× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ছোট ‘ডন’রাই এখন এলাকার বড় ত্রাস!

সাইফ বাবলু

প্রকাশ : ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৫৫ এএম

আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:২৯ এএম

ছোট ‘ডন’রাই এখন এলাকার বড় ত্রাস!

রাজধানীর মুগদা এলাকায় গত ৭ মার্চ প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করা হয় কলেজছাত্র কলেজ পিয়াস ইকবালসহ দুজনকে। এর মধ্যে হাসপাতালে নেওয়ার পর পিয়াসের মৃত্যু হয়। পিয়াস ও তার বন্ধুকে কোপানোর একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। সেই ঘটনায় র‌্যাব অভিযান চালিয়ে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে খালিদ হাসানসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে জানা যায় হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে থাকা খালিদ মুগদার ‘গ্যাংস্টার’ নামে একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। তার বিরুদ্ধে এলাকায় মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে বড় অপরাধের অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে। মূলত খালিদের নেতৃত্বে থাকা একদল কিশোর এলাকায় মোবাইল ফোন চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, মারামারিসহ নানা অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। এলাকার কয়েকজন রাজনৈতিক ‘বড়ভাই’-এর প্রশ্রয় পেয়ে খালিদ ও সহযোগীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একটি চোরাই মোবাইল ফোন সেট বিক্রির টাকা পেতে দেরি হওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে পিয়াস ও তার বন্ধুকে কোপায় খালিদরা। 

এমন অবস্থা শুধু মুগদার নয়। রাজধানীসহ সারা দেশেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নানা নামের ভয়ংকর কিশোর গ্যাং। দিন দিন এদের অপরাধের মাত্রা বাড়ছে। সহপাঠী, প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্য, স্কুলশিক্ষকসহ এ যাবৎ তারা ২৬ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। আহত হয়েছে ৫ শতাধিক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ছোট অপরাধ দিয়ে শুরু হলেও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এখন বড় বড় অপরাধে জড়াচ্ছে। আগে এলাকায় মহড়া দেওয়া, উত্ত্যক্ত, রাজনৈতিক বড়ভাইদের পক্ষ নিয়ে মারামারিতে জড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কিশোর অপরাধীদের এখন মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি, দখল এবং টার্গেট কিলিংয়ের মতো অপরাধে জড়িত হতে দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগেরই নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক বড়ভাইদের মদদ। 

পুলিশের তথ্য বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের কার্যক্রম এখন আর কেবল পাড়া-মহল্লায় সীমাবদ্ধ নেই। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গিয়ে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ করছে তারা। অধিকাংশের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছর। কখনও কখনও এদের গ্রুপে ১৭-১৮ বছরের তরুণদের দেখা গেছে। সম্প্রতি নানা অভিযোগের ভিত্তিতে সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। এসব গ্যাংয়ের সদস্যদের কারা আশ্রয়-প্রশ্রয় ও অর্থ দিচ্ছে, সে বিষয়েও খোঁজ নেওয়া শুরু করেছে পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিটগুলো।

পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, গ্যাং কালচার নির্মূলে সারা দেশে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। এ বিষয়ে প্রত্যেক জেলার এসপিদের বিশেষ নির্দশনা দেওয়া হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। অভিযান ও গ্রেপ্তারের বিষয়গুলো সদর দপ্তর থেকে মনিটর করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সামাজিক অবক্ষয়, ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার, পারিবারিক শাসন না থাকা ইত্যাদি কারণে অনেক পরিবারের ছেলেরা খারাপ সংস্পর্শ থেকে অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। গ্যাং-কালচার বন্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। 

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানে জানা গেছে, সারা দেশে এখন পর্যন্ত ২৬ জন কিশোর গ্যাংয়ের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে রাজধানীতে। ৩২৯ জনকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করার ঘটনা ঘটেছে। জানা গেছে, ঢাকাসহ বিভিন্ন মহানগর ও জেলা পর্যায়ে কিশোর গ্যাং গ্রুপের বিরুদ্ধে ৩৭৯টি মামলার মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ৩৩৫টির। তদন্তাধীন রয়েছে ৩৪টি মামলা। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ১০টি মামলায়। চার্জশিট দেওয়া মামলায় ১ হাজার ৩৯৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। এসব আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ৯৪০ জন। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশ (ডিএমপিতে) কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে ৬২টির মধ্যে ২২ মামলার চার্জশিটে ৭৭ জনকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক (১৫ বছরের কম) অপরাধী প্রমাণ হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরে ৮৫ মামলার মধ্যে ৪টির অভিযোগপত্রে ১৫ জন অপ্রাপ্ত বয়স্ক আসামির অপরাধ প্রমাণ হয়েছে। ঢাকা রেঞ্জে ১৩৪ মামলার মধ্যে ৫ মামলায় ১৬ জন শিশুর অপরাধে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। চট্টগ্রাম রেঞ্জের ৪০ মামলার মধ্যে ১১টির অভিযোগপত্রে ১৬ জন শিশুর অপরাধের প্রমাণ মিলেছে। এভাবে বিভিন্ন রেঞ্জে কোনো-না কোনো মামলায় শিশু অপরাধীদেরও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় চার্জশিটে তাদের নাম দেওয়া হয়েছে। 

পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, কিশোর গ্রুপের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে টহল, অভিযান-তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। কিশোর গ্রুপের সম্ভাব্য আস্তানাগুলোতে অভিযান চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হচ্ছে। তালিকা হালনাগাদের মাধ্যমে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। 

র‌্যাবের সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৩ শতাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে অধিকাংশ কিশোর অপরাধী এখন জামিনে রয়েছে। জামিনে এসে তারা আবার একই অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। তবে র‌্যাব কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। 

ওই সূত্র আরও জানায়, মূলত বখে যাওয়া কিশোররা মাদক, জুয়াসহ খারাপ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে নেশার টাকা জোগাতে বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। যখন যে টাকা দেয়, এরা তাদের হয়ে জমি দখল, মারামারি, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে টার্গেট কিলিংয়ের মতো বড় অপরাধ করছে। গ্রেপ্তার করার পর অধিকাংশ কিশোর অপরাধী জামিনে বেরিয়ে আসে। এদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারাই টাকা খরচ করে জামিন করিয়ে আনেন। এলাকার আধিপত্য ধরে রাখতে এদের নানা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হয়। 

কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতায় শীর্ষে ঢাকা

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যবেক্ষণে এসেছে, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। মহানগর ও বিভাগীয় পর্যালোচনায় রাজধানীতে ১২৭টি গ্রুপের তৎপরতা খুঁজে পেয়েছে পুলিশ। বিভাগ হিসেবেও ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ২৪টি গ্রুপের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম। সেখানে মহানগরকেন্দ্রিক ৫৭টি গ্রুপের তৎপরতা রয়েছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে ১৩টি গ্রুপ। এর বাইরে খুলনা মহানগরে ৫টি গ্রুপ সক্রিয় থাকলেও জেলা পর্যায়ে ২টি গ্রুপের কর্মকাণ্ড পুলিশের তালিকায় রয়েছে। অন্যদিকে বরিশাল মহানগরে সুনির্দিষ্ট গ্রুপ না থাকলেও বিভাগীয় পর্যায়ে ৪টি গ্রুপের কর্মকাণ্ড রয়েছে বলে পুলিশের এক গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর বাইরে গাজীপুর মহানগরে ৫টি সক্রিয় গ্রুপের তৎপরতা রয়েছে। রাজশাহী ও সিলেটে মহানগর ও বিভাগীয় পর্যায়েও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা রয়েছে। 

ঢাকায় সক্রিয় কিশোর গ্যাংগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ মোহাম্মদপুরের ফিল্ম ঝির ঝির, স্টার, বন্ড, গ্রুপ টোয়েন্টি ফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল চিনে ল ও কোপাইয়ে দে। এদের বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। তেজগাঁওয়ে মাইনুদ্দিন গ্রুপ, উত্তরায় নাইন স্টার গ্রুপ, পাওয়ার ভয়েজ, বিলবস, নাইন এম এম বয়েজ, সুজন ফাইটার ক্যাসল ভয়েজ, আলতাফ জিরো ভাইপডার, তুফান এবং ত্রিগোল গ্যাং গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। মিরপুরে সুমন গ্যাং, পিচ্চি বাবু, বিহারী রাসেল, বিচ্চু বাহিনী, সাইফ গ্যাং, বাবা রাজান, রিপন গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, নয়ন গ্যাং এবং মোবারক গ্যাং সক্রিয়। 

বংশালে জুম্মন গ্যাং, ধানমন্ডিতে এ কে ৪৭ নাইন এম এম ও ফাইভ স্টার বন্ড গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। মুগদায় চান জাদু (যমজ ভাই) গ্রুপ, ডেভিড কিং ফল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারী গ্রুপ রয়েছে। 

র‌্যাব সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালে উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি বিশেষভাবে আলোচনায় আসে। চাঞ্চল্যকর ওই হত্যাকাণ্ডের মূলহোতাসহ বেশ কয়েকজন কিশোর গ্যাং সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। ২০১৭ সাল থেকে র‌্যাব এ যাবৎ বিভিন্ন অপরাধে কিশোর গ্যাংয়ের ১ হাজার ১২৬ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। 

পুলিশের তালিকা অনুযায়ী ঢাকা মহানগরে কিশোর গ্যাংয়ের ১২৭টি গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ৪০০ জনের মতো। এসব গ্রুপের বিরুদ্ধে ৫১টি মামলা রয়েছে। আসামি রয়েছে আড়াইশ জনের মতো। চট্টগ্রাম মহানগরের ৫৭টি গ্রুপে ৫ শতাধিক সদস্য রয়েছে। এসব গ্রুপের বিরুদ্ধে ৪০১টি মামলা আছে। আসামি ২২২ জন। খুলনা মহানগরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৫টি গ্রুপের ৩৫ জন কিশোর। এদের বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা রয়েছে। গাজীপুর মহানগরে ৫টি গ্রুপে শতাধিক সদস্য রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ১১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি হয়েছে ২০ জন। 

ঢাকার বাইরেও বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

রাজধানীর বাইরে দেশের অন্যান্য শহরেও কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে। প্রায়ই নানা অপকর্ম ঘটাচ্ছে তারা। এসব নিয়ে উদ্বেগে আক্রান্ত সাধারণ মানুষ। কখন যে কে এই দুর্বৃত্ত কিশোরদের কবলে পড়বে তা অনুমানও করা কঠিন। দেখা যায়, তুচ্ছ বিষয়েও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বেপরোয়া আচরণ করছে। তাদের হামলায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই।

গত ৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের আকবরশাহ থানার পশ্চিম ফিরোজ শাহ হাউজিং এলাকায় ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার হন চিকিৎসক কোরবান আলী। ১০ এপ্রিল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। 

আকবরশাহ থানা পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই কিশোর গ্যাংয়ের সবাই ছাত্রলীগ নেতা গোলাম রসুল নিশানের অনুসারী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। নিশান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ছিলেন ।

গত ১৭ এপ্রিল নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার সেবারহাট বাজারে দুই কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত ও তিনজন গুরুতর আহত হয়। বৈশাখী মেলায় দোকান বসানো নিয়ে বিরোধে এ সংঘর্ষ হয়। নিহত কিশোর গ্যাং সদস্যের নাম মো. শাওন (১৮)। 

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, এলাকায় আয়োজিত বৈশাখী মেলায় দোকান বসানো নিয়ে আয়োজকদের অনুসারী দুই দল কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধ দেখা দেয়। এর জেরে দুইপক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলা ও সংঘর্ষের সময় প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে একটি গ্যাংয়ের সদস্য শাওন গুরুতর আহত হয়। ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

২০২২ সালে উত্ত্যক্তসহ বেপরোয়া আচরণের জন্য শাসন করায় কলেজছাত্র আলাফুল আহসানের হাতে খুন হন আশুলিয়ার হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক প্রভাষক উৎপল কুমার সরকার। তাকে গ্রেপ্তারের পর কিশোর গ্যাংয়ের নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের তথ্য বেরিয়ে আসে। ২০২২ সালের ১৩ মে গলাচিপার একটি স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদককে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা পিটিয়ে আহত করে। 

ছোট থেকে বড় অপরাধে 

পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিরোইজমের চিন্তা থেকে কিশোরদের মধ্যে গ্যাং-কালচার শুরু হয়। শুরুতে পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে মারামারি ও এলাকায় মহড়া দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এদের তৎপরতা। কিন্তু ধীরে ধীরে মাদকের নেশা ও অর্থের লোভে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা চুরি, ছিনতাই, উত্ত্যক্ত, মাদক ব্যবসা, জুয়া খেলায় জড়িয়ে পড়েছে। খেলার মাঠ, পাড়া-মহল্লা এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও মারামারি ও বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে পড়ছে এই কিশোর অপরাধীরা। গণপরিবহনে বিনা টিকিটে ভ্রমণ, বিনা টিকিটে সিনেমা দেখা, পাবলিক পরীক্ষায় প্রভাব বিস্তার, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণÑ এমনকি হত্যার মতো অপরাধেও তাদের নাম আসছে। অনেক অপকর্মেই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। 

যেভাবে এসেছে গ্যাং-কালচার 

পুলিশের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, গ্যাং-কালচার মূলত বিদেশি অপসংস্কৃতি। প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের কারণেও এটি আরও বাড়ছে। সাধারণ কিশোর বয়সে এক ধরনের হিরোইজম কাজ করে। এ সময় বিপথে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকে বেশি। রাজনৈতিক দলের বড়ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে অনেক কিশোর নিজেদের বেশ পাওয়ারফুল ভাবতে শুরু করে। আর কখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় রাজনৈতিক দলের বড়ভাইদের তদবিরে রক্ষা পেয়ে গেলে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এছাড়া অপরাধীদের সঙ্গে চলাফেরার মাধ্যমে ছোটখাটো অপরাধ থেকে শুরু করে বড় অপরাধে জড়িয়ে যায় এই কিশোররা। গ্যাং-কালচার এভাবেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে বলে পুলিশের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। তাদের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, অনেক বড় বড় সন্ত্রাসীও এই কিশোরদের ব্যবহার করছে। 

এদিকে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বেড়ে যাওয়ায় সারা দেশে পাড়া-মহল্লায় অভিযান চালানোর নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গ্যাংয়ের সদস্যরা যে দলের বা যে নেতার অনুসারী হোক না কেন, তা যেন বিবেচনায় আনা না হয়। 

কিশোর অপরাধীদের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান গতকাল শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সি কেউ অপরাধ করলে আমরা তাকে কিশোর অপরাধী বলছি। এ বয়সি কিশোররা দলবদ্ধভাবে অপরাধ করলে তাকে আমরা বলছি কিশোর গ্যাং। আজকের কিশোর, তরুণরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এজন্য তাদের নিয়ে কিশোর গ্যাং শব্দটি বলতে চাই না। এসব কিশোরের বেশিরভাগই ছিন্নমূল, যারা রাস্তায় কাজ করে। বেশিরভাগ কিশোরের বাবা নেই। মা থাকলেও দেখা যায় অন্যের বাসায় কাজ করেন। তবে আইনের আওতায় পড়লে পুলিশ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। রাজনৈতিক উপনেতা-পাতিনেতাদেরও বিভিন্ন সময় থানায় ডেকে সতর্ক করা হচ্ছে।

শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার জন্য জায়গা না থাকার কথা উল্লেখ করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ঢাকা শহরে খেলার মাঠের সংখ্যা কম। মাঠ নিয়ে আন্দোলনও হয়েছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো খেলাধুলার মাঠের বিষয়ে কাজ করতে পারে।

গ্যাং-কালচার নির্মূলে যা বলছেন সমাজবিজ্ঞানীরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কিশোর গ্যাং-কালচার গড়ে উঠছে সমাজের কিছু বড়ভাইদের জন্য। যারা রাজনৈতিক অথবা আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের জন্য সমাজের সুবিধাবঞ্চিত কিশোরদের ব্যবহার করেন। কিশোর গ্যাংয়ের বর্তমান কর্মকাণ্ড যে রকম ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, সেটা এদের জন্যই। এটি বন্ধ করতে হলে শুধু কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেপ্তার করলে হবে না, এদের পৃষ্ঠপোষকদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। ঢাকায় কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ২১ জন কাউন্সিলরের নাম এসেছে। পৃষ্ঠপোষক বা গডফাদার হিসেবে যারা কাজ করছে, তাদেরকে অভিযানের বাইরে রেখে কিশোর গ্যাং নির্মূল করা সম্ভব নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, সমাজের মূলধারার কিশোর-কিশোরীদের একটি বড় অংশ পড়াশোনার পাশাপাশি সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে পরিবারকে সহযোগিতা করে। এদের কর্মকাণ্ড সমাজের জন্য ইতিবাচক। তবে বিচ্ছিন্ন একটি অংশ যারা কিশোর গ্যাং-কালচারে জড়িয়ে নানা অপরাধ করছে, তাদের জন্য দায়ী হচ্ছে সমাজের কিছু বড় মানুষ। কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যে যারা পৃষ্ঠপোষকতা করে, তাদেরকে আইনের আওতায় আনলে গ্যাং-কালচার বন্ধ হবে। সেই সঙ্গে অপরাধে জড়িত কিশোরদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে সুপথে ফিরিয়ে আনতে হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা