× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আরিফের কিডনি গেল কোথায়

ফয়সাল খান

প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৪ ০৯:০৮ এএম

আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৪ ১৫:৪০ পিএম

আরিফ আকন্দ। ছবি : সংগৃহীত

আরিফ আকন্দ। ছবি : সংগৃহীত

‘বাবা’কে কিডনি দানের এক মাস পর মারা গেছেন ২৯ বছর বয়সি আরিফ আকন্দ। শুনলে যে কারও মনে হবে- বাবার জীবন বাঁচাতে সন্তান প্রাণ উৎসর্গ করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু বাস্তবে আরিফের মৃত্যুর আগে তার কিডনি দানের বিষয়টি পরিবারের কেউ জানতেই পারেনি। বাবাকে কিডনি দানের কথা বলা হলেও, আরিফের বাবা মহসীন আলী আকন্দ মারা গেছেন প্রায় ২৭ বছর আগে। মৃত বাবাকে কীভাবে ছেলে কিডনি দান করল তা নিয়ে গোলকধাঁধায় পড়ে যায় পরিবার। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলেও কোনো সদুত্তর পাননি তারা।

স্বজনদের প্রশ্ন, ২৭ বছর আগে মারা যাওয়া বাবাকে দান করার নামে নেওয়া আরিফের কিডনি কোথায় গেল? কাকে, কীভাবে দেওয়া হলো সেই কিডনি তার কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। একজন সুস্থ স্বাভাবিক কর্মক্ষম মানুষের এমন হঠাৎ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কেউ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বগুড়ার আরিফ আকন্দ তার ১১ মাসের ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় ভাড়া থাকতেন। একসময় অভাব-অনটন থাকলেও বাসাবাড়ির ডেকোরেশনের কাজ করে বেশ ভালোই চলছিল তার সংসার। গত বছর ১৭ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন আরিফ। নথিপত্র থেকে দেখা গেছে, এই সময়ের মধ্যেই আরিফের দেহ থেকে কিডনি নেওয়া হয়েছে।

যেভাবে মৃত্যু হলো আরিফের

আরিফ মারা যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর হাসপাতালের পরিচালকের কাছে কিডনি প্রতিস্থাপনের সব কাগজপত্র চেয়ে আবেদন করেন তার বড় ভাই হেলাল আকন্দ। সেই আবেদনে তিনি ভাইয়ের মৃত্যুর পূর্বের সব ঘটনার বিবরণ দেন। তিনি বলেন, আরিফ গত ২২ জানুয়ারি ভোর ৪টা ২২ মিনিটে পেটের ব্যথা নিয়ে কল্যাণপুর ইবনে সিনা মেডিকেলে ভর্তি হয়। ওই দিন দুপুর ১টায় আইসিউতে সে মারা যায়। আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে জানতে পারি চিকিৎসক বলছেন, আমার ভাইয়ের একটা কিডনি নেই। তখন আমার ভাইয়ের বন্ধু ফেরদৌস আমাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের একটি ডকুমেন্ট দিয়ে বলে, আরিফ গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিডেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের ৭ম তলায় ৭০৭ নম্বর বেডে ভর্তি ছিল। পরে আমি ওই হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি, আমার পিতা-মাতার পরিচয় গোপন করে মিথ্যা পিতা-মাতা সাজিয়ে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা নথি তৈরি করে প্রতারক চক্র আমার ভাইয়ের কিডনি নিয়ে যায়। যার কারণে তার মৃত্যু হয়।

বাবার নাম-ঠিকানায় আমূল বদল

আরিফের বাড়ি বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি থানার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুত তারিক জানান, আরিফের পিতা মহসিন আলী আকন্দ কাটখালী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যয়নপত্র অনুযায়ী তিনি ১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর মারা গেছেন।

এদিকে আরিফের ভাইয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল থেকে কিছু কাগজপত্র দেওয়া হয়। যেখানে ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে একটি অঙ্গীকারনামাও সংযুক্ত ছিল। সেসব কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখার পর বোঝা যায়, কিডনি দানের জন্য তৈরি করা ওই অঙ্গীকারনামায় আরিফের নাম, ঠিকানা, বাবা ও মায়ের নামসহ সব ক্ষেত্রেই প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। অঙ্গীকারনামায় আরিফ আকন্দ হয়ে যান আরিফ খান। বাবার নাম লেখা হয় শফিউল আলম খান (নজরুল)। তার বাড়ি লেখা হয়েছে টাঙ্গাইল জেলায়। দেখা গেছে, দুই পাতার অঙ্গীকারনামাসহ সব কাগজপত্রই জাল। জালিয়াতির মাধ্যমেই আরিফের কিডনি নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পরিবারের সদস্যরা।

আরিফের শ্বশুর মো. শহীদ বলেন, তার কিডনি দানের বিষয়টি আমরা জানতাম না। মারা যাওয়ার পর কাগজপত্র দেখে বিষয়টি জেনেছি। ওই সময় (কিডনি দেওয়ার সময়) সে আমার মেয়েকে জানিয়েছিল কাজের জন্য কয়েক দিন বাইরে থাকতে হবে। কিন্তু আরিফ যে হাসপাতালে ভর্তি ছিল সেটা জানায়নি। 

বড় ভাই হেলাল আকন্দ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমার ভাই কীভাবে মরল আমি জানতে চাই। তার এমন কোনো প্রয়োজন ছিল না, যাতে কিডনি বিক্রি করতে হবে। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। 

জালিয়াতি নতুন নয়

বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয় গত বছরের ১৭ জুলাই। প্রথম প্রতিস্থাপনের সময়ই জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির প্রতিবেদনেও জালিয়াতির সত্যতা পাওয়া যায়। তবে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাননি তারা। তখন ওই ঘটনায় প্রতারক চক্রকে শনাক্ত করতে অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন বলে সুপারিশ করা হয়েছিল। সে বিষয়ে কোনো অগ্রগতির তথ্য জানা যায়নি।

সর্বশেষ আরিফের ক্ষেত্রে একই ধরনের ঘটনার অভিযোগের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের কিডনি প্রতিস্থাপন বিভাগের প্রধান ড. হাবিবুর রহমান দুলাল গতকাল রবিবার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করার জন্য আমরা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে পাঠাই। সেগুলো তারা সার্টিফাই করে দেয়। এরপর আমরা কিডনি প্রতিস্থাপন করি। 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোথাও আইন লঙ্ঘন হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য সরকারের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা আছে। কোনো ব্যত্যয় হলে সেটা তারা দেখবে। আইন প্রয়োগ করা আমাদের কাজ না। 

জড়িতদের শাস্তি দাবি

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম খলিল খান গতকাল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কোনো হাসপাতাল যাচাই-বাছাই ছাড়া একজনের কিডনি নিয়ে অন্য কাউকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না। কিডনি নিতে হলে রোগীকে অজ্ঞান করতে হয়। হাসপাতালের ডাক্তার ও স্টাফরা যদি জড়িত না থাকেন, তাহলে এত বড় প্রতারণা হতে পারে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের ধারণাটি বাংলাদেশে নতুন। এতদিন এদেশের মানুষ বিদেশে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করত। দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হলেও নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট আইন ও বিধিমালা প্রয়োজন। 

সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী শরিফ খান মনে করেন, কিডনি প্রতিস্থাপনে জালিয়াতি হয়ে থাকলে অবশ্যই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভিকারিয়াস লায়াবিলিটি রয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় হাসপাতালের কেউ না কেউ জড়িত থাকেন। গত বছর পাকিস্তানে অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর দেহ থেকে কিডনি সরিয়ে ফেলা এবং ধনী গ্রাহকদের কাছে বিক্রির অভিযোগে ফাওয়াদ মুখতার নামের এক চিকিৎসক ও তার দলের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সে দেশের পুলিশ। ফাওয়াদ ৩২৮ জন রোগীর কিডনি চুরি করেছিলেন। 

শরিফ খান আরও বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপন নিয়ে আসা অভিযোগগুলোর সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত না হলে আমাদের দেশেও এমন ঘটনা ঘটতে থাকবে। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা