স্মরণ
মারুফ রায়হান
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:৩২ এএম
আলমগীর রহমান, স্বনামধন্য প্রকাশক, যিনি একসময় সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন
মানুষের মৃত্যু সঙ্গত ও স্বাভাবিক, অনিবার্য ও অবধারিত। অনেকটা আকস্মিকভাবেই আমাদের সমাজ থেকে একেকটি তারকা খসে পড়ে, আর আমরা জীবিতরা সচকিত হয়ে উঠি; আমাদের আংশিক মৃত্যু হয় এভাবেই, জীবিত থেকেও; আর আমরা চোখের আড়াল হওয়া মানুষটার দিকে ফিরে তাকাই। প্রয়াত ব্যক্তিদের স্মরণ করে বা শ্রদ্ধা জানিয়ে এই যে আমরা কিছু বলি, স্মৃতির পাতা আওড়াই, তাতে নিশ্চিতরূপেই থাকে ক্ষতিজনিত খেদ এবং ভালোবাসামিশ্রিত কিছুটা খাদ। বিদায়ি ব্যক্তির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত আমরা যা-ই লিখি বা বলি না কেন, সে সবই সমগ্র সত্যের ছোট ছোট খণ্ডিত অবলোকন; ব্যক্তির পুরো সত্তার টুকরো টুকরো চিত্রায়ণ। তবু এসবের মূল্য আমরা অস্বীকার করতে পারি না, পারি না মূল্যায়ন করতেও। বরং এ-জাতীয় স্মৃতিতর্পণ ও স্মরণাঞ্জলির মধ্য দিয়ে মানুষটিকে কৃতজ্ঞতায় বিদায় জানাই; হৃদয়ের উদ্বেলতা প্রশমনের পথ খুঁজি।
মিঠেকড়া মেজাজের এক বিশিষ্টজন আলমগীর রহমান সম্পর্কে দুটি কথা বলতে গিয়ে তাকে প্রথম দেখার সময়পর্বই প্রথমত সামনে চলে আসছে। টেবিলে গিজগিজ, শত কসরতেও আর একটি মিনি টেবিলও সংযোজন অসম্ভব, এমন কক্ষের এক টেবিল সামনে নিয়ে বসতেন আলমগীর রহমান সেই আশির দশকের প্রথমার্ধে। তার অবয়বের তুলনায় কি বেশ আঁটোসাঁটো ছিল সেই আসন? আমি তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রা কার্যালয়ের কথা বলছি। তার ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর কোলাহলপূর্ণ কক্ষটিকে গমগম গাম্ভীর্য দিত। সদ্যোতরুণ সসংকোচে সেই টেবিলের সামনে দিয়ে দ্রুতই হেঁটে যেত। দৈনিক বাংলা ভবনে মূলত আমি যেতাম ওই দৈনিকটির ও বিচিত্রার প্রধান সম্পাদক কবি শামসুর রাহমানের কক্ষে; সপ্তাহে ছয় দিন না হলেও তিন দিন তো বটেই। আর কখনও কখনও ভবনের সবচাইতে অহংকারী কার্যালয় বিচিত্রার ওই গিজগিজ টেবিলের সাধারণ কক্ষে ঢুঁ মারতাম। বিচিত্রায় কবিতার পাতা ছিল, আমারও কবিতা ছাপা হতো। নব্বই সালে সামরিক শাসক এরশাদের বিদায়ের পর বিচিত্রা ও দৈনিক বাংলা বন্ধ হওয়া পর্যন্ত লেখালেখি নামের সাহিত্যবিষয়ক পাতায় (এমনকি সংস্কৃতি বিভাগেও) অনিয়মিতভাবে লিখেছিও, দুয়েকটি সেমি কভার স্টোরিও করেছি, সাবের ভাইয়ের (মঈনুল আহসান) সম্মতিতে লেখকদের টুকরো খবর লিখে রীতিমতো যুগপৎ নন্দিত ও নিন্দিতও হয়ে উঠেছি। কিন্তু তখন সেখানে আলমগীর রহমান কী কাজ করতেন? আমি আশির প্রথমার্ধের কথা বলেছি যখন রাশভারি আলমগীর রহমানের চোখে যেন না পড়ি সেটাই চাইতাম বেশি করে। কিন্তু তিনি ঠিকই দেখে ফেলতেন, নবিশ আমাকে তার টেবিলের সামনে রাখা হাতলবিহীন ছোট চেয়ারে বসতে বলতেন এবং কী আশ্চর্য তিনি কীভাবে যেন জেনে গিয়েছিলেন যে আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, একটি নাট্যদলে আছি, আর কম্পাস নামে একখানা ক্ষীণ লিটল ম্যাগ বের করতে শুরু করেছি। আমার এসব টুটাফাটা পরিচয় জেনে তিনি এক-আধ বার মৃদু ভর্ৎসনা করলে আরও গুটিয়ে যাই আমি। তখনও বোঝার বয়স হয়নি যে সমালোচনা ও পরিহাসপ্রবণতা তার দুটি বৈশিষ্ট্য। বিচিত্রায় তিনি স্বউদ্যোগে আমার লিটল ম্যাগ সম্পর্কে আলোচনা ছাপালেন। জানি না সে সময় আমার অভিনীত স্বৈরাচারবিরোধী বিখ্যাত পথনাটক ‘খুদিরামের দেশে’-এর ছবি ছাপানোতেও তার ভূমিকা ছিল কি না।
কথাগুলো বলছি তার বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ দুটি সত্তার আপাতবিরোধী অবয়ব বোঝাতে। কথায় ও আচরণে মনে হবে তিনি আমার মতো নবীন-তরুণদের তাচ্ছিল্য করে আনন্দ পান, অথচ প্রকাশ করছেন তাদের নিবেদন, চর্চা ও কাজের বিচিত্র দিক। অর্জনের নির্যাসটুকু স্থায়ীভাবে ধরে রাখার ঝোঁকটি তার পূর্ণতা পায় প্রকাশনাশিল্পে আত্মনিয়োগের কারণে। আলমগীর রহমানকে আমি শুধু প্রকাশক বলব না সমাজের আর দশজন লেখক বা প্রকাশকের মতো। আমি বলব তাকে গ্রন্থসাধক। লেখক পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন আর একজন মুদ্রক (অর্থাৎ অধিকাংশ প্রকাশক) সেটি ছাপিয়ে পাঠকসমীপে নিয়ে আসনে, এমন গড়পড়তা অতিসাধারণ ভূমিকায় ছিলেন না আলমগীর রহমান। গ্রন্থপ্রেমী অনেকেই হতে পারেন, কিন্তু গ্রন্থসাধক হওয়া বিরল ব্যাপার। এটি মননশীলতার সংস্কৃতি তো বটেই, কিছুটা সৃষ্টিধর্মীও। একজন আলমগীর রহমান এ ঘরানার ছিলেন বলেই বিচিত্রধর্মী গ্রন্থ প্রকাশ করে গেছেন। বলতে পারি, পাঠকদের পাঠতৃষ্ণাও উস্কে দিয়েছেন তিনি গ্রন্থের বিষয় নির্বাচন এবং সঠিক সৌকর্যসহযোগে অসামান্য পরিবেশনায়। আজকের দিনের নতুন ধরনের তথ্য ও জ্ঞানপিপাসী পাঠকের চাহিদার বিষয়টিও তিনি স্মরণে রাখতেন। একই সঙ্গে চিরায়ত ও গবেষণাধর্মী প্রকাশনায়ও একনিষ্ঠ থেকেছেন। লেখক-সম্পাদক-সংকলকদের অনুপ্রেরণা ও সমর্থন জুগিয়ে গেলে যে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের জন্মলাভ ঘটতে পারে, এ গূঢ় সত্যটি তিনি জানতেন এবং তার পরিচর্যা করতেন। এখানেই শত প্রকাশকের মধ্যে তিনি বিশিষ্ট হয়ে উঠেছেন। সাহিত্যবোধ, প্রকৃত শিক্ষা এবং মুদ্রণ-সুরুচির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একজন মানুষ প্রকাশনাশিল্পে আত্মনিয়োগ করলে সে-জগৎটি কতটা সমৃদ্ধ হতে পারে, তার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন আমাদের আলমগীর রহমান।
দেশের দুটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা সংস্থা প্রতীক ও অবসর-এর প্রকাশক আলমগীর রহমান চিরঅবসরে চলে গেছেন। যদিও তার গ্রন্থসাধনার সুঘ্রাণ সুদীর্ঘকাল পেতে থাকবেন বাঙালি পাঠক, এতে কোনো সন্দেহ রাখি না।