শহিদুল ইসলাম রাজী
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৩ ১২:৫৪ পিএম
আপডেট : ১৪ জুন ২০২৩ ১২:৫৫ পিএম
জিনের বাদশা উজ্জ্বল মিয়া।
কিশোরগঞ্জের ব্যবসায়ী মো. ইয়াছিন। গত রমজান মাসে ব্যবসায়িক কাজে ঢাকায় এসে একটি আবাসিক হোটেলে ওঠেন। হঠাৎ গভীর রাতে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে তার মোবাইল ফোনে কল আসে। ফোন ধরতেই অপর প্রান্তে শোনা যায় গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর- ‘আল্লাহর অলি ও জিনের বাদশাহ বলছি। আল্লাহ পাক তোকে কিছু সম্পদ দিয়েছেন। চার হাঁড়ি কাঁচা পয়সা ও তিন হাঁড়ি স্বর্ণমুদ্রা। একেকটা হাঁড়িতে রয়েছে ৪০ কেজি স্বর্ণ। সারা জীবন পায়ের ওপর পা তুলে খেতে পারবি। কোথায় পাবি, কী নিয়মে পাবি পাঁচটা শর্ত বলে দেব। সালাম দিয়ে কলটা কেটে দিয়ে ব্যাক কর।’
কথার শুরুতে কুরআন হাদিস নিয়েও দেওয়া হয় বয়ান। লোভনীয় প্রস্তাব, কোটিপতি হওয়ার সুযোগ! আনন্দে আত্মহারা হয়ে কথিত ‘জিনের বাদশাহ’কে কল ব্যাক করেন ইয়াছিন। তারপর একে একে সম্পদ প্রাপ্তির শর্তগুলো জানান কথিত ‘জিনের বাদশা’। একদিকে সম্পদ প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা, আর কথার ফুলঝুরি! লোভের ফাঁদে আটকা পড়েন ওই ব্যবসায়ী। ধাপে ধাপে তার কাছ থেকে চক্রটি হাতিয়ে নেয় ১৩ লাখ টাকা! কোথায় কাঁচা পয়সা, কোথায় স্বর্ণের মূর্তি বা মুদ্রা! এক সময় হুঁশ ফেরে তার। মোহ কাটিয়ে বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন। এরপর দ্বারস্থ হন গোয়েন্দা পুলিশের।
শুধু কিশোরগঞ্জের ব্যবসায়ী ইয়াছিনই নন, এভাবে কথিত ‘জিনের বাদশা’ নামের প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেক সাধারণ মানুষ। কখনও সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ, সাত রাজার ধন (স্বর্ণের মূর্তি/মুদ্রা) পাইয়ে দেওয়া, অপূর্ণ চাহিদা পূরণের আশ্বাস, নিঃসন্তানদের সন্তান লাভ বা জটিল রোগ থেকে মুক্তি- এভাবে প্রলোভনের ফাঁদ পেতে মানুষকে প্রতারিত করতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় একাধিক চক্র। এমন একটি চক্রের এক প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের সদস্যরা।
গোয়েন্দারা জানান, চক্রটি ‘টার্গেট’ মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন সিম থেকে অ্যাপস ব্যবহার করে ‘জিনের বাদশা’র নামে কণ্ঠ বদল করে কথা বলে। এ চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেক পরিবারই নিঃস্ব হয়ে গেছে। অপরিচিত কেউ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এ ধরনের প্রলোভন দিলে তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি থানায় অবহিত করার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চক্রটি দীর্ঘদিন এভাবে সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে আসছে। তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে শতাধিক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। এ নিয়ে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন গোয়েন্দাদের কাছে।
ভুক্তভোগী ইয়াছিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, গত ৪ এপ্রিল আমি ব্যবসায়িক কাজে ঢাকা গিয়ে মগবাজারে একটি আবাসিক হোটেলে উঠি। ৫ এপ্রিল গভীর রাতে ‘আল্লাহর অলি জিনের বাদশা’ পরিচয় দিয়ে আমাকে ফোন দেওয়া হয়। ফোনে নামাজ কায়েম করা, কুরআন তেলাওয়াত করাসহ বিভিন্ন ধরনের ইসলামিক কথাবার্তা বলা শুরু করে। আমি তার কথার ‘প্রেমে’ পড়ে যাই। এরপর স্বর্ণের মূর্তি দেওয়ার কথা বলে। প্রথমে জায়নামাজ কেনার জন্য বিকাশের মাধ্যমে ৪ হাজার ৮০০ টাকা নেয়। পরে ইফতারি বাবদ নেয় ১৬ হাজার ৫০০ টাকা। এরপর এক রাতে ফোন দিয়ে বলে, তোকে আগে একটা ‘মানিক’ দেওয়া হবে। ‘মানিক’ না হলে স্বর্ণের মূর্তি পাবি না। আর এজন্য তোকে পাঁচ লাখ টাকা ফেলে দিতে হবে।’ তাদের কথামতো টাঙ্গাইল এলেঙ্গা ব্রিজের নিচে পাঁচ লাখ টাকা রেখে আসেন ইয়াছিন। স্বর্ণমুদ্রা ও স্বর্ণমূর্তি প্রাপ্তি, সাপ মারা, সাপকে দুধ খাওয়ানোর কথা বলে পর্যায়ক্রমে তার কাছ থেকে ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এরপর আরও দেড় লাখ টাকা দাবি করে। এক লাখ টাকা দিয়েও দেন ইয়াছিন। এতদিনে হুঁশ ফেরে তার, বুঝতে পারেন প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন। এরপর রমনা থানায় একটি মামলা করেন ভুক্তভোগী ইয়াছিন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. সাইফুর রহমান আজাদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, গভীর রাতে ‘জিনের বাদশা’র ফোন, কুশল বিনিময়, তারপর সৃষ্টিকর্তার নামে ