পারভীন সুলতানা
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪ ১০:৩২ এএম
উঠানের পেট বরাবর কামলা আফাজ গরু নিয়ে তড়বড় করে হেঁটে যাচ্ছে। গাভিন গরু ভারী পেট নিয়ে তাল সামলাতে না পেরে দু-তিন বার হাম্বা হাম্বা স্বরে আপত্তি জানায়। তজিরন বেওয়া ঘষ্টানো গলায় খনখন করে ওঠেÑও গুলামের ফুত, গাবিন গরুডারে এট্টু রইয়া সইয়া, আরাম কইরা নে, দামড়ার লাহান ফাল ফারতে ফারতে আডোস ক্যা? তজিরনের মুখের দিকে আফাজ ড্যাবড্যাব করে তাকালে বুড়ি তেড়ে ওঠেÑহিরেবার কটকট কইরা চায়া রইছোস যে, আমি কি কানা না আন্ধা! উঠানের দড়িতে শেষ শ্রাবণের চামড়া পোড়া রোদ বাদশাহি তলোয়ারের মতো ঝকমক করছে। অনেক দিন পর তোরঙ্গের তলা থেকে সবুজ ফ্যাকাশে পাঞ্জাবির মুক্তি মিলল আজ। তজিরন বেওয়ার দৃষ্টি আবার সেদিকে সমর্পিত হয়।
কামলা আফাজ গরুটার দড়ি ধরে গায়ের জোরে টান দিতে দিতে প্রায় দৌড়ে উঠান পার হয়ে মাইকের মতো গলার সাউন্ড বাড়িয়ে দেয়Ñতজি দাদির চোখ ফুটছে, তজি দাদির নয়নের দিষ্টি আইছে...। কথাটা চাউর হতে সময় নেয় না। নুরুলদীনের চা স্টলের বিক্রিবাট্টা বেড়ে যায়, কারণ মুসলেম মাস্টারের বাড়ির কাছাকাছি চায়ের দোকান এই একটাই। শিববাসা গ্রামের শেষ প্রান্তে মুসলেম মাস্টারের বাড়ি। ভাটির দেশের গ্রামগুলো বর্ষাকালে হয়ে ওঠে এক একটা দ্বীপ। এবার বাইস্যা মাস এক্কেরে সংগ্রামের সুময়ের লাহান! এমুন বাদলা! মুরব্বিরা এ কথাই বলাবলি করছে। তার উপরে ইন্ডিয়ার ছাইড়া দেওয়া পানিতে এক ধাক্কা বন্যা আইসা আউশের ক্ষেত ভাসায়া নিয়া গেছে। তবু হিজল আর কদম গাছের ফুল ফোটাফুটির শেষ নাই। এর মধ্যে আবার তজিরন বেওয়ার প্রায় তিন বছর পরে চোখের দৃষ্টি ফিরল! উঁচা উঁচা বাড়িগুলো কোনোমতে রক্ষা পেলেও নদী আর নামার ক্ষেতের পানি গলাগলি করে ভাইবোনের মতো মিলেমিশে বইছে। এ দৃশ্য ভাটির মানুষের চিরচেনা। কয়েক বছর পর পরই এ রকম ঘটে। তো বাইস্যা মাস, ইন্ডিয়ার ছাইড়া দেওয়া পানি নিয়া আলাপসালাপ এখন শিববাসার মানুষজনের আলোচনার বিষয় না; যেখানে মুসলেম মাস্টারের বিধবা তজিরন বিবির দৃষ্টি ফেরত আসছে! স্বাধীনতার পর এবার নিয়া চারবার এ ঘটনা ঘটল। তজিরন বেওয়ার দৃষ্টি আসা মানে গ্রামে একের পর এক অলৌকিক কিছু ঘটতে থাকা। দেখা যাবে, ধান মাইর গেল তো ধইঞ্চা আর পাটের ফলন খুব ভালো হয়েছে, কিংবা এত মাছ ধরা পড়ছে পাঁচ-ছয় বছরে এমন ঘটনা বিরল! সব মাছ আইসা পড়ে শিববাসার নদীনালা আর খালখলান্তির ত্রিসীমানায়। তজিরন বেওয়ার দৃষ্টি আসা মানে যেমন- তেমন বিষয় না। স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বামী শহীদ হয়েছে। যুদ্ধের কয়েক মাস পর মুসলেম মাস্টারের পাঞ্জাবিটা দিতে আসে তার এক সহযোদ্ধা। পাঞ্জাবি পাওয়ার দিন দুই পর প্রথম দৃষ্টি হারায় তজিরন বেওয়া। তখন বয়স তজির কত আর বড়জোর ২৫-২৬। কোলে দেড় বছরের জয়। বড় মেয়ে ফাতেমা তখনও ঋতুমতী হয় নাই। বড় ছেলে মিন্টু স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করেছে মাত্র। তিন পোলাপান নিয়া তজিরন কী করে! অন্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ দেখে না সে। তবে বছরখানেক পর এক শীতের সকালে তার চোখের জ্যোতি ফেরত আসে।
গ্রামে এরাই একমাত্র শহীদ পরিবার। গ্রামের অহংকার মুসলেম মাস্টার। তিন নাবালক আর যুবতী বধূর চেয়ে দেশের স্বাধীনতা বড় হয়ে ওঠে মুসলেম মাস্টারের কাছে, যুদ্ধের শুরুতে মার্চের কাছাকাছি বর্ডার দিয়ে সোজা ইন্ডিয়া পাড়ি দেয়।
সাল ১৯৯৬। স্বাধীনতার ২৫ বছর পরেও এ গ্রামের তেমন বেশি কিছু পরিবর্তন হয়নি। শিববাসা এখনও ষোল আনা গ্রামই রয়ে গেছে। একটা বেতালা অবস্থানে মোহনগঞ্জের এ গ্রামটা। কংসের তীরঘেঁষা প্রায় যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ইউনিয়নের শেষ প্রান্তের গ্রাম। বর্ষায় নদীপথে নৌকা ও ট্রলারে তবু যাওয়া-আসার একটা উপায় আছে কিন্তু শুকনা মৌসুমে হাঁটা ছাড়া আর গত্যন্তর নাই।
তজিরন চোখের সামনে সবুজ পাঞ্জাবির রোদ্রস্নান দেখে। তার পরিষ্কার দৃষ্টি পাঞ্জাবির খুঁটিনাটি লক্ষ করে। পঁচিশ বছরে সবুজ রঙ স্থানে স্থানে জৌলুস হারাইছে, বুলেটের গুলিতে রক্তাক্ত মানুষটার লাল রক্ত শুকায়া মরিচার মতো লাগে। পাঞ্জাবির মালিক বয়সের হিসাবে এখনও টগবগা জুয়ান। মানুষ কয়, শহীদরা মরে না, বয়স বাড়ে না...। জামালপুরের কামালপুর বিইউপিতে যুদ্ধে শহীদ হয় মুসলেম মাস্টার...। মানুষটা ফিরত না এলেও তার সবুজ পাঞ্জাবিটা আসে। শহীদের পাঞ্জাবি! এ গেরামের একমাত্র শহীদ। মুসলেম মাস্টারের শহীদ হওয়ার গৌরব শিববাসা গ্রামের ললাটে রক্তের মতো স্বাধীনতার গৌরবচিহ্ন এঁকে দেয়। মুসলেম মিঞা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন, ছিলেন গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাস। তখনকার দিনের ম্যাট্রিক পাসের বড় ওজন ছিল; পথেঘাটে সচরাচর মিলত না! ভালো চাকরি পেয়েও নিজের জন্মভিটা ছেড়ে কোথাও যায়নি লোকটা। সেই মানুষ মাতৃভূমি ছেড়ে পাশের দেশে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে চলে যায় স্ত্রী-সন্তান রেখে।
ট্রেনিং শেষে ১২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যোগ দেয়। যুদ্ধের সময় রেকি করতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে মাস্টার। তার লাশটাও পাওয়া যায়নি। পরে শুধু সবুজ পাঞ্জাবিটা পাওয়া যায়। স্বামীর খবর শোনার দু-তিন দিন পর তজিরন বিবি ফকফকা দুপুরে আতকা চোখের আলো হারায়। সেই প্রথম দৃষ্টি খোয়ানো তার। তিন-তিনটা নাবালক পোলাপান! আয়-রোজগারের তেমন কোনো রাস্তা নাই। যুদ্ধের পর পর কী অভাব! শিববাসা গ্রামের মানুষ যুদ্ধটা সেই প্রথম টের পায়। এ গ্রামে না কোনো পাক বাহিনী ঢুকতে পেরেছে, না শোনা গেছে কোনো গুলাগুলির আওয়াজ! সারা বর্ষায় এত পানি! এত পানি! বাড়ির উঠান পর্যন্ত সয়লাব! আসমান-জমিন একাকার পানির জন্য। এদিকে পাক বাহিনী আসার কোনো মওকাই পায়নি।
হঠাৎ মুসলেম মাস্টারের বিধবার অন্ধ হওয়ার খবরে সারা গ্রাম তব্দা মেরে যায়। স্বামী হারিয়ে মানুষ আহাজারি করে, কান্দাকাটি করে, বিলাপ করে... তজিরন কি না চোখের জ্যোতি হারাল! যুদ্ধের প্রায় এক বছর পরে মুসলেম মাস্টারের পাঞ্জাবিটা তজিরনের বাড়িতে বহন করে নিয়ে আসে তার সহযোদ্ধা। মুসলেম মাস্টারের ঠিকানা না পাওয়ায় এতদিন পৌঁছানো যায়নি। তজিরন পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে বাকরহিত হয়ে পড়ে। এ কুর্তাখান গায়ে সে তার স্বামীকে শেষ দেখেছিল! পাঞ্জাবি পরিহিত স্বামীর শেষ দেখা মুখটাকে কল্পনায় আনার চেষ্টা করে তজিরন। নাঃ, সে অবয়ব ভাসে না চোখে! বারবার কেবল রক্তে ভেজা, যন্ত্রণাকাতর একটা শরীর ঘাই মারে। এর দু-তিন দিন পর হারায় চোখের দৃষ্টি; এ দৃষ্টি ফিরেছিল পরের বছর শীতে। তজিরনের শোকতপ্ত চোখ জেগে ওঠে সন্তানদের কথা ভেবে নাকি সবুজ রক্তমাখা পাঞ্জাবিটা দেখার তৃষ্ণায় তা একমাত্র জানে মাবুদ আর জানে তজিরন। সে বছর গ্রামে ছিল তীব্র শীত আর অভাব। মানুষ কী খায় আর কী দিয়ে শীত আটকায়! তজিরনের চোখে আলো ফেরার পরদিনই সবাই দেখে শিববাসার সব গাছগাছালি আর শুকিয়ে যাওয়া কাদাল হাওর, বিলে পাখি আর পাখি! শীতের এ সময়টা অতিথি পাখিরা আসে। গ্রামের মানুষ পাখিদের সাধারণত বিরক্ত করে না, তবে এবারের অভাবের ধাক্কাটা এরা পাখি বেঁচে আর পাখির গোশত খেয়ে সামলিয়ে নেয়। তখন সবে যুদ্ধের কাল শেষ হয়েছে, বন্য প্রাণী নিধনের আইনকানুন মজবুত হয়নি, শিববাসা এমন এক গ্রাম যেন ভিন্ন এক গ্রহ! ১৯৯৬ সালেও রাস্তাঘাটের তেমন উন্নয়ন ঘটে নাই।
তজিরনের সংসারটা ভাইদের দেখভালে, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা আর স্বামীর রেখে যাওয়া কিছু জমিনের ফয়ফসলে কোনোরকমে গড়িয়ে-মড়িয়ে চলছিল।
দৃষ্টি ফেরত এলে তজিরন তোরঙ্গে তোলা পাঞ্জাবিটা বের করে মাঝে মাঝে রোদে দেয়, নিরালায় রক্তের দাগলাগা পাঞ্জাবিটা নাকে নিলে স্বামীর শরীরের টাটকা গন্ধ পায়। এর মধ্যে ঘটে বিপর্যয়। নামজারির কারসাজিতে গ্রামের চৌধুরী মুসলেম মাস্টারের জমি বেদখল করে। ঘটনা ফাঁস হয় বোরো জমিন চাষ দেওয়ার সময় হাল দিতে গেলে। চতুর লোকটা কোনো হাঙ্গামা না করে জমিনের নামজারির পরিষ্কার দলিল হাজির করে তজিরন বেওয়ার কাছে। যুদ্ধের আগে যা মুসলেম মাস্টার তার কাছে সাফ কাওলা করে বেচে দিয়েছিল। মাস্টারের ফাইভ পাস স্ত্রী নেহায়েত গণ্ডমূর্খ নয়। তজিরন বেওয়া নামজারির কাগজটা হাতে নিয়ে সেই যে দৃষ্টি খোয়ায় তার উদ্ধার হয় চেয়ারম্যানের তদারকিতে জমি পুনরুদ্ধারের পর। মাঝখানে পর পর দুই বছর বন্যায় মানুষের জেরবার অবস্থা গেছে। সেবারও তজিরন ঘুম ভেঙে দাওয়ায় উঁকি দেওয়া প্রথম ভোরের সূর্য দেখে ছেলেমেয়েদের ডেকে তোলে। নিজে বদনায় পানি ভরে প্রাতঃক্রিয়া সারে। আর প্রতিবারের মতো এবারও তার মনে থাকে না দৃষ্টি হারানোর কথা। স্বাভাবিক আচরণে খোঁয়াড়ের হাঁস-মুরগি ছেড়ে, বড় মেয়ের সঙ্গে রান্ধাবাড়ার আয়োজনে লাগে। অথচ গতকালও মেয়েমানুষটা লাঠি ছাড়া এ ঘর-সে ঘর করত না। তজিরনের চোখের আলো ফিরে আসা বছরে আমনের ফসল হয় বাম্পার। শিববাসা থেকে ট্রলারের পর ট্রলার ধান যায় মোহনগঞ্জের বাজারে বিক্রির জন্য।
এ রকম মোটামুটি ভালোমন্দে কাটে জলজলান্তির এ গ্রামের মানুষের দিনমান।
দশ বছরের মাথায় বড় ধাক্কাটা আসে গ্রামের চেয়ারম্যানের ওপর। চৌধুরীর নজর পড়ে ইউনিয়নের চেয়ারের ওপর। পুরাতন চেয়ারম্যান খুন হয়ে যায় প্রকাশ্য দিবালোকে। আফসোস, লোকটার সততাও খুনের মামলার একটা সাক্ষীসাবুদ জোগাড় করতে পারে নাই!
তজিরন বেওয়ার দৃষ্টি ফেরার পর এবার আর কোনো অলৌকিক কিছু ঘটে না। ঘটনার মধ্যে ঘটনা, প্রাক্তন চেয়ারম্যানের হত্যা। তজিরন বেওয়ার চোখে দৃষ্টি এলেও, ঘুম আসে না। তোরঙ্গে রাখা সবুজ পাঞ্জাবিটা সারা রাত ছটফটায়। পাঞ্জাবিটার হাঁসফাঁস আর গোঙানির আওয়াজে তজিরন আতঙ্কে থাকে তোরঙ্গ খুলে পাঞ্জাবিটা না আবার বেরিয়ে যায়! গতকাল রোদে দেওয়ার সময় পাঞ্জাবিটা কয়েকবার উড়াল মারার ভঙ্গি করেছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, বিধবা তজিরনের মনের শান্তি হরণের আছে একশটা কারণ। ছেলে জয় বছর সাত পড়ার জন্য ঢাকা গিয়ে মাত্র একবার এলো। এর মধ্যে কাটল ছয়-সাড়ে ছয় বছর। পোলাটা আর ফিরল না! অভাব-অনটন কোন সংসারে নাই!
তাই বইলা কি কেউ বাড়িছাড়া হয়!
মার্চের উত্তাল দিনে জন্ম নেওয়া ছেলের নাম বাবা মুসলেম মাস্টারেরই দেওয়া। এ ছেলে কদিন আর বাবারে কাছে পাইছে! কিন্তু চালচলনে হইছে বাপের মতো। পড়ালেখার মাথা ভালো, মাইনষের সঙ্গে মিলমিশ ভালো! কিন্তু বড় একরোখা, জেদি। তজিরন একেলা নির্জনে এসব না ভেবে পারে না। তখন তার চিবুকে ভালো লাগার মৃদু বুদবুদ তৈরি হয়। কিন্তু বুদবুদগুলো বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না; বরং সেখানে তৈরি হয় একটা বিনবিনানো কালো বিষাদ। ছেলে তার আট বছরের ওপর বাড়িছাড়া। ইন্টার পাস করে পড়তে গেল ঢাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর একবার আসছিল; এরপর চৌধুরীর নামজারি কাণ্ড, আগের চেয়ারম্যান খুন... নানা কষ্ট আর ক্ষোভে বাড়ি আসে না। বড় ছেলে মিন্টু ভাইকে আনতে কয়েকবার গেছল, ছেলে তার ফিরল না; বরং তারেও যাইতে নিষেধ করে দিল। বাপের মতোই মুখচোরা, সব কথা রাখে অন্তরে... চিন্তার এ স্তরে এসে তজিরন বেওয়ার বিষাদ চিবুক ছেড়ে চোখের পানিসমেত নিম্নগামী হয়।
কয়েক দিন ধরেই লোকমুখে শোনা একটা কথা তজিরন বেওয়ার কানে ওড়াউড়ি করেÑমুক্তিযুদ্ধের স্মারক শহীদ মুসলেম মাস্টারের পাঞ্জাবিটা নাকি চৌধুরীর অপিসঘরে রাখব! কত ফান্ড আসে গ্রামের উন্নয়নের জন্য, রাস্তাঘাট, স্কুল তৈরি...! শহীদের স্মারক, এ পাঞ্জাবি দেখালে সহজ হয় এসব ফান্ড পাওয়া। যেকোনো দিন চৌধুরী নিজেও আসতে পারে পাঞ্জাবি নিতে। এ পাঞ্জাবি এখন রাষ্ট্রের সম্পদ, এ গেরামের ইজ্জত! পাঞ্জাবি থাকবে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের কাছে।
সত্যি সত্যি এক সকালে ইউনিয়ন সেক্রেটারি আসে চৌধুরীর আগমনের বার্তা নিয়া। চৌধুরীর কথা তজিরন বেওয়া গ্রাহ্য করে না। সাফ জানিয়ে দিয়েছে এটা তার স্বামীর পিরান; এর হকদার স্ত্রী হিসেবে কেবল তার। সারা গ্রাম নিশ্চিত অপেক্ষায় থাকে তজিরন বেওয়া আবার জলদি চোখের দৃষ্টি হারাবে। কিন্তু তা ঘটে কই!
সকাল থেকে তজিরন খুব ফুরফুরা মেজাজে। গতকাল ঢাকাফেরত তার বড় ভাশুরের ছেলে ফজল পাক্কা খবর নিয়া আসছে, আজকে তার ছেলে জয় বাড়ি ফিরবে। ছেলে তার আসতেছে ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে...। উঠানে রোদ আসার পর তজিরন তোরঙ্গ খুলে নীল পাঞ্জাবিটা রোদে মেলে দেয়।
তজিরনের চোখের দৃষ্টিতে আজ সোনামুখী সুঁইয়ে সুতা ঢোকানোর প্রখর জ্যোতি আর স্বচ্ছতা। তার মনে হয়, শুকাতে দেওয়া পাঞ্জাবিটা যেন উড়াল দেওয়ার ভঙ্গিতে বার কয়েক হাত দুটো উড়িয়েছে। বড় বেচইন আর ছটফটানি ভাব পাঞ্জাবিটার রক্তাক্ত গায়ে! কামলা আফাজ হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে আসেÑতজি দাদিগো, দাদার ফাঞ্জাবি নিবার লাইগা চৌধুরী তার দলবল লইয়া আইতাছে... ওর মুখের কথা শেষ হতে না হতেই চৌধুরীর ভুঁড়িওয়ালা শরীরটা ঢোকে; সঙ্গে সাঙ্গোপাঙ্গ। শিববাসা গ্রামের অগুনতি মানুষের ঢল নামে মুসলেম মাস্টারের বাড়িতে। মুহূর্তে শুরু হয় বুজরুগি। রোদে টানানো পাঞ্জাবিটা হাত ছুড়ে প্রতিবাদী ভঙ্গিতে পতাকার মতো পতপত শব্দে নড়তে শুরু করে। তিন লাফে চৌধুরী দড়ির কাছে গিয়ে খপ করে ওটা ধরতে গেলে চোখের পলকে পাঞ্জাবিটা চেয়ারম্যানের চোখে ঝাপটা মেরে পাখির মতো উড়াল দেয়। শিববাসা গ্রামের প্রতিটি মানুষের বিস্মিত চোখ দেখে সবুজ পাঞ্জাবির কালচে রক্তগুলো টকটকে লাল হয়ে ক্রমে বৃত্তাকার সূর্য হয়ে উঠছে...! একসময় শহীদ মুসলেম মাস্টারের সবুজ পাঞ্জাবিটা বাংলাদেশের পতাকা হয়ে বাতাসে উড়তে শুরু করে।