শহিদ হোসেন
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:০৬ এএম
ছবি : সংগৃহীত
কফির মগ হাতে নিয়ে আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে স্বপ্নচারী মানুষটার কথা ভাবছিলাম। ক্যানসার এক কঠিন ব্যাধি, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা মানুষটিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ আজকাল আর আগের মতো লিখতে পারেন না। সারা শরীরে ব্যথা। ছেলে দুটি সারাক্ষণ শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। স্যারের মুখে কোনো বিরক্তি নেই। মাঝে মাঝে ম্যাসাজ করে দিলে শরীরের কিছু আরাম হয়। শাওন ভাবি ম্যাসাজ করে দিলে রাতে তিনি ঘুমাতে পারেন।
কাল আমি ম্যাসাজের কথা বলায় স্যার বললেন, আরে না, ম্যাসাজ করতে হবে না। তুমি আমাকে দেখতে এসেছো এতেই আমি অনেক খুশি হয়েছি।
প্রায় জোর করে কাল আধ ঘণ্টা ফুট ম্যাসাজ করে দিয়েছি।
স্যার বললেন, এ রকম চমৎকার ম্যাসাজ তুমি কোথায় শিখলে?
ব্যাংককে স্যার।
ব্যাংককে? তুমি কি সেখানে ম্যাসাজ পারলার খুলেছো?
না স্যার। আমাকে অফিসের কাজে প্রায়ই যেতে হয়, তখন হোটেলের নিচে ফুট ম্যাসাজ করাই।
ম্যাসাজ কি হাঁটুর নিচের দিকে করে, না ওপরেও ওঠে?
দুই ঘণ্টার ফুল বডি ম্যাসাজও আছে।
তুমি করিয়েছো?
জি স্যার।
কাতুকুতু লাগে না? একটা অচেনা মেয়ে তোমার বডি দলাইমলাই করবে এটা কেমন যেন অস্বস্তিকর ব্যাপার।
প্রথমে একটু অস্বস্তি হয় তারপর ঠিক হয়ে যায়। থাইল্যান্ডে ম্যাসাজ হলো পার্ট অব দেয়ার কালচার। প্রায় ২ হাজার বছরের পুরোনো ম্যাসাজ পদ্ধতির নাম নুয়াড থাই। এটি এক ধরনের ট্র্যাডিশনাল চিকিৎসা পদ্ধতি। এ বিশেষ ধরনের ম্যাসাজে আঙুল, কনুই, হাঁটু ও পায়ের সাহায্যে ডিপ স্ট্রেচিং ও বডি ট্যুইস্টিং করা হয়। এর মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন আকুপাংচার পয়েন্টে চাপ পড়ে, যাতে রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। মাংসপেশির যন্ত্রণা সারাতে এ ম্যাসাজ খুবই উপকারী স্যার।
থাক, ম্যাসাজ নিয়ে আর লেকচার দিও না। করিমের কাছ থেকে এর অনেক গল্প শুনেছি। দুনিয়ার টাকা সে নষ্ট করেছে ম্যাসাজের পেছনে।
আপনাকে এজন্য কোনো টাকা খরচ করতে হবে না স্যার, ইটস ফ্রি অব চার্জ।
হা হা হা, তুমি কি জানো তোমাকে আমি বিশেষ পছন্দ করি?
জি স্যার, জানি।
কেন করি তা জানো?
পছন্দ করেন সেটা জানি, কিন্তু স্পেসিফিক কারণ জানি না।
তোমাকে পছন্দ করার কারণ হলো আমার কাছে তোমার কোনো চাওয়া নেই। বহু মানুষ আমার কাছে আসার চেষ্টা করে কোনো স্বার্থ আদায়ের জন্য। এসে ভান করে আমি হলাম তাদের জীবনে ধ্রুবতারার মতো। স্বার্থ আদায় হয়ে গেলে টুপ করে কেটে পড়ে।
আমার কোনো স্বার্থচিন্তা নেই স্যার। আপনার ভালোবাসা পেয়েছি এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।
তুমি প্রথমবার আমেরিকায় এলে, আমাকে সময় দিতে গিয়ে কিছুই দেখা হলো না তোমার। আর কদিন থেকে গেলেই পারতে। তোমার প্রিয় ইউনূস সাহেবের সঙ্গে দেখা হতো।
আবার যখন আসব তখন দেখব স্যার।
আবার আসবে?
আপনাকে ছেড়ে বেশিদিন থাকা যায় না স্যার।
আমার কথা শুনে স্যার আমার হাত চেপে ধরলেন, আবেগে তিনি থরথর করে কাঁপছেন। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর বললেন, এমন ভালোবাসার কথা অনেক দিন শুনিনি। ছেলেমেয়েগুলোকে অনেক দিন দেখি না, চোখের আড়ালে বড় হলো। তুমি কি জানো আমার তিন মেয়েকে আমি নিজে সাঁতার শিখিয়েছি শহীদুল্লাহ্ হলের পেছনের পুকুরে? হলের মাঠে সাইকেল চালাতে শিখিয়েছি... একবার কি হলো, আমার মেজো মেয়ে শিলা ছিল ভীষণ ভীতু। কিছুতেই সে সাইকেল চালাবে না, আমি বলেছি কোনো ভয় নেই আমি পেছনে আছি, তুমি শুধু প্যাডলে চাপ দেবে আর সামনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যাবে। মেয়ে সাইকেল চালাচ্ছে আর আমি সাইকেল ধরে পেছন পেছন ছুটছি। শিলা নিজেই জানে না আমি কখন ওকে ছেড়ে দিয়েছি। সাইকেল চালাতে চালাতে সে একসময় আবিষ্কার করল আমি তাকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
তারপর?
আর তখনই সে ভয় পেয়ে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে কান্না... আমাকে তুমি ছেড়ে দিলে কেন, আমাকে তুমি ছেড়ে দিলে কেন? আমি কাউকেই ছাড়তে চাইনি খোকন, ওরা সবাই আমাকে ছেড়ে গেছে। পাঁচটি বছর আমি একা একা থেকেছি। রান্না নেই, খাওয়া নেই, ১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে বিছানায় পড়ে আছি দেখার কেউ নেই। একটি ছেলেমেয়ে এসে কোনো দিন জিজ্ঞেস করেনি বাবা কেমন আছো তুমি? আজ তুমি যখন বললে আমাকে ছেড়ে বেশিদিন থাকা যায় না... শুধু এ কথাটা আমার একলা থাকার সময়ে যদি আমার কোনো সন্তান এসে বলত তাহলে হয়তো আমার জীবনটা অন্যরকম হতো।
এসব কথা থাক স্যার, যা হয়েছে সেটা হয়তো অবধারিতই ছিল।
অবধারিত কেন বলছো?
কিছু ভেবে বলিনি, আমার মনে হয় প্রকৃতি কোনো শূন্যতা পছন্দ করেন না। আজকের যে জীবন, সে প্রকৃতির অমোঘ বিধান।
শোনো, আমার সঙ্গে মিসির আলি সাজবে না। মানুষ প্রকৃতিকে জয় করেই এগিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যখন স্ত্রী মারা যান তখন তার বয়স ৪১, আমি কি নির্মোহ হতে পারতাম না?
না, পারতেন না, লেখকরা একই সঙ্গে নির্মোহ এবং সবচেয়ে বেশি মোহগ্রস্ত, প্রচণ্ড মোহ নিয়ে তারা একেকটা চরিত্র তৈরি করেন।
কিন্তু তুমি অমোঘ বিধান কথাটা কেন বললে? তুমি কি জানো তুমি কার সঙ্গে কথা বলছো?
হা হা হা... আই নো স্যার।
ছাগলের মতো হাসবা না, এক্সপ্লেন করো! হুমায়ূন আহমেদের ক্যারেকটারের সঙ্গে বিনয় ব্যাপারটা যায় না। তিনি একই সঙ্গে বিনয়ী এবং দুর্বিনীত, একই সঙ্গে মিসির আলি এবং হিমু। তুমি কী বোঝাতে চাইছো?
আপনি একই সঙ্গে যুক্তিবাদী এবং আবেগপ্রবণ মানুষ। আপনার জীবনে আবেগের জয় হয়েছে।
তার মানে তুমি বলতে চাইছো যুক্তি পরাজিত হয়েছে?
না, আপনি আপনার মতো করে যুক্তি ঠিক রেখেছেন। আপনি যখন একা একা সংসারবর্জিত জীবনযাপন করছেন, সবকিছু থেকেও যখন কিছু নেই! সে সময় আপনি আত্মহত্যার চিন্তাও করেছেন। আবার একই সঙ্গে বাঁচার চিন্তাও করেছেন।
হে আত্মহত্যা খুবই স্বাভাবিক ছিল, মার্ক টোয়েন আত্মহত্যা করেছিলেন!
কিন্তু আপনি বাঁচতে চেয়েছেন, আর বাঁচতে চেয়েছেন বলেই একটি কিশোরী মেয়েকে চিরকুট পাঠাতেনÑ ‘শাওন আমার কিছু ভালো লাগছে না। খুব মন খারাপ। তুমি আমার মন ভালো করে দাও।’ সেই কিশোর বয়সে তাকে বলেছেন, ‘আদিমযুগে যখন মানুষেরা গুহায় থাকত তখন গুহার ভেতরে অনেক রঙবেরঙের পেইন্টিং করত শিল্পরা। সেই অন্ধকার গুহায় পেইন্টিংয়ের সময় শিল্পীর পাশে আলো ধরে থাকত প্রিয় কোনো নারী। শাওন আমার জীবন থেকে আলো হারিয়ে গেছে। আমি চাই তুমি আমার জীবনে সেই আলো নিয়ে আসো।’
হ্যাঁ বলেছিলাম।
আপনার যুক্তিবাদী মন জানত আপনার সেই আলো ধরার ডাক কিশোরী মেয়েটি উপেক্ষা করতে পারবে না। আপনি চেয়েছেন মেয়েটি আপনাকে ভালোবাসুক, খাবার টেবিলে আপনার প্লেটে ভাত বেড়ে দিক, জ্বরের সময় মেয়েটি এসে আপনার মাথায় জলপট্টি দিক। বাস্তবিক হয়েছেও তাই।
হ্যাঁ আমি চেয়েছি বলেই হয়েছে, কিন্তু তুমি অমোঘ বিধান বললে কেন? অমোঘ বিধান যা এড়ানো যায় না, কিন্তু আমি তো ইচ্ছে করলে এড়াতে পারতাম।
না, পারতেন না।
পারতাম না মানে কী? স্টপ, ম্যাসাজ বন্ধ। আমার আর ম্যাসাজের দরকার নাই।
পায়ের পাতাটায় দেওয়া হয়নি স্যার, ওখানেই তো আসল। ওখান থেকেই বডির ৬৮ পয়েন্টেই ব্লাড সার্কুলেশন হয়।
৬৮ পয়েন্টের খ্যাতা পুড়ি।
সো সরি স্যার,
সরির গুলি মারো, তুমি বলেছো প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না, আমি এটা মেনে নিলাম। কিন্তু তুমি কেন বললে আমি ইচ্ছে করলে প্রকৃতির অমোঘ বিধান এড়াতে পারতাম না, এটা আমাকে বুঝিয়ে বলো।
আমি ঘেমে গেলাম, এসব অপ্রিয় প্রসঙ্গ তুলে স্যারকে রাগানো ঠিক হয়নি। আমার সামনে অন্য অনেকের সঙ্গে তাকে রাগারাগি করতে দেখেছি কিন্তু আমার ওপর কখনও রাগ করেননি। এটার অবশ্য কারণ আছে, আমি বরাবরই নির্বাক শ্রোতা। বোবার কোনো শত্রু নাই এটা ১০০% সত্য কথা। আমার মতো বোবা লোক বেড়াতে এসে হঠাৎ কেন মুখ খুলতে গেল সেটা নিজেই ভেবে পেলাম না। আমি গলার স্বর যথেষ্ট নরম করে বললাম, স্যার, আপনার কি মনে আছে আমি প্রথমবার যখন নুহাশ পল্লীতে যাই তখন আমার সঙ্গে আমার এক কাজিন আর তার ওয়াইফ এসেছিল?
হ্যাঁ মনে আছে, হাজব্যান্ডটা খুব যত্ন করে বউকে কাঁটা বেছে মাছ খাওয়াল, মনে আছে।
আপনি তাদের ভালোবাসাবাসি দেখে মুগ্ধ হলেন।
বিয়ের বারো বছর পর একটি লোক মাছের কাঁটা বেছে বউয়ের মুখে তুলে দিচ্ছে এটা মুগ্ধ হওয়ার মতোই ব্যাপার।
তারপর আপনি বললেন, ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।
কালা তো হ্যায়ই! বিয়ের বারো বছর পর ভালোবাসা কাঁটা বেছে খাওয়ানোর পর্যায়ে থাকে না।
আমি যখন বললাম ওদের শিগগিরই ডিভোর্স হতে যাচ্ছে, আপনি আঁতকে উঠেছিলেন।
হ্যাঁ, কথাটা যে সর্বাংশে সত্যি হবে আমি এতটা আশা করিনি। তাই চমকে উঠেছিলাম।
তারপর আপনি ওদের অনেক করে বোঝালেন, যাতে ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে ওরা ডিভোর্সের চিন্তা না করে।
আরে ছোট ছোট দুইটা ছেলেমেয়ে একজন থাকে বাবার সঙ্গে আর একজন মায়ের সঙ্গে। বাচ্চাদের মনে কী একটা হাহাকার তৈরি হয় বুঝতে পারো! পরে কী হলো ওদের? আর তো জানা হয়নি।
আপনি বোঝানোর পর ছয় মাস ওরা একসঙ্গে ছিল তারপর ডিভোর্স হয়ে যায়।
ছেলেমেয়ে?
ছেলেমেয়ে মায়ের সঙ্গে থাকে।
পরে কি আবার ওরা বিয়ে করেছে?
হ্যাঁ, দুজনই বিয়ে করেছে।
যাক একদিকে ভালোই হয়েছে। দুজনেরই একটা গতি হয়েছে। কিন্তু তুমি এত পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটছ কেন?
কারণ আছে স্যার, আমার ধারণা সংসারের গ্রন্থি একবার ছিঁড়ে গেলে সেটা আর জোড়া লাগে না। বাচ্চাকাচ্চা, সমাজ এসবের কথা ভেবে সাময়িকভাবে কিছুদিন ঝুলে থাকে কিন্তু আলটিমেটলি যা হওয়ার তা-ই হয়।
আমার কোথায় ভুল ছিল বলো?
ভুল ছিল একা থাকা। আপনি যখন রাগ করে পরিবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে একা ছিলেন তখন আপনার পরিবারে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু একসময় ওরা একা চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর আপনার জীবনের শূন্যতা আপনি নিজেই চিরকুট লিখে পূরণ করেছেন।
এটাই কি তোমার অমোঘ বিধান?
আমার ধারণা পাঁচ বছর একা থাকার সময় আপনার মা নিশ্চয়ই একাধিকবার একটা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন।
হ্যাঁ করেছেন। আমিও চেষ্টা করেছি। কিন্তু শীতল সম্পর্ক আর কখনও ঠিক হয়নি।
আমার মতে সেটাই স্যার অমোঘ বিধান, আর সংসারের গ্রন্থি একবার ছিঁড়ে গেলে, দুজনের সমঝোতা-বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে এটা আর কখনোই ঠিক হয় না।
অনেক বকবক করেছো, আমার মাথা ধরে গেছে, তুমি এখন বহিষ্কৃত হও। মিনিমাম দুই ঘণ্টা আমার চোখের সামনে পড়বে না।
একটু মাথা মালিশ করে দেব স্যার?
বহিষ্কার...