শ্রদ্ধা
হোসেন আবদুল মান্নান
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:০২ পিএম
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:০৪ পিএম
নীরদচন্দ্র চৌধুরী, ২৩ নভেম্বর, ১৮৯৭-১ আগস্ট, ১৯৯৯
উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলাভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ভুবনে যে ক'জন ক্ষণজন্মা তুখোড় লিখিয়ে এবং মৌলিক চিন্তকের আবির্ভাব ঘটে, নীরদচন্দ্র চৌধুরী এঁদের অন্যতম। আলোচনা-সমালোচনা, তর্কে-বিতর্কে, পাণ্ডিত্যে ও অহংকারে ভরপুর ছিল, তাঁর এক শতাব্দীর অধিক জীবনকাল। ১৯৫১ সালে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই The Autobiography of An unknown Indian । ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত তাঁর অসংখ্য রচনায় উঠে এসেছে বাংলা, বাঙালি, সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ, ভূগোল, সঙ্গীত সর্বোপরি বাংলার নিসর্গ ও প্রকৃতি।
মাতৃভূমি
ও বাঙালির যে স্বপ্নচিত্র তিনি নীরবে এঁকে গেছেন তার তুলনা হয়না।
নীরদ চৌধুরীর মতো বহুমাত্রিক প্রতিভাকে নিয়ে লেখা সহজ কাজ নয়। তবে একই মাটি ও জনপদে জন্মগ্রহণ করা মানুষ হিসেবে তথা তাঁর বিভিন্ন রচনা পাঠ করে জন্মভূমির প্রতি তাঁর অপরিসীম অনুভূতি প্রকাশের অনুপম ভাষাশৈলী অনেকের মত আমাকেও খানিকটা দায়বদ্ধ করে। কিশোরগঞ্জবাসীসহ দেশের আজকের প্রজন্মের কাছে তাঁকে কিঞ্চিৎ পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মনোবাঞ্ছা থেকেই এ আলোচনা।
দুই.
১৮৯৭
সালের ২৩ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ শহরের খরমপট্টিস্হ সরকারি পুকুর পাড়ের এক নামকরা বাড়িতে তাঁর জন্ম। বাবা উপেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী
ময়মনসিংহ থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে মোক্তারি পড়েন এবং ১৮৯৪ সালে কিশোরগঞ্জ মহকুমা
শহরে মোক্তারি পেশায় যোগ দেন। নীরদ চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, তাঁর বাবা ফৌজদারি মোকদ্দমার জন্য বেশ ভালো মোক্তার
ছিলেন। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার বনগ্রামে তাঁর পূর্ব পুরুষদের ভিটেবাড়ি।
তাঁর
আত্মজীবনীতে বর্ণিত আছে,
১৯০০ সাল থেকে ১৯২৩ সাল
পর্যন্ত সময়ে পূজা-পার্বণ ও নানাবিধ সামাজিক আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে যোগ দিতে একাধিকবার তিনি বনগ্রাম এসেছেন। বনগ্রামে তাঁর পরিবার স্কুল ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর লেখায় বারবার এসেছে
কিশোরগঞ্জ, বনগ্রাম, সরাইলের
কালিকচ্ছ, ব্রাহ্মণপাড়া (মামার বাড়ি) আর কলকাতা শহরের
রূপবৈচিত্র্য।
নীরদ
চৌধুরীর ১০০ বছর বয়সে লেখা 'আজি হতে শতবর্ষ আগে' বইয়ে তিনি নিজের
জন্মশহর কিশোরগঞ্জ, তৎকালীন গ্রামীণ জীবন, প্রকৃতি,
মানুষের জীবিকার যে
চিত্রকল্প তুলে ধরেছেন তা পড়ে বিস্মিত হতে হয়। এমনকি বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, মানুষ কখনো তার শেকড়কে, তার
