প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:০১ পিএম
আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:০৬ পিএম
ছবিতে ডান পাশে অভিযুক্ত টি আই এম ফকরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়া ও বায়ে সহযোগী মো. কামরুল ইসলাম ওরফে সাগর। প্রবা ফটো
আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রে সম্পৃক্ততার দায়ে সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন টি আই এম ফকরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়া। তবে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় গ্রেপ্তারের প্রায় ছয় বছর পর ২০২০ সালের নভেম্বরে খালাস পান তিনি। প্রায় এক দশক আগের ওই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়। সেই টিপু কিবরিয়া ফের একই অভিযোগে গ্রেপ্তার হলেন।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর খিলগাঁওয়ে অভিযান চালিয়ে তাকেসহ তার এক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ বিভাগের এন্টি ইললিগ্যাল আর্মস রিকভারি টিম।
২০১৪ সালের ৯ জুন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে গ্রেপ্তারের আগপর্যন্ত টিপু কিবরিয়া একজন জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক ও আলোকচিত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বাজারে জনপ্রিয় বেশ কয়েকটি ছড়ার বই ছাড়াও ‘হরর ক্লাব’ নামে শিশুদের জন্য সিরিজ বই রয়েছে তার নামে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি ও পাচারের সঙ্গে যুক্ত টিপু কিবরিয়া। দেশের বাইরে আন্তর্জাতিকভাবেও ভয়ংকর এই অপরাধে তালিকাভুক্ত।
ইন্টারপোলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেসময় গ্রেপ্তার হন তিনি। প্রায় এক দশক পর আবারও গ্রেপ্তার হলেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সাহিত্য চর্চার আড়ালে পুনরায় শিশু পর্নোগ্রাফির মতো অপরাধের সেই পুরোনো পথেই হাঁটতে শুরু করেছিলেন এ অভিযুক্ত।
টিপু কিবরিয়া ছাড়াও তার সহযোগী হিসেবে গ্রেপ্তার হয়েছেন মো. কামরুল ইসলাম ওরফে সাগর নামে আরও একজন। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ২৫ হাজারের বেশি শিশু পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট, পর্নোগ্রাফি তৈরির সরঞ্জাম জব্দসহ এক শিশু ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়েছে।
বুধবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে এ বিষয়ে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান সংবাদ সম্মেলন করেন।
তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তার ফকরুজ্জামান এক সময়কার খুব জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক। তিনি টিপু কিবরিয়া নামে পরিচিত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৭ সালে বাংলায় স্নাতক এবং ১৯৮৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯১ সালে সেবা প্রকাশনীর মাসিক ‘কিশোর পত্রিকা’য় সহকারী সম্পাদক পদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন তিনি। আবার ফ্রিল্যান্সার আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি শিশু সাহিত্য রচনা করতেন। তার অর্ধ শতাধিকের ওপরে বই রয়েছে; যার বেশিরভাগই সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত।’
সিটিটিসি আরও বলেন, ‘২০০৫ সাল থেকে শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি ও বিতরণের সঙ্গে জড়ান টিপু কিবরিয়া। দীর্ঘদিন এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার পর ২০১৪ সালে সিআইডির কাছে গ্রেপ্তার হন। তার নামে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হয়। ২০২১ সালে জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় সাহিত্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ‘একশো এক’ নামে একটি কবিতার বই প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে সাহিত্য চর্চার আড়ালে পুনরায় শিশু পর্নোগ্রাফির সেই পুরোনো পথেই হাঁটতে শুরু করেন এ টিপু কিবরিয়া।’
আসাদুজ্জামানের দাবি— প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শিশু পর্নোগ্রাফিতে জড়িত এই অভিযুক্ত জানিয়েছেন, ‘ছিন্নমূল ছেলে পথশিশুদের ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি কন্টেন্ট বানান। তিনি নিজে গুলিস্তান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাংবাদিক বেশে ছিন্নমূল ছেলে পথশিশুদের সামান্য কিছু অর্থের লোভ দেখিয়ে নিজের বাসায় ডেকে নেন। এরপর নিজের ক্যামেরায় শিশুদের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির নগ্ন ছবি, গোপনাঙ্গের ছবি তোলেন এবং ভিডিও করেন। নিজের বাসা ছাড়াও বিভিন্ন পার্কের নির্জন ঝোপঝাড়ে এই ছিন্নমূল ছেলে শিশুদের একই প্রক্রিয়ায় অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন।’
সিটিটিসিপ্রধান জানান, এ ছিন্নমূল ছেলে শিশুদের সংগ্রহ করার জন্য টিপু কিবরিয়ার কয়েকজন সহযোগীও রয়েছে। যাদের মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তার ব্যবহৃত ডিভাইসগুলো থেকে ২০ পথশিশুর ছবি ভিকটিম হিসেবে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
টিপু কিবরিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে পুলিশের কাউন্টার টেররিজমের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘পরবর্তীতে এ অশ্লীল ছবিগুলো বিভিন্ন নিষিদ্ধ ও পর্নোগ্রাফির ওয়েবসাইটে আপলোড করে। এ সকল ওয়েবসাইটগুলো বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষগুলোর এক ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম; যার অধিকাংশ সদস্য মূলত উন্নত বিশ্বের মানসিক বিকারগ্রস্ত নাগরিকরা। এ ওয়েবসাইটগুলো থেকেই টিপু কিবরিয়ার আপলোড করা ছবিগুলো দেখে অনেক বিকৃত রুচির ব্যক্তিরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা টিপু কিবরিয়ার কাছে ছেলে শিশুদের বিভিন্ন রকমের অশ্লীল ছবির চাহিদা দেয় এবং টিপু কিবরিয়া অর্থের বিনিময়ে ছিন্নমূল ছেলে পথশিশুদের ব্যবহার করে তাদের চাহিদা চরিতার্থ করে।’
আসাদুজ্জামান আরও বলেন, ‘অভিযান পরিচালনার সময় তার বাসায় তার ব্যবহৃত ডেস্কটপ পরীক্ষা করে দেখা যায়, সে দুইটি এনক্রিপ্টেড অ্যাপস-এর মাধ্যমে তার ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এ পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে ইতালি, অস্ট্রেলিয়া ও জর্মানির নাগরিকসহ প্রায় ২০/২৫ টি আইডি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। যারা এসব আইডি দিয়ে মূল হোতা টিপু কিবরিয়ার সঙ্গে শিশু পর্নোগ্রাফির বিভিন্ন কনটেন্টের জন্য যোগাযোগ করত।’
সিটিটিসিপ্রধান বলেন, ‘তার ব্যবহৃত ক্যামেরা, পিসি ও ক্লাউড স্টোরেজ থেকে প্রাথমিকভাবে প্রায় ২ হাজার ৫০০ শিশু পর্নোগ্রাফির উদ্দেশ্যে তোলা স্থিরচিত্র ও প্রায় ১০০০ ভিডিও কনটেন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার ডেস্কটপে অসংখ্য ছিন্নমূল ছেলে পথশিশুদের প্রচুর অশ্লীল ছবি ও ভিডিও পাওয়া গিয়েছে।’