সেলিম আহমেদ
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০০:৫৮ এএম
আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:০০ পিএম
কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ। ছবি : সংগৃহীত
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ। গত বছর এই কলেজের অধ্যক্ষ মো. নওয়াব আলীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। তদন্তে তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য ও ভুয়া বিল ভাউচারে ১ কোটি ৯৩ লাখ ২২ হাজার ১৯৮ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়ায় ডিআইএ ওই টাকা ফেরত আনার জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করে।
গত বছরই রাজধানীর নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, বর্তমান উপাধ্যক্ষসহ ৪৪ জন শিক্ষক-কর্মচারীর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মসহ দুর্নীতির তথ্য উঠে আসে ডিআইএর তদন্তে। তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির উপাধ্যক্ষ এ বি এম বেলাল হোসেন ভূঁঞা অবৈধ পদবি ব্যবহার করে অতিরিক্ত ৪ কোটি ৫ লাখ ৭০ হাজার ৯৫৭ টাকা উত্তোলন করেছেন। ২০১০ সালে সহকারী অধ্যাপক থাকাকালে তিনি অবৈধভাবে উপাধ্যক্ষ-২ পদে যোগদান করেন। অথচ জনবল কাঠামো অনুযায়ী, এক শিফটের ডিগ্রি কলেজে একজন উপাধ্যক্ষের পদ রয়েছে। এ ছাড়া একজন শিক্ষক একাধিক আর্থিক লাভজনক পদেও থাকতে পারেন না।
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া ডিআইএর বার্ষিক প্রতিবেদনে সারা দেশের বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতির এমন চিত্র উঠে এসেছে।
শুধু এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩টি বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে এমন বহু অনিয়ম খুঁজে পায় ডিআইএ। দেখা গেছে অবৈধ নিয়োগ, অতিরিক্ত টাকা উত্তোলনÑ ইত্যাদির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ৪৩ কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার ১৫৬ টাকা। এর মধ্যে জাল সনদে চাকরি নিয়ে ৮৬ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা তুলে নিয়েছেন ১৩ কোটি ৮৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। আর এসব টাকা ফেরত আনার সুপারিশ করার পাশাপাশি অভিযুক্ত শিক্ষক/কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬৩৩ দশমিক ৩৯ একর জমি বেহাত হয়েছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজের বেহাত হওয়া জমির পরিমাণ ৪২৮ দশমিক ৪৬ একর। মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেহাত সম্পত্তি ২০৪ দশমিক ৯৩ একর। ডিআইএ এসব জমি পুনরুদ্ধারের সুপারিশসহ বেহাত হওয়ার কারণ দর্শানোর জন্যও সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দিয়েছে।
ডিআইএ সূত্র জানায়, সারা দেশের ৩৬ হাজার ৭০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে গত অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ প্রতিষ্ঠানের অডিট পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৭টি তদন্ত করা হয়েছে মন্ত্রণালয়, বোর্ড ও দুদকের সুপারিশে। সরেজমিন পরিদর্শন ও অটোমেশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে এই অডিট হয়।
ডিআইএর বার্ষিক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছেÑ তদন্ত শেষে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগীয় জেলার ১ হাজার ৪৮০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ তদন্ত করে ১ হাজার ৩৬৮টি প্রতিষ্ঠানের তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিভাগীয় শাখার ৪০১টি, খুলনার ২৫৩টি, রাজশাহীর ৪০৬টি ও চট্টগ্রামের ৩০৮টি প্রতিষ্ঠান।
এর মধ্যে ঢাকা বিভাগীয় শাখায় আদায়যোগ্য অর্থ ৫ কোটি ৩৩ লাখ ৪৪ হাজার ৯৫ টাকা, চট্টগ্রাম বিভাগীয় শাখায় ৪ কোটি ৭৮ লাখ ৮১ হাজার ৫৪৯ টাকা, খুলনা বিভাগীয় শাখায় ৬ কোটি ৭৮ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৯ টাকা, রাজশাহী বিভাগীয় শাখায় ১২ কোটি ৪২ লাখ ৭০ হাজার ৬৯৩ টাকা।
অন্যদিকে ৬২৩টি কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৫২৩টি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৪১টি এবং মাদ্রাসার ৪৮২টি।
ঢাকা বিভাগীয় শাখায় আদায়যোগ অর্থ ২ কোটি ৬৩ লাখ ২৯ হাজার ৮৮৯ টাকা, চট্টগ্রাম বিভাগীয় শাখায় ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৯ হাজার ৯৭৪ টাকা, খুলনা বিভাগীয় শাখায় ৪ কোটি ১৪ লাখ ১৯ হাজার ১৪৮ টাকা, রাজশাহী বিভাগীয় শাখায় ৪ কোটি ৯৬ লাখ ৫৬ হাজার ২৬৮ টাকা।
এ ব্যাপারে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক প্রফেসর মো. অলিউল্লাহ আজমতগীর বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর নির্দিষ্টসংখ্যক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে প্রতিবেদন তৈরি করি। আমরা শুধু সুপারিশ করতে পারি। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।’
সব প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন কেন করা হয় নাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের বর্তমান জনবল ১৩০। এর মধ্যে ১৩টি পদ খালি।’
৬৩৩.৩৯ একর জমি বেহাত
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬৩৩ দশমিক ৩৯ একর জমি বেহাত হয়েছে (২০২১-২২ অর্থবছরে)। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমি বেহাত হয়েছে ঢাকা বিভাগীয় শাখার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এই বিভাগীয় শাখার মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের ২০৩ দশমিক ৫৬ একর আর কারিগরি এবং মাদ্রসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩১ দশমিক ৮ একর জমি বেহাত হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ হয়েছে, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজের চট্টগ্রাম বিভাগীয় শাখায় ৮০ দশমিক ৭৪ একর, খুলনা বিভাগীয় শাখায় ৭৬ দশমিক ০৯ একর, রাজশাহী বিভাগীয় শাখায় ৬৮ দশমিক ০৫ একর জমি বেহাত হয়েছে।
অন্যদিকে কারিগরি ও মাদ্রাসার ২০৪ দশমিক ৯৩ একর জমির মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগীয় শাখার ৪২ দশমিক ৭৪ একর, খুলনা বিভাগীয় শাখার ১৯ দশমিক ৬৫ একর, রাজশাহী বিভাগীয় শাখার ৯০ দশমিক ৭৭ একর সম্পত্তি বেহাত হয়েছে।
শিক্ষক-কমকর্তা, কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে যথাযথ যাচাই-বাছাই না করার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ একরামুল কবির। গতকাল বুধবার তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, নিয়োগ এবং এমপিও করার সময় সনদ জাল জেনেও কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের নিয়োগ ও এমপিও দিয়ে দিচ্ছেন। এগুলো প্রতিরোধ করতে হবে। নিয়োগের সময় তাদের সার্টিফিকেট সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে যাচাই করতে হবে। এ ছাড়াও যারা অবৈধ নিয়োগ নিয়েছে এবং দিয়েছে তাদের যদি শাস্তির আওতায় আনা যায় তাহলে ভবিষ্যতে এই সমস্যা কমে আসবে।
জমি বেহাতের বিষয়ে তিনি বলেন, ওই সব প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করেন তারা শুধু চাকরি করার জন্যই করেন। এই সুযোগে আশপাশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ওই সব জমি দখল করেন।