জন্মসূত্রকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না।
এ
প্রসঙ্গে তাঁর বই থেকে উদ্বৃত বাক্যসমূহ--
‘বড় হইয়া নিজেকে জিজ্ঞাসা করিতে আরম্ভ করিলাম, সত্যিই কি বাংলাদেশের কোনও নৈসর্গিক সৌন্দর্য আছে? একদিন বিকালে বেড়াইবার সময়ে কিশোরগঞ্জ শহর হইতে রেললাইন
ধরিয়া মাইল কয়েক উত্তর দিকে যাইবার পর একটা জলেডোবা ধানক্ষতের ওধারে একটা
বাস্তুভিটা দেখিতে পাইলাম। মাঝখানে একটা পুকুর। তাহার উঁচু পাড়ের উপর ছয়-সাতটা
আটচালা। উল্টাদিকে বাঁশের ঝাড়। স্থির নিস্তরঙ্গ জলে আটচালার স্পষ্ট ছায়ার সন্মুখে নীল আকাশ ও সন্ধ্যার
রক্তিম মেঘের প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে। সমস্তটা কনস্টেবলের ছবির মত। তখনই বুঝিলাম, বাংলাদেশেরও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে। উহার দিকেও মুখ
ফিরাইয়া মুগ্ধনেত্রে চাহিয়া থাকিতে হইবে। এই নূতন দৃষ্টি ফিল্ম-স্টারের রূপ হইতে চোখ ফিরাইয়া ঘরের
মেয়ের রূপ দেখার মতন"।
তিনি বাংলার-রূপ জলে, বাংলার-রূপ স্থলে, বাংলার-রূপ মনে এবং প্রেমে ইত্যাদি শিরোনামে লিখেছেন। বলেছেন, "নদী, জল, উন্মুক্ত উদার নীল আকাশ, কাজল কালো বা মরালশুভ্র মেঘ বাঙালী জীবনে প্রাণের অবলম্বন। ইহাদের ছাড়িয়া জীবন্ত বাঙালী কল্পনা করা যায় না"।
তিন.
নীরদ সি. চৌধুরীকে নিয়ে গল্পের কোন শেষ নেই। ১৯৫১ সালে ইংরেজিতে লেখা দু'খন্ডে আত্মজীবনী প্রকাশিত হাওয়ার পর তিনি আরও ৪৮ বছর বেঁচে ছিলেন। আত্মকথা লেখার ইতিহাসে এটা এক বিস্ময়কর ঘটনা। মজার ব্যাপার হলো, মৃত্যুর আগেই তিনি দেখে গেছেন, তাঁর The Autobiography of An unknown Indian শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের তালিকায় স্থান পেয়েছে। ১৯৮৮ সালে ডেইলি টেলিগ্রাফ লিখেছিল, 'মানুষ যতদিন বই পড়বে, ততদিন তাঁর দু'খণ্ড আত্মজীবনীর পাঠকের অভাব হবে না'। তিনি নিজেই বলেছেন, "১৯৩৭ সালের পর আমি আর বাংলায় লিখি নাই। কারণ বাঙালীদের জন্য লিখে লাভ নাই তারা কোন সাড়া দিতে জানে না। এই জন্যই ইংরেজিতে লিখা শুরু করি। তবে ১৯৬৫ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্রের অনুরোধে শিল্পী নন্দলাল বসুকে নিয়া লিখিতে গিয়া আবার বাংলায় ফিরিয়া আসি। এবং ১৯৬৭ সালে আমার প্রথম বাংলা বই 'বাঙালী জীবনে রমণী' প্রকাশ করি "। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে দশটি ইংরেজিতে এবং পাঁচটি বাংলায় সর্বাধিক আলোচিত হয়েছে- আত্মজীবনী ব্যতীত, 'দাই হ্যান্ড গ্রেট এনার্ক', 'আ প্যাসেস টু ইংল্যান্ড', ‘ম্যাক্সমুলার ও ক্লাইভের জীবনী’, 'দি কন্টিনেন্ট অব সার্সি’, ‘হিন্দুইজম, দি ইন্টেলেকচুয়াল ইন ইন্ডিয়া’, ‘কালচার ইন দি ভ্যানিটি ব্যাগ’, ‘ত্রি হর্সম্যান অব দ্য নিউ অ্যাপোক্যালিপস’ ইত্যাদি। তাঁর বাংলা বইয়ের মধ্যে- বাঙালী জীবনে রমণী, আত্মঘাতী বাঙালী, আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, আমার দেবোত্তর সম্পত্তি, আমার দেশ আমার শতক, আমি একাধারে বাঙালী ও ইংরেজ, জীবনের কাহিনী, আমি সাম্রাজ্যবাদী কেন, ইত্যাদি।
চার.
জ্ঞান-গরিমায়, বিদ্যায় বুদ্ধিতে,
সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতায়
যে সকল লেখক শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিশ্বব্যাপী ঝড় তুলেছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে
যাঁরা দীর্ঘ জীবন
পেয়েছেন, জর্জ বার্নার্ড শ ৯৬ বছর, ব্রার্টান্ড
রাসেল ৯৮ বছর, পিকাসো ৯২ বছর, অন্নদাশঙ্কর রায় ৯৭ বছর, খুশবন্ত
সিং ৯৯ বছর। তুলনা করলে নীরদচন্দ্র চৌধুরী প্রাণশক্তিতে আরও বেশি এগিয়ে ছিলেন।
তর্কে বিতর্কে আলোচনায় তিনি ১০২ বছরের মহাজীবন পান।
মাত্র
৪৮ বছর বয়সেই তিনি পুরোপুরি দন্তহীন। চশমা চোখে আরও অনেক আগে। নিজেই বলেছেন," আমার উচ্চতা পাঁচ ফুট আধ ইঞ্চি, ওজন এক মণের সামান্য উর্ধ্বে, সারাজীবন ধরিয়া দেহ হাড়-জিরজিরে কৃষলাশের মতো"। মেঝেতে বসে লেখার অভ্যেস করেছিলেন।
স্বাস্থ্য খারাপ বলে বিজ্ঞাপন দেখে 'সেন্টোজেন' খেয়েছিলেন।
যদিও এতে ফল পাননি। স্বাস্থ্য কোন দিনই তাঁর ভালো ছিল না। অনেকে মনে করেন, এটাই হয়তো আশীর্বাদ ছিল।
তাঁর
সম্পর্কে লেখক ও গবেষক শ্রীপান্থ বলেছেন, ‘কখনো
কখনো স্ববিরোধিতা, কখনো রক্ষণশীলতা এবং প্রায়শ বিশেষ থেকে
সামান্যে পৌঁছবার জন্য বিপদজনক প্রবণতা স্বত্বেও বলবো, নীরদ চৌধুরী একালের এক আশ্চর্য বাঙালি ভাবুক। তাঁর
পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা শুধু প্রসারে দিগন্ত বিস্তৃত নয়,
দৃষ্টি ভঙ্গিতে গভীর এবং
কখনো কখনো তির্যক। চলমান ইতিহাসে অসংখ্যের ভিড়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে তিনি নিতান্ত
দর্শক। কিন্তু এক অসাধারণ মনোযোগী দর্শক।’
সাংবাদিক ও লেখক খুশবন্ত সিং বলেন- ‘তিনি এমন একজন যাকে আমি বুদ্ধিজীবী বলবো। কারণ তাঁর জীবৎকালে তাঁর সমকক্ষ মানুষ আমি আর দেখি নি। জীবনে অনেক কঠিন সময় তিনি মোকাবেলা করেছেন। এক সময় কে.কে. বিড়লা তাঁর অভাবের খবর পেয়ে তাঁকে ভাতা দিতে চেয়েছিলেন যে কোন অংকের। তিনি তা প্রত্যাখান করেন "।
পাঁচ.
নীরদ চৌধুরীর স্ত্রী অমিয়া চৌধুরানী তাঁর পূর্বেই প্রয়াত হয়েছেন। ৬২ বছরের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন শেষে ১৯৯৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এঁদের তিন ছেলে ধ্রুব নারায়ণ চৌধুরী, কীর্তি নারায়ণ চৌধুরী ও পৃথ্বী নারায়ণ চৌধুরী। ১৯৩২ সালে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেছিলেন। ছেলেদের নামের সঙ্গে বনগ্রামের পূর্ব পুরুষের নামের অংশ 'নারায়ণ' যুক্ত করে দিয়েছিলেন। নিজের নাম ও ভাইদের নামে 'চন্দ্র' ছিল। বিয়ের পরে একদিনের জন্যও স্ত্রীকে হাতছাড়া করেননি। তাঁর লেখালেখির জীবন স্ত্রী'র জন্যই সফলতা পেয়েছে। অনেক সময় স্ত্রী তাঁর লেখা টাইপ করেও দিয়েছেন। এটা তাঁর নিজের ভাষ্য।
নীরদচন্দ্র
চৌধুরী ভারতীয় রাজনীতি ও ভারতবর্ষে ইংরেজ এবং ব্রিটিশ
শাসন নিয়েও নানা মত, অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিশেষ করে তাঁর 'আমার দেশ আমার শতক'
গ্রন্থে তিনি স্মৃতিচারণমূলক অনেক মন্তব্য করেছেন। ভারতবর্ষের
স্বাধীনতা আন্দোলন ও পূর্বাপর ঘটনাবলী তিনি কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি
১৯২১ সালে প্রথম কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ইতিহাস নিয়ে অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম
স্থান পেয়েও আর্থিক কারণে নানাবিধ কর্মে যুক্ত
হতে হয়েছিল তাঁকে। তবে একটানা বেশি দিন কোথাও চাকরি করেননি।
১৯৩৭
সালের জুলাই মাসে তিনি বিখ্যাত বাঙালি নেতা ও অবিভক্ত বাংলার অন্যতম প্রধান
ব্যক্তি শরৎ বসুর একান্ত সচিব হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। নেতাজি সুভাষ বসু'র
অগ্রজের একান্ত সচিব থাকায়
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মূল কুশীলবদের তিনি
কাছে থেকে দেখেন এবং তাঁদের সঙ্গে কাজ করারও সুযোগ পান।
এর
ফলে মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত নেহেরু,
বল্লব ভাই প্যাটেল, মৌলানা আজাদ,
জিন্নাহ এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ মন্তব্য আকর্ষণীয় ও
তথ্যবহুল। হিন্দু মুসলিম বিরোধ,
দাঙ্গা, অসহযোগ আন্দোলন,
সুভাষ বসুর শিক্ষা, উত্থান,
রাজনীতি, দেশত্যাগ ইত্যাদি বিষয়ও অকপটে এসেছে তাঁর রচনার বাঁকে
বাঁকে।
তিনি ১৯২৮ সালে মর্ডার্ণ রিভিউতে চাকরি করেছেন। ১৯৩৪-৩৬ সাল পর্যন্ত কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে চাকরি করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতা রেডিওতে ধারাভাষ্যকার ছিলেন। ১৯৪২ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চাকরি নিয়ে দিল্লি চলে যান এবং ২৮ বছর দিল্লিতে বসবাস করেন। ১৯৭০ সালে Oxford এ যান এবং বৃটিশ নাগরিকত্ব নিয়ে জীবনাবসান অবধি সেখানেই থেকে যান।
ছয়.
তিনি
আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ নামে দু'খন্ডে প্রকাশিত বইয়ে রবীন্দ্র-জীবনের নানা
অনুজ্জ্বল দিক নিয়ে চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণ করলেও রবীন্দ্রনাথের বাইরে যে বাঙালির
সংস্কৃতি খানিকটা অস্তিত্বহীন তা-ও উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, "বাঙলা ও বাঙালির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক জন্ম-নাড়ির
সম্পর্ক। বাঙলায় না জন্মালে,
রবীন্দ্রনাথকে কিছু মাত্র
না জানলে বাঙালির বাঙালিত্ব বজায় থাকে না। রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টা বাঙালীর
স্বরূপ উপলব্ধরই প্রয়াস মাত্র"।
তিনি
রবীন্দ্রনাথকে ৪০ বছর, ৬০ বছর এবং ৮০ বছর বয়সে তাঁর কবি কৃতি, তাঁর প্রতিভা,
তাঁর প্রখর মননশীলতা নিয়ে
সমসাময়িক কালের বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ
প্রতিভাগণের সঙ্গে তুলনা করেও তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে কার্পণ্য করেননি।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান,
গল্প, উপন্যাসের প্রতিটা বাক্য মনে হয় তিনি শুধু পড়েননি, বুঝেছেন এবং আত্মস্থ করেছেন।
তাঁর
সমগ্র রচনা জুড়ে রবীন্দ্র কাব্যের প্রাসঙ্গিক উদ্বৃতিতে ভরপুর। যেন তাঁকে ছাড়া
সবকিছুই অসম্পূর্ণ অসমাপ্ত।
১৯৩২
সালের ২৩ এপ্রিল তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের রাতে রবীন্দ্রনাথের একটা নতুন গান গাওয়া
হয়েছিল যা তাঁকে জীবন ভর আলোড়িত করে রেখেছিল। তিনি বলেছেন, ‘নিজের জীবনের প্রারম্ভ ও শেষের কথা মনে করিয়া এই গানটি
আমি সব সময়ই শুনিয়া থাকি।’
'আমার মল্লিকা বনে যখন
প্রথম
ধরেছে কলি
তোমারি
লাগিয়া তখনি,
বন্ধু
বেঁধেছিনু অঞ্জলি।।
তখনি
কুহেলীজালে
সখা, তরুণী উষার ভালে
শিশিরে
শিশিরে অরুণমালিকা
উঠিতেছে
ছলোছলি'।।
নীরদ
চৌধুরী তাঁর ১০০ তম জন্মদিনে
বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা এখনো আমাকে কাঁদায়। রবীন্দ্রনাথ, আমার ফেলে আসা বাংলাদেশ আর প্রয়াত ঘরণী। এই তিনই আমার
চোখে জল এনে দেয়।‘ তাঁর শবযাত্রার সময়ও রবীন্দ্রনাথের গান- 'আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে'
গীত হয়েছিল।
শেষ বয়সে এসে নীরদ চৌধুরী অহংকার করে বলতেন, ‘একশো বছরেও আমার একটা বই বেরোচ্ছে। এর আগে আর কোন লেখকের এরকম হয়নি।‘ স্বামীর ৯৭ বছর বয়সে স্ত্রী অমিয়া চৌধুরীর মৃত্যু হয়। স্বামীর শতায়ু হওয়াটা দেখে যেতে পারেননি অমিয়া দেবী। তিনি মাঝেমধ্যে অহংকার করে আরও বলতেন, ‘লন্ডনের বিখ্যাত 'ইলাস্ট্রিয়াস উইকলি' পন্ডিত জহরলাল নেহেরু আর আমাকে নিয়েই পূর্ণপৃষ্ঠা প্রচ্ছদ করেছে। এর আগে কোন ভারতীয়কে তারা এত গুরুত্ব দিয়ে করে নি।’ এমন উন্নাসিকতা ও ছেলেমানুষী করার নজিরও তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসেবে থেকে গেছে।
সাত.
অক্সফোর্ডে বাসকালে তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক মনীষী, লেখক, কথাসাহিত্যেক সাক্ষাৎ করেছেন। পরবর্তীতে তারা অনেকেই তাঁকে জীবন্ত 'এনসাইক্লোপিডিয়া' বলে আখ্যায়িত করেছেন। জীবদ্দশায় শুধু নিন্দা, বিতর্ক আর সমালোচনার সম্মুখীন হননি এই মহাপন্ডিত, অনেক সম্মানও পেয়েছেন। ১৯৮৯ সালে অক্সফোর্ড থেকে ডি, লিট উপাধি পান।একই বছর পান 'আনন্দ' পুরস্কার। ১৯৯৩ সালে তাঁকে দেয়া হয় 'কমান্ডার অব বৃটিশ এম্পায়ার' পদক। ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে 'বিদ্যাসাগর' পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করে। জীবিত অবস্থায় ভারতের একজন সাবেক রাস্ট্রপতি অক্সফোর্ডে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পেয়েছেন 'দেশিকোত্তম' পদক।
তিনি কিশোরগঞ্জ থেকেই স্বপ্ন দেখতেন ইংল্যান্ডের আর ইংল্যান্ডে থেকে বারবার স্মৃতিকাতর হয়েছেন কিশোরগঞ্জকে নিয়ে। তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। কারণ সারা জীবন অক্সফোর্ডে নিজের ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন ময়মনসিংহ জেলার ম্যাপখানা। মৃত্যু অবধি ভারতীয় পাসপোর্ট না বদলিয়েও এক নজির স্হাপন করেন। জন্মভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য আর কী নিদর্শন প্রয়োজন?
তাঁর
মহাপ্রয়াণের পর কলকাতার 'আনন্দবাজার' পত্রিকায়
প্রকাশিত অসামান্য বক্তব্যটি তুলে ধরেই শেষ করা যায়- 'অক্সফোর্ডের
লাথবেরি রোডের বাড়িতে একশো এক বছর বয়সের বৃদ্ধ যেদিন শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন, তাঁর কিশোরগঞ্জ,
ময়মনসিংহ আর কলকাতার আকাশে
সেদিন কিন্তু ওই কাজল কালো মেঘেরই ছটা। বাতাসে বৃষ্টির দাপাদাপি। ওটা শ্রাবণ মাস।
ক্যালেন্ডার জানাচ্ছে, ১৫ শ্রাবণ চলে গিয়েছেন নীরদচন্দ্র । যে
রবীন্দ্রনাথ তাঁর চোখে জল আনতেন,
তিনিও তো চলে গিয়েছেন এই
রকম ঝরঝর এক শ্রাবণেই। কী আশ্চর্য '!