প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:২৪ এএম
আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৫:১৩ পিএম
জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে রাজধানীর উপকণ্ঠ রূপগঞ্জে হাজার হাজার বিঘা জমি দখল করেছে শিল্পগ্রুপ বসুন্ধরা। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ভূমিখেকো বসুন্ধরার প্রতারণা থেকে বাদ পড়েননি মেয়র-কাউন্সিলরসহ জনপ্রতিনিধিরাও। বসুন্ধরার খপ্পরে পড়ে কাঞ্চন পৌরসভার সাবেক মেয়র দেওয়ান আবুল বাশার ওরফে বাদশা একাই হারিয়েছেন মূল্যবান দুই একর জমি। যার বর্তমান বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকারও বেশি। নামমাত্র টাকা দিয়ে জমিটি দখল করে নিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। ওই জমিতে বসিয়েছে তাদের কয়লা ও রেডিমিক্স কারখানা। মাফিয়া গ্রুপ নামে পরিচিত বসুন্ধরা চুটিয়ে ব্যবসা করলেও জমির মালিককে এখনও তার পাওনা পরিশোধ করছে না। বরং টাকা চাইলে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে।
রূপগঞ্জের কাঞ্চন সেতু পার হলেই চোখে পড়ে প্রায় সাড়ে ৪ একর জমির ওপর নির্মিত বসুন্ধরা গ্রুপের কয়লা ও রেডিমিক্স কারখানার কর্মব্যস্ততা। কিন্তু মূল সড়ক ঘেঁষা বিরাট এই প্রকল্পের সিংহভাগ জমিই যে প্রতারণার মাধ্যমে দখলে নেওয়া, সেটি কজনইবা জানেন? আর যারা জানেন, তারাও অদৃশ্য ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তবে সম্প্রতি বসুন্ধরা গ্রুপের ভূমিদস্যুতাসহ নানা কেলেঙ্কারির একের পর এক ফিরিস্তি গণমাধ্যমে আসতে থাকায় কিছুটা সাহস পেয়েছেন ভুক্তভোগীরা। প্রতিদিনের বাংলাদেশের সরেজমিনকালে নীরবতা ভেঙে মুখ খুলছেন অনেকেই। তাদেরই একজন কাঞ্চন পৌরসভার সাবেক মেয়র দেওয়ান আবুল বাশার ওরফে বাদশা। কাঞ্চন সেতুর পাশে তার দুই একর জমি ছিল। ২০১৮ সালে যার দাম ধরা হয়েছিল ২৫ কোটি টাকা। ওই জমির বিপরীতে মাত্র ৫ কোটি টাকা দিয়ে পুরো জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। তখন বলা হয়েছিল বাকি টাকা জমি রেজিস্ট্রির সঙ্গে সঙ্গেই পরিশোধ করা হবে। কিন্তু পরে একটি টাকাও দেয়নি ভূমিদস্যু বসুন্ধরা গ্রুপ।
সাবেক মেয়র দেওয়ান আবুল বাশার বাদশা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘কাঞ্চন সেতুর কাছে আমার ২০০ শতাংশ বা দুই একর জমি আছে। ২০১৮ সালের শেষদিকে আমি জমিটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিই। এলাকার সাবেক কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান মোল্লা (আসাদ কমিশনার) আমাকে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলমের কাছে নিয়ে যান। সেখানে বসেই শাহ আলম ২৫ কোটি টাকা মূল্য নির্ধারণ করে আমার জমি কিনতে চান। যার অগ্রিম বাবদ কয়েকটি কিস্তিতে আমাকে ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়ে জমি রেজিস্ট্রির সময় অবশিষ্ট টাকা পরিশোধ করা হবে বলে পাকা কথা দেওয়া হয়। আমি সরল বিশ্বাসে একমত হই এবং ২০০ শতাংশ জমি বসুন্ধরাকে রেজিস্ট্রি করে দিই। এরপর টাকা চাইতে গেলে বসুন্ধরার চেয়ারম্যান তার বাড়িতে কিংবা অফিসে আমাকে আর ঢুকতে দেননি। আমাকে বসুন্ধরা থেকে বের করে দিয়েছেন। বিগত সাত বছরে আমার একটি টাকাও পরিশোধ করেননি শাহ আলম। টাকা চাইতে গেলে বসুন্ধরা গ্রুপের পালিত গুন্ডা বাহিনী দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে।’
কাঞ্চন পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান মোল্লা বলেন, ‘মেয়র বাদশার জমিটি নেওয়ার পর বালু ভরাটের দায়িত্ব দেয় আমাকে। পকেট থেকে ২৪ লাখ টাকা খরচ করেছি বালু ভরাটের কাজে। আজ পর্যন্ত একটি টাকাও দেয়নি বসুন্ধরা গ্রুপ।’ তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে আরও বলেন, ‘মেয়র আবুল বাশার বাদশা ভাইকে আমিই প্রস্তাব দিই জায়গাটা বসুন্ধরাকে দিয়ে দেন। উনি আমার কাছে সকল কাগজপত্র দেন। তখন বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকের কাছে গেলাম। দুপক্ষের উপস্থিতিতে ওই জমির দাম ২৫ কোটি টাকা ধার্য হয়। শাহ আলম বায়না হিসেবে কিছু টাকা বাদশা ভাইকে দেন। তারপর আর কোনো টাকা দেননি। আমিসহ বহুবার টাকা উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। টাকা চাইলে উল্টাসিধা কথাবার্তা বলে। ভয়ভীতি দেখায়, হয়রানি করে। এমনকি ওনার অফিসে ঢুকতেও পর্যন্ত দিত না।’
সাবেক মেয়র বাদশা বলেন, ‘শাহ আলম তার গুন্ডাবাহিনী দিয়ে পুরো জায়গা দখল করে রেখেছে। ২০০ শতাংশ কিনে ২৫০ শতাংশ দখল করে কয়লা ফ্যাক্টরি বানিয়েছে। আশপাশের জমিও বসুন্ধরা গ্রুপ জোরপূর্বক দখল করে নিয়ে ফ্যাক্টরি বানিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপের মালিক যে কত বড় প্রতারক; তা আমরা দেশবাসীকে জানাতে চাই। তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। আল্লাহ যেন তার বিচার করেন। পাশাপাশি আমি নিজেই দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, তিনি যেন ভূমিদস্যু এই প্রতারকের সঠিক বিচার করেন। আমি যেন আমার পাওনা টাকা ফেরত পেতে পারি। একই সাথে ভূমিদস্যু গ্রুপটি যেন আমার এবং আমার পরিবারের কোনো ক্ষতিসাধন করতে না পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বসুন্ধরা শুধু এই জায়গাটিই নয়, আশপাশে আরও অনেক এলাকায় জমিজমা গ্রাস করে নিয়েছে। হাজারো মানুষ তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে আহাজারি করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটু আশ্বাস মিললে, সাহস দিলে বসুন্ধরা গ্রুপের ভূমিদস্যুতা নিয়ে শত শত মানুষ মুখ খুলবে।’
সাবেক কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান মোল্লা আরও বলেন, ‘বর্তমানে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষে মুঘল নামে এক ব্যক্তি দখল বাণিজ্য ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। গতকাল সোমবার সকালে মুঘল টেলিফোনে হুমকি দিয়ে বলেছে, জমি নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে পরিণতি ভালো হবে না, প্রাণে মেরে ফেলা হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ভূমি জালজালিয়াতির বিরুদ্ধে সিআরপিতে প্রয়োজনীয় বিধান আছে। এ ধরনের জালজালিয়াতির বিষয়ে প্রয়োজনীয় শাস্তির বিধানও আছে। তিনি আরও বলেন, নতুন ভূমি আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে ভূমিদস্যুরা। তবে শুধু আইন নয়, দস্যুতা ঠেকাতে প্রয়োজন জনসচেতনতাও।