হাসান আজিজুল হক
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫১ এএম
হাসান আজিজুল হক
২০১৬ সালে শহীদ কাদরী প্রয়াত হলে তাঁকে নিয়ে এই ছোট্ট লেখাটি লিখেছিলেন হাসান আজিজুল হক। একটি জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতার জন্য লেখা এই নিবন্ধ একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিকের কবি-স্মরণ। যে কথাসাহিত্যিকের গদ্য কাব্যময়— উপমা-চিত্রকল্পের এক ভান্ডারও বটে। সেই হাসান আজিজুল হকের প্রয়াণ ১৫ নভেম্বর। প্রয়াণ দিবসের প্রাক্কালে তাঁর লেখটি ধানসিড়ির পাঠকের উদ্দেশে নিবেদিত হলো
শহীদ কাদরীর মৃত্যু আমার কাছে যে একেবারেই অপ্রত্যাশিত তা বলব না। আমি অনেক আগে থেকেই জানি তিনি তার জীবনটাকে প্রায় একটা বোনাসের মতোই গ্রহণ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত থিতু হয়েছিলেন নিউইয়র্ক শহরে। যতদূর মনে পড়ে তার আগে কিছুদিন কেটেছিল ইংল্যান্ডে আর জার্মানিতে। দেশে না থেকে বিদেশে যাওয়াটা মনে হয় পরিকল্পিত ছিল না। তাকে যতদূর চিনতাম তাতে দেশের বাইরে গিয়ে জীবনযাপন করাটা তার খুব যে মনঃপূত ছিল তা মনে হয় না। সস্ত্রীক এখান থেকে গিয়েছিলেন। পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তিনি ইংল্যান্ড-জার্মানি ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। আমার খুব পরিচিত বন্ধু হলেও তার এ বিদেশবাসে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার কারণ আমি জানি না। ঢাকায় যখন ছিলেন তখন তো কবি হিসেবেই তিনি স্বীকৃত তো বটেই, বরং যথেষ্ট জনপ্রিয়ই ছিলেন। সম্ভবত তিনি কখনই বাংলাদেশের কোনো গ্রামাঞ্চলে বাস করেননি, চিরকালই শহরবাসী। আগে ছিলেন কলকাতায়, পরে ঢাকায়। ১৯৬৩-৬৪ সালের দিকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমাকে তার কাছে নিয়ে যান। তখন সায়ীদ সম্পাদিত ‘কণ্ঠস্বর’-এ আমার একটি বড় গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। সে গল্পটিতে একটি বুনো একরোখা মানুষের কথা ছিল। সায়ীদ আমাকে বলেন, ‘আপনার বৃত্তায়ন গল্পের নায়ককে যদি দেখতে চান তবে আমার সঙ্গে চলুন।’ সোজা তিনি আমাকে নিয়ে যান শহীদ কাদরীর বাসায়। শহীদ কাদরীর বড় ভাই তখন মনে হয় কোনো একটা কলেজে পড়াতেন। শহীদ কাদরীর সঙ্গে আমার সেখানেই পরিচয়। শহীদকে দেখিয়ে সায়ীদ বলেন, ‘এই আপনার গল্পের নায়ক।’ আমি তো প্রায় ভয়ই পেয়ে গেলাম। কিন্তু প্রথম আলাপেই শহীদ কাদরী আমাকে যেভাবে গ্রহণ করলেন, তাতে সায়ীদের কথা একেবারেই মিলল না। শহীদ যেহেতু কলকাতায় বহুকাল ছিলেন, সেজন্য তার কথাবার্তার মধ্যে একটা পরিশীলিত রুচির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিল। আমরা ওর বাড়ি থেকে সোজা গুলিস্তানে রেক্স হোটেলে বসে দু-তিন ঘণ্টা আড্ডা দিয়েছিলাম। সেই যে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত, সেটা আর কোনো দিনই ম্লান হয়নি। তখন শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরী ছিলেন আমাদের দুই আধুনিক জনপ্রিয় কবি।
