেকে গ্রাম। বক্তৃতা দিচ্ছেন। কথা বলছেন অসংখ্য অনুরাগীর সঙ্গে। মাঝে তুষার পড়ল। অভিভূত হলেন কবি ও সফরসঙ্গীরা। কিন্তু বুদাপেস্ট যাত্রা প্রশ্নবিদ্ধ হলো। বার বার প্রস্তাবিত তারিখ পিছিয়ে গেল। হাঙ্গেরির কয়েক সুধী বিরক্তি প্রকাশ করলেন। সত্তর বছরের বৃদ্ধ কবি সুদূর পূর্বদেশের অপরিচিত ভাষায়। বারে বারে অসুস্থ হচ্ছেন। ডাক্তার দেখছে। ভক্তগণ ধৈর্যের অপেক্ষা করেও আর দেখা পাচ্ছে না। কীসের প্রত্যাশায় তিনি ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছেন।
অবশেষে কবি ভিয়েনা হতে ট্রেন ধরলেন বুদাপেস্টের পথে। সফরসঙ্গী হলো তার ব্যক্তিগত সহকর্মী মহলানবিশ, তার স্ত্রী রানী মহলানবিশ, জনৈকা জার্মান ব্যারোনেস।
ব্যারোনেস প্রথমে তার নাম প্রকাশ করার সম্মতি দান করেননি। তিনি ইউরোপের প্রথিত ভাস্কর। প্যারিসে স্টুডিও ছিল ১৯১৮ সালে। ইউরোপের অভিজাত মহলে তার অবারিত যাতায়াত। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় হয় সম্ভবত লন্ডনে থাকাকালীন। নিয়মিত পত্রালাপ হতো। তিনি অভিলাষ করেছেন শান্তিনিকেতনে নব প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভাস্কর্য শিক্ষা দেবেন। এবং সঙ্গে বাংলা ও সংস্কৃত শিখবেন। হাঙ্গেরি ভ্রমণকালে তিনি ইন্টারপ্রেটার হতে পারেন।
কবির তুমুল উৎসাহ। তিনি প্রফুল্ল। কিন্তু রানী মহলানবিশের প্রতি কবির হঠাৎ রাগ এলো। ছোট একটি কারণ। শীত সহ্য করতে পারতেন না রানী। একটি সবুজ রঙের রেইনকোট কিনেছিলেন ইউরোপে। কবির সেটা পছন্দ ছিল না। তিনি বললেন রানী যেন সেই রেইনকোট পরে রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে না নামে। হাঙ্গেরির মেয়েরা সাজতে ভালোবাসে। এবং সুন্দর সাজে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কেন বাংলার তনয়াকে দৃষ্টিকটু পরিধানে পরিচিত হতে দেবেন? বাংলার নারী বাংলার রূপ ও পরিধানকে প্রকাশ করবে। দারুণ শীত। রানী মহলানবিশ প্রথমে শীতের ভয়ে রাজি হলেন না। রবীন্দ্রনাথ স্বামীকে তিরস্কার করলেন। তোমার স্ত্রীকে বোঝাও। অবশেষে রানী মেনে নিল।
রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম লোকে লোকারণ্য। সবাই কবিকে স্বাগত জানাতে এসেছে ফুলের স্তবক নিয়ে বা তার প্রকাশিত বই। ওদের পরিচ্ছদ মার্জিত। হয় চার্চে যাওয়ার বা বিয়েতে যোগ দেওয়ার ফরমাল ড্রেস। অপেক্ষমাণ সহস্রাধিক স্বাগতিক ধৈর্য ধরে প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছে। কবি রেলিং ধরে ধীরে নামলেন।
ফুলের স্তবক হাতে ধরে প্রথমেই অভ্যর্থনা জানাল জনৈকা হাঙ্গেরির যুবতী। মহিলা সমিতির পক্ষ হতে নোবেল বিজয়ীকে কাছে দেখতে পেয়ে উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপছে। ফরাসি ভাষায় তার স্বাগত বক্তব্য ছিল। অভিভূত তরুণী ওর বক্তব্য ঠিকমতো দিতে পারছিল না। কবি নিজেই এগিয়ে এসে সেই ফুলের স্তবক ওর কম্পিত হাত হতে গ্রহণ করলেন।
শুরু হলো কবির অতি প্রত্যাশিত হাঙ্গেরির সফর। প্রথম পাঁচ দিন নানা অনুষ্ঠান ঠাসা রণনে সমৃদ্ধ।
অনুষ্ঠানসূচিতে নানাবিধ অনুষ্ঠান। তিনি হাঙ্গেরির লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের সঙ্গে একক দেখা করবেন। তিনি পাঠকদের জন্যে তার প্রাসাদতম হোটেলের দোর অবারিত করবেন। ওদের কেনা বইগুলোতে স্বাক্ষর দেবেন। তিনি থিয়েটারে যাবেন জিপসি সংগীত শুনতে। তদানীন্তন জিপসি সংগীতে সম্রাট স্বয়ং গান পরিবেশন করবেন। তিনি ভারতীয় দর্শনের ওপর হাঙ্গেরীয় বুদ্ধিজীবীদের কাছে তার মতামত উপস্থাপন করবেন। তিনি তার আকাঙ্ক্ষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতীর আদর্শ ও আকাঙ্ক্ষিত শিক্ষাক্রম হাঙ্গেরির সুধী মহলে উপস্থাপন করবেন। কবি হাঙ্গেরির বিদগ্ধ মহলে ঘোষণা দিলেন।
বিশ্বভারতীর অবদান হবে বিশ্বজুড়ে শান্তি এবং গ্রাম উন্নয়নের পথ অন্বেষণ।
(বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়)