× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অনলাইন জুয়ার ফাঁদে সর্বস্বান্ত বহু মানুষ

আনিছুর রহমান

প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:৩৪ পিএম

আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:১৯ পিএম

অনলাইন জুয়ার ফাঁদে সর্বস্বান্ত বহু মানুষ

‘জীবন নিয়ে জুয়া’ খেলার কথা শোনা যায়। কিন্তু খেলা নিয়ে জুয়া যখন কারও কারও জীবনেরই অংশ হয়ে যায় তখন বিষয়টি আর কথার কথা থাকে না! বাস্তবতা হচ্ছে, সর্বনাশা এই নেশার অতলে তলিয়ে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে বহু মানুষকে। অনলাইন জুয়ার সাম্রাজ্য যেন ক্রমেই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ। জুয়ার এই ফাঁদ পাতা ভুবনে পা রাখাটা যত সহজ, বের হয়ে আসাটা ততই কঠিন।

পাড়ার ছোট দোকানদার কিংবা বাস, ট্রাকের ড্রাইভার-হেলপার, শিক্ষার্থী কিংবা চাকরিজীবীÑ নানা পেশার বহু মানুষ জড়িয়ে যাচ্ছে অনলাইন জুয়ায়। কারণ এই খেলায় অংশ নেওয়াটা খুব সহজ। মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই চলে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই সচল জুয়ার এই ‘অদৃশ্য’ আসর।

কয়েক মাস ধরে অনলাইন জুয়ার বিভিন্ন সাইট পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সেখানে প্রতিনিয়ত বাড়ছে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা। কারণ সাত-আট মাস আগে একটি খেলায় যেখানে ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকার বাজি ধরা হতো, এখন তা ছাড়িয়ে গেছে হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল), লংকা প্রিমিয়ার লিগ (এলপিএল), বিগ ব্যাশ লিগের একেকটি ম্যাচে সর্বোচ্চ ১০০০ কোটি টাকার বাজি ধরার নজির রয়েছে। কিন্তু কিছুদিন আগে শেষ হওয়া ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) একটি ম্যাচে বাজির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। একটি সাইটে একটি খেলায় যখন এত টাকার বাজি ধরা হয় তখন অসংখ্য ওয়েবসাইটে অসংখ্য খেলায় বাজির মোট হিসাবটি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। প্রতিদিন অন্তত লাখ-কোটি টাকার বাজি সংঘটিত হয় এসব অনলাইন সাইটে।

এ তো গেল ক্রিকেটের কথা, ফুটবলের জুয়ার বাজারও বিশাল। সম্ভবত আন্দাজ করাও কঠিন হবে। ফুটবলে স্পেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের তারকাবহুল জনপ্রিয় ক্লাবের ম্যাচ ঘিরে চলে জুয়ার রমরমা আয়োজন। এতে সারা বিশ্বের মানুষ অনলাইনের মাধ্যমে খুব সহজেই অংশ নিচ্ছে। অনেক দেশের আইনেই জুয়া খেলা নিষিদ্ধ। তারপরও অবাধে চলছে জুয়া খেলা। এই খেলার জন্য প্রস্তুতি বলতে প্রয়োজন একটি ই-মেইল ঠিকানা, মোবাইল ফোনের নম্বর ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) হিসাব নম্বর। মাত্র পাঁচ মিনিটে জুয়া খেলার সাইটে জমা হয়ে যাচ্ছে অর্থ, যেটা প্রকৃতপক্ষে জুয়ার দান। অনলাইন যুগ শুরুর আগে জুয়ায় অংশ নেওয়া এতটা সহজ ছিল না। এখন সব আয়োজন ঘরেই করা যায় বিধায় বিপুলসংখ্যক মানুষ এতে জড়িয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যাও। 

বাংলাদেশে জুয়া আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হলেও এসব জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন ইউটিউবসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটেও প্রচার হতে দেখা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশেষ খেলাভিত্তিক সাইটগুলোতে এসব অনলাইন বেটিং কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। কোনো ওয়েবসাইট খুললেই চোখে পড়বে ওয়ানএক্সবেট, বেট ৩৬৫, বেটওয়ে, বাজি ৯৯৯, বেটউইনার, বাবুএইটটিএইট, ২২ বেট, ক্রিকেক্সসহ আরও অনেক নামের জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন। এ রকম প্রচারের কারণেও অনেকে আকৃষ্ট হয়ে জুয়ার খাতায় (অনলাইনে) নাম লেখাচ্ছেন। এতে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি দেশের অর্থও পাচার হয়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জুয়ার ওয়েবসাইটগুলোতে বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা জমা করা যাচ্ছে। বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়-এর মতো সব মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস থেকেই টাকা জমা করা যায়। ব্যাংকিং চ্যানেলেও টাকা জমা করার সুযোগ রয়েছে। বিষয়টি পরীক্ষা করতে গিয়ে কিছু ওয়েবসাইটে ঢুকে এই প্রতিবেদক বেশ কয়েকটি পন্থায় টাকা জমা করেন। টাকা জমা ও উত্তোলনের বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব টাকা জমা-উত্তোলনে এমএফএস সার্ভিসের এজেন্টরাই বেশি জড়িত। ব্যাংক ডিপোজিটের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন উদ্যোক্তার নাম বেরিয়ে আসে। বাজি ৯৯৯-এর টাকা ডিপোজিট করার সময় একটি নগদ উদ্যোক্তার নম্বর দেওয়া হয়। ওই নম্বর (০১৬১০৮৫৮৫৫৬) নিয়ে অনুসন্ধান করে দেখা যায় বিসমিল্লাহ ট্রেডার্স নামে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। এভাবে বিকাশ, রকেট ও উপায় নম্বরে ডিপোজিটের জন্য একই ধরনের এজেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে।