আমি এ লেখাটায় শহীদ কাদরীর কবিতা নিয়ে একটি কথাও বলব না। হয়তো বলার ক্ষমতাও রাখি না। তবে দীর্ঘ ঘনিষ্ঠতার জন্য তিনি বিদেশবাসী হলেও আমি সব সময় ভাবতাম আমার খুবই কাছের মানুষ। কিন্তু যতদূর মনে হয়, বিদেশবাস তার জন্য নিষ্কণ্টক হয়নি, বরং তাকে নানাভাবে উপদ্রুত জীবন কাটাতে হয়েছে। এ বিষয়টা নিয়ে খুব বেশি কিছু আমি বলতে পারব না। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিউইয়র্কবাসী কয়েকজন বন্ধু যখনই বাংলাদেশে আসতেন আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি শহীদ কাদরীর মূল সমস্যা কিডনিতে। এরপর যখনই তার সম্বন্ধে খবর পাই তখনই তার কিডনি ক্রমেই বিকল হচ্ছে। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়। এর মধ্যেই দু-চারটি কবিতা লিখেছেন, আমার দেখার সুযোগ হয়নি।
সম্ভবত ২০০৮ সাল হবে, আমি একবার নিউইয়র্কে গিয়ে কয়েক দিন ছিলাম। আমার পরম স্নেহভাজন খ্যাতনামা লেখক হাসান ফেরদৌস আমাকে নিয়ে শহীদ কাদরীর বাসায় যান। আমি সে বাসায় ঢুকে দেখি ভেতরের করিডরে এক জায়গায় তিনি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। ঠিক হেলান দেওয়া বলা যাবে না, শুধু কোমরটুকু দেয়ালে ঠেস দেওয়া ছিল। দেহের বাকিটুকু ধনুকের মতো বাঁকা, মুখ প্রায় মাটিতে লাগানো। তাকে দেখেই আমার মনে হলো অত্যন্ত অসুস্থ তিনি। খুব কাছে গেলাম, গায়ে হাত দিলাম আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলেন আর বললেন, ‘কেমন আছো?’ ততক্ষণে আমার চোখের কোণে অশ্রু জমা হয়েছে। বললাম, আমি ভালো আছি, আসলে তুমি কেমন আছো ঠিক ঠিক বলবে। সেই মাথা প্রায় মেঝেতে গোঁজা অবস্থায় বলল, ‘কেন, আমি তো ভালোই আছি।’ সেই নির্ভীক একরোখা মানুষটিকে দেখা গেল এতটুকু মনোবল ভেঙে যায়নি তার। তার বর্তমান তরুণী স্ত্রী ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমার সঙ্গে তিনিও কথা বললেন কোনোরকম সংকোচ না করে। বললেন, ‘ঘরে চেয়ারে বসতে পারেন না, শুয়ে থাকতেও চান না, বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে আরাম হয় না, এ করিডরেই থাকতে পছন্দ করেন।’
একবার কানাডাপ্রবাসী ইকবাল হাসানের অনুরোধে ঢাকায় তার সম্পাদিত একটি পত্রিকায় শামসুর রহমান ও শহীদ কাদরীÑ এ দুজন কবি সম্বন্ধে আমায় কিছু লিখতে বলেন। আমি সাধ্যমতো ওদের সম্বন্ধে ছোট একটি গদ্য লিখি। আর তার শেষের কথা ছিল এ রকম... তুলনামূলকভাবে বলতে গেলে শামসুর রহমানকে গোটা বাংলার কবি বলা যায়। কিন্তু আমার কাছে নাগরিক কবি হলেন শহীদ কাদরী। মনে পড়ছে সে সময় আমার এ লেখা পড়ে শামসুর রহমান একটু ক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। আমি জানি এখন আর এ কথাটা খাটে না। দুজনকেই এখন এক কথায় বলতে হয় বাংলা ভাষার কবি এবং দুজনই মহৎ কবি। শহীদ কাদরী তার প্রিয়তমাকে একবার অভিবাদন জানিয়েছিলেন, আমি নিজে শহীদ কাদরীকে শতবার অভিবাদন জানাই।