নুসরাত সুলতানা
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৩৮ এএম
ইয়াসিন। আল কোরআনুল হাকিম। ইন্না কা আ লা মিনাল মুরসালিন। আ আলা সিরুমুমুস্তাকিম। তানজিলাল আজিজুর রাহিম। ৭ জানুয়ারি ২০১১ সালের সন্ধ্যা ৭টায় আসমানি খুব দরদ দিয়ে ইয়াসিন সুরার এই আয়াতগুলো তেলাওয়াত করছিল। তার অন্তরাত্মা সেদিন উত্তেজনায় ঠাসা। কিন্তু বাইরে থেকে সেকথা বোঝার কোনো উপায় নেই। মুখাবয়ব একেবারে নির্বিকার। কারও সঙ্গে তেমন মেশে না আসমানি। খুব নিভৃতচারী। একলা মনে থাকার মেয়ে। তেলাওয়াত করার সময় মা জমিলা খাতুন তাড়া দেয়Ñ তাড়াতাড়ি কর। তোর বাপের এত (মতো) ঢিলা অইস না। উইট্টা ভাত খাইয়া ল। তোরে আইজ রাত্তিরে তোর বাপে জব্বর ভাই গো বাড়ি থুইয়া আইব।
আসমানিকে একটা মেলামাইনের থালায় ভাত খেতে দিয়েছে জমিলা। চ্যাপা শুঁটকি, বেগুন, পাতলা মশুর ডাল আর একটা মুরগির ডিম ভেজে দিয়েছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকায় মা। চৌদ্দ বছরের আসমানি বড় সুন্দর হয়ে উঠেছে। যৌবনবতী হয়ে উঠছে যেন আলগোছে ধীরে। জমিলা নিজ মনে ভাবেÑ মাইয়াডা আমার কালা অইলে কী অইব? মুখটা এক্কেরে মায়ায় ঠাসা। ফিরোজ মেয়ার কপাল বড় ভালা। এমন মায়াবতী, নরোম বউ পাইব। আসমিও তো হ্যারে খুব পছন্দ করে। বিয়ার কতা শুরু হওনের থেইকা একবারও মাইয়ায় কইল নাÑ আমি বিয়া বসমু না। এসব ভাবতে ভাবতে ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে যায়। নুরুর সঙ্গে পরিচয়ের ক্ষণ মনে পড়ে জমিলার। এরই ভেতর তাকিয়ে দেখেÑ আসমানি তেমন ভাত খাচ্ছে না। শুধু থালার ভাত নাড়াচাড়া করছে। জমিলা জিজ্ঞেস করেÑ কীরে আসমি ভাত খাবি না? অইপক্ষের উত্তর আসেÑ মা তুই যাইবি না ক্যান? আমার বুঝি ডর করে না! জমিলা বলেÑ ডর কীসের? তোর আব্বায় আছে না লগে? তোর ভাইগো পরীক্ষা শ্যাষ অইলেই তো আমি আমু। তুই তো জানো মাÑ এই ভারতে গার্জিয়ান না থাকলে স্কুলে পরীক্ষা নেয় না। আর যাবি তো তোর খালাবাড়ি। হে তো তুই আগেও গেছু। লালমনিরআট তো বেশি দূর না পাগলি। খালি তোরা কাঁডাতার পার অইলেই সব ঝামেলা শ্যাষ! তুই চিন্তা করিস না। তোর আব্বায় দালালের লগে কতা কইয়া রাকছে। হ্যায় তোগো নিচ্চিন্তে পার কইরা দেব। এর পর হাত ধুয়ে উঠে যায় আসমানি।
জমিলা বলেÑ কী অইল মাইয়ার! ভাত খাইল না ক্যা?
আসমানি জিজ্ঞেস করেÑ মা ব্যাগ কি আমি লমু? না বাবায় নেবে? জমিলা মেয়েকে বলে, তুই এহন অনন্তপুর বর্ডারের ধারে জব্বরের বাড়ি যাইয়া খালি ঘুমাবি। তোর আব্বায় ব্যাগ লইয়া যাইবে। একটা লাল স্যালোয়ার-কামিজ পরে আসমানি নুরুজ্জামানের সঙ্গে বের হয়ে যায়। মেয়ের যাওয়ার পথে কেবলই তাকিয়ে থাকে মা। অন্ধকারে যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কেবলই জমিলার মনে হতে থাকেÑ আহারে! আমার মাইয়াডার বিয়া। অথচ আমি যাইতে পাললাম না। আবার নিজের মনে মনে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেÑ হে পরওয়ারদিগার তুমি হ্যাগোরে বিপদ পার কইরা দিও।
দুই.
আসামের বঙ্গাইও গ্রামের ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর। ঘরে বসে পড়ছে চার ছেলে, এক মেয়ে। আসমানিকে বাংলা পড়াশোনা করায়নি নুরুজ্জামান। অন্যসব ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে ওখানকার স্কুলে। আসমানি দু-দুবার কোরআন খতম দিয়েছে। নুরুজ্জামানের আছে ছোট একটা মুদিদোকান। ওটাই উপার্জনের একমাত্র পন্থা। কষ্ট হলেও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাতে চায় জমিলা আর নুরু। কত দিন অইয়া গেল এই আসামের বঙ্গাইও গায়ে। হেই বারো বছর বয়সে দাদির লগে আইছিলাম। এসব ভাবছিল জমিলা। আবার তার মনে ভেসে ওঠে পেছনের দৃশ্যপট। মনে মনে হেসে ওঠে বলেÑ আইয়াই তো গ্যালাম আইটকা। নুরুর লগে চিনপরিচয়। এতিম মানুষটা রাস্তাঘাট কই না ঘুমাইতো। না খাইয়া থাকত। দাদি হ্যারে কত্ত সোহাগ করত। যহনই ভালা কিছু রানত। দাদি আমারে দিয়া হ্যারে ডাক দেওয়াইত। হ্যায়ো খাইত আর চাইয়া চাইয়া আমারে দ্যাকত। আমিও যে কোনসম মইজ্জা গেলাম ট্যার পাইলাম না। আসলে পুরুষের চোহে আগুন থাহে। নারী অইল মোম। না গইললা পারেনি! এমন কইরাই ফিরোজও গলাইছে আসমানির মন। দুইডায় দুইডারে খুবই পছন্দ করে। মিত্তা কতা না নুরাও আমারে সুখ-শান্তি, আদর-সোহাগ কম দেয় নাই। গরিব কিন্তু নুরা মানুষটা বড় সরলসোজা। কোনো প্যাঁচ, অসততা হের ভিত্তে নাই। এসব আকাশ-পাতাল ভাবছিল জমিলা। এমন সময় নুরু এসে বলেÑ জমি শিগগিরই ভাত দেও। খাইয়া আমিও যাইগা অনন্তপুরের কাছাকাছি খলিলের বাড়িতে। মোশাররফের লগে তিন আজার টাকায় রফা অইছে। জমিলা জিজ্ঞেস করেÑ মোশাররফ কাম করবে তো ঠিক কইররা? ভালো মতো কইছ হেরে? নুরুজ্জামান বলেÑ এই দ্যাশে তো আর নতুন আই নাই। হেই ছোডকালতন থাহি। এপার-ওপারও তো কম কল্লাম না। ইসাবে তো দুইডা দ্যাশই আমার।
ভাত খেয়ে বের হওয়ার আগে আবার জমিলা সব সুন্দরভাবে গোছগাছ করে দেয়। দেখিয়ে দেয় নুরুকেÑ এই দেহ আসমানির বাপ। ভালো কইরা খেয়াল কইরা দেহÑ এই লাল কাফুরের পোঁটলাডায় একটা সোনার কানের দুল, দুইডা রুপার চুড়ি, একটা রুপার চেইন এইসব আছে। আর নাকফুল তো ফিরোজ মেয়ায় বা হ্যার বাপে দেবে। একটা লাল শাড়ি আর একটা বেগুনি শাড়ি দিছি আসমানিরে। বিয়ার দিন তুমি যাইয়া মিষ্টি আইনো গঞ্জে গোনে। আর জামাইরে পাঞ্জাবি-পায়জামা কিইন্না দিও। আর বিয়া অইয়া গ্যালে জামাইর আতে এক আজার টাহা দিও। আল্লাহর নাম লইয়া বাইর অও।
তিন.
বাংলাদেশের লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানার স্বর্ণামতি গ্রামেও চলছে বেশ আয়োজন। রেহানা আর রফিকের বড় পুত্রের বিবাহ বলে কথা। ছেলে বউয়ের জন্য মাটি আর টিন দিয়ে একটা ঘর বানানো হয়েছে।
একটা চৌকি, একটা আলনা কিনেছে রফিক। একটা বড় আয়না কিনে রেখেছে এক কোণে। নিজেদের পোষা একটা খাসি জবাই করে ৫০ জন লোককে ডাল-ভাত খাওয়ানোর আয়োজন করে রফিক। পান-সুপারি কিনেছে অনেক। রেহান বলেছে, বড় করে খাওয়ার আয়োজন বোন আসলে করবে।
গঞ্জের চায়ের দোকানে বসে ফিরোজ মিয়া আড্ডা দিচ্ছিল ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে। কাজ বলতে ফিরোজ মিয়া গরু- ছাগল দেখাশোনা করে। কখনও-সখনও জমির কাজ করে তার পিতা রফিকের সঙ্গে। বাকি সময় বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা গল্প করেই চলে যায়। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা ফিরোজ মেয়ার স্বাস্থ্যও আসমানির মতোই লিকলিকে। বিড়ি খাওয়া ছাড়া আর কোনো বদাভ্যাস তার নাই। আর মেয়েমানুষের ব্যাপারে আগ্রহ বা টিপ্পনী কাটার অভ্যাসও নাই। বাবা-মা যখন আসমানির কথা বলেছে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিয়েছে আসমানির হবু বর সাহেব।
রাত এগারোটার সময় ফিরোজ আসে বাড়ি। রেহানা স্বামীকে বলেÑ তোমার পুতের এহন আওনের সময় অইল! রফিক বলেÑ বিয়া অইলে কি আর আড্ডা দেতে পারব? শ্যাষফির বন্ধুগো লগে ইট্টু বিড়ি-সিগারেট টাইননা লউক। হেছাড়া কাইল বিয়া। আইজ কি পোলার ঘুম আইব ক! তুই ঘুমা। হে যা পারে করুক। ফিরোজ শুয়ে শুয়ে আসমানির মায়াবী মুখ আর শুকনো শরীরের কথা ভাবে। তার পর তার মনে হয়Ñ নাহ খাওয়াইয়া-দাওয়াইয়া বউরে মোডাতাজা বানাইতে অইব। এই শুটকা বউ সোহাগ কইরা মজা নাই। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে ফিরোজ। হঠাৎ ফিরোজের পোষা ময়নাটা ডেকে ওঠে আসমানি, আসমানি! ফিরোজ গিয়ে ময়নাটাকে বুকে নিয়ে আদর করে এসে ঘুমায়।
চার.
সারা রাত ছটফট করেছে আসমানি। কিছুতেই তার ঘুম এলো না। পেটে ক্ষুধা, মনে ভয় আর বিয়ের উত্তেজনা। এই তিনটিই স্নায়ুবিক ব্যাপার তাকে অস্থির করে রাখল পুরোটা রাত। তার পর যেই চোখটা লেগে এলো তখনই একটা ভীষণ দুঃস্বপ্ন দেখল। স্বপ্নে দেখলÑ যেই ফিরোজ আসমানিকে বুকের ভেতর নিয়ে আদর করতে শুরু করেছে। আর তখনই কেউ একজন পোষা ময়নাটার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে গুলি করে দিয়েছে। তখন রাত দুটো। আসমানি ওঠে পানি খায়। ভয়ে গুটিসুটি মেরে একা একা বসে থাকে বিছানায়।
রাত তিনটার সময় নুরু এসে আসমানিকে ডাক দেয়। বেরিয়ে এসে বাবার হাত ধরে বিয়ের কন্যা। তার বুক তখন আবার পিপাসায় খটখট করছে। বুকটা তখন চৈত্রের ফেটে যাওয়া জমির মতো চৌচির হয়ে যাচ্ছে।
নুরু মোশাররফকে বলেÑ এই রাইত সাড়ে তিনটার সময় তুই আমার মাইয়া পার করবি ক্যা? দিনের আলোতে কর। মোশাররফ বলেÑ অসুবিধা নাই। সব ঠিক আছে। তুই মাইয়া লইয়া আয়। আট ফুট উঁচু কাঁটাতার দেখে আসমানি খুব ভয় পায়। সে তার বাবাকে বলেÑ বাবা আমার ডর লাগতিছে। নুরু দেখতে পায়Ñ মেয়েটার মুখ শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে। সারা জীবনে আসমানি দুই ফুট উঁচুতেও ওঠেনি। মেয়েকে সে বলেÑ ভয় নাই মা। বাবাও তো তোমার লগে উটমু। নুরু মেয়ের হাত ধরে বসে থাকে। সেটা বিএসএফের জওয়ানরা স্পষ্ট দেখতে পায়। নুরু ভাবেÑ মনে হয় সব রফা করা আছে।
বিএসএফের পাঁচ জওয়ান ছিল অইখানে। নিজেদের ভেতর তারা বলাবলি করছিল, অই দেখ। কী করতেছে শুয়োরের বাচ্চার দল। এই গভীর রাতে মই লাগাইছে কাঁটাতারের ওপর। একজন বলে, কী করবেন? মাইকে সইরা যাইতে বলবেন? নাকি অ্যারেস্ট কইরা ঢোকাইয়া থুইবেন? একজন বলে, এসবের কিছু করা হবে না।
শালা চুতিয়ারা উঠুক আগে। চূড়ান্ত শিক্ষা দেওয়া হবে।
কুকুরের বাচ্চা শ্যাকের জাত। আবার ভারতে অবৈধ থাকন চোদায়। উঠুক খালি একবার!
কাঁটাতারের ওপর বসানো হয়েছে মই। নুরু প্রথমে মেয়েকে ওঠায়। তার পেছনেই ওঠে নুরু। আসমানি কেবল মইয়ের মাঝামাঝি উঠে বসেছে। পেছনে মইয়ের এক সিঁড়ি নিচে নুরু। হঠাৎ তীব্র শব্দ। রক্ত আর রক্ত!
আসমানির বুক থেকে রক্ত বেরোতে থাকে।
মা আ বলে একটা গগনবিদারী চিৎকার দেয় সে। মেয়ের চিৎকার শুনে নুরু বেহুঁশ হয়ে কাঁটাতারের এপাশে পড়ে যায়। বিএসএফ ঘিরে ধরে গুলিবিদ্ধ আসমানিকে। লোকজন জড়ো হয়ে যায়। তখন ফজরের ওয়াক্ত। গ্রামের সবাই নুরুকে বলে, তুই যা। তোর মাইয়া আমরা নিয়া আমু।
পাঁচ.
রক্তের নদীতে ভেসে যায় ফিরোজ মিয়ার হবু বউ। তার লাল স্যালোয়ার-কামিজ আরও লাল হয়ে উঠেছে। সে শুধু পানি, পানিই বলে বিলাপ করতে থাকে। কেও ইট্টু পানি দেন। মা, মা -আ পানি, পানি! আকাশ-বাতাস সে বিলাপে বুঝি ভেসে যায়। কিন্তু বিএসএফের জওয়ানরা থাকে নির্বিকার। ওরা তখন জড়ো হয়ে নিজেদের ভেতর গল্প করে। আসমানির মনে হয়, আল্লাহ তুমি এই শীতকালে বিষ্টি নামাও। আমারে ইট্টু পানি দ্যান। আমনেগো দোহাই লাগেএ! গ্রামের লোকদের সাহস হয় না কাঁটাতারে উঠে আসমানিকে পানি দেয়।
হঠাৎ আসমানি তাকিয়ে দেখে আসমান থেইকা একটা সিঁড়ি নামছে। আরে সিঁড়িতে বর বেশে কে? ফিরোজ! ফিরোজ সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরছে। রুপালি জরির মালা পরছে। কী সুন্দর লাগতিছে ফিরোজরে! কিন্তু ফিরোজের পাশে লাল জরির শাড়ি, লাল ওড়না পরা বউ কেডা? এত সুন্দর কইরা আমি কোনসময় সাজলাম! এত গয়না দেছে মায়! ফিরোজ কী আসমানে নিয়া যাইব আমারে! উই যে দূরে দেখন যায় বাসরঘর। এত ফুল বাসরঘরে? গোলাপ, গান্ধা, হাসনাহেনা, রজনিগন্ধা, বেলি! এত সুন্দর গন্ধ! এত ফুল! কিন্তু আমার আর পিপাসা নাই ক্যান? কুনু বেতাও নাই। আমি কই আইলাম! ওহ! আমি বুঝি আসমানে আইয়া পরছি? আহ এত সুন্দর আসমানের বাসর! কিন্তু আগরবাত্তির গন্ধ ক্যান? অই যে মায় আগরবাত্তি জ্বালাইছে। মায় কান্দে। বাবায় খালি ভিড়মি খায়! আর অই অনন্তপুরে কী অয়! আহারে! তরা এতই নিষ্ঠুর! আমার এত্ত সুন্দর দেহডা কেডা ঝুলাইয়া দেল কাঁডাতারে!