ব্যাংকিং চ্যানেলে পাওয়া যায় কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর। ওয়ানএক্সবেটে টাকা জমা দেওয়া যায় মূলত চারটি ব্যাংক থেকে। ইসলামী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের কয়েকটি হিসাব নম্বর পাওয়া যায় অনুসন্ধানকালে। এসব নম্বরের বিপরীতে অ্যাকাউন্ট নম্বর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে কয়েকটি নাম। এগুলোও বিভিন্ন ছোটবড় প্রতিষ্ঠানের নাম। এই যেমন সিটি ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর (১৫০৩৫২৬৪৭০০১), যেটি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ব্রাঞ্চে খোলা। ওই হিসাবের রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের নাম লাইফ স্টাইল জামালগঞ্জ। আরেকটিতে পাওয়া গেছে ব্র্যাক ব্যাংকের (২০৫৫১৯১৬২০০০১) হিসাব নম্বর, যা খোলা হয়েছে তাইব টেলিকম নামে। ডাচ্‌-বাংলার নেক্সাস নম্বরটি (২৯৯১১০০০০৮০৫৯) খোলা হয়েছে আরহাম টেলিকমের নামে। ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের হিসাবটি (১৫৯১১০০০০৮৭১৫) খোলা হয়েছে এইচকিউসি এন্টারপ্রাইজের নামে। সিটি ব্যাংকের হিসাবটি (১৫০৩২২২৮১২০০১) রোহা গার্মেন্টসের নামে খোলা এবং ব্র্যাক ব্যাংকের একটি হিসাব (১০৫৪৯৮২৮০০০০১) পাওয়া গেছে একজন নারীর নামে খোলা। এখানে উল্লেখিত সব কটি অ্যাকাউন্টে অনলাইন জুয়ার টাকা লেনদেন হয়। এর সপক্ষে যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ প্রতিদিনের বাংলাদেশের হাতে রয়েছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এসব লেনদেন নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না, এ বিষয়ে নগদের হেড অব পাবলিক কমিউনিকেশন জাহিদুল ইসলাম সজল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, নগদ সব সময়ই অনলাইন জুয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে। এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। নগদের কোনো উদ্যোক্তা যাতে এ ধরনের কার্যক্রমে জড়িত হতে না পারে সে জন্য সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা রয়েছে। নগদ কর্তৃপক্ষ উদ্যোক্তাদের এসব বিষয়ে সচেতন করে থাকে। তারপরও কখনও কোনো উদ্যোক্তার নামে কোনো অভিযোগে এলে সেটি খতিয়ে দেখার পাশাপাশি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে কোনো গ্রাহক ব্যক্তি টু ব্যক্তি লেনদেন (সেন্ড মানি) কোন প্রেক্ষাপটে করছেন সেটি মনিটরিং করা সম্ভব হয় না।

বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন অ্যান্ড পিআর শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সব ধরনের সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে বিকাশ সব সময়ই সজাগ। কোনো ধরনের সন্দেহ হলে বিকাশ প্রথমে ওই অ্যাকাউন্টের লেনদেন স্থগিত করে এবং তদন্ত শুরু করে। এরপর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়গুলো প্রতিবেদন আকারে পাঠানো হয়। এসব করার জন্য বিকাশের একটি বিশেষ সেল কাজ করে।

তবে ব্যাংক হিসাবে লেনদেন নিয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, সন্দেহজনক কোনো লেনদেন ধরা পড়লে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ওই হিসাবটি বন্ধ করে দেয়। প্রতিদিনই এ ধরনের ১০০ থেকে ২০০টি ব্যাংক হিসাব বন্ধ করা হচ্ছে। এগুলো নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার বিএফআইইউ ও পুলিশ প্রশাসনের। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গণবিজ্ঞপ্তি ও সার্কুলার জারির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকেও সতর্ক করছে। এসব লেনদেন বন্ধে আরও কী করা যায় সেটা নিয়েও চিন্তাভাবনা চলছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, শুরু লেনদেন পর্যবেক্ষণ করে এসব কার্যক্রম বন্ধ করা দুরূহ। অনলাইন জুয়া বন্ধে ওই সব ওয়েবসাইট বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। সেটাই হতে পারে কার্যকর পদক্ষেপ।

প্রসঙ্গত বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ হলেও এর সাজার পরিমাণ খুব নগণ্য। পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, যেকোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী থাকলে তাকে তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হতে পারে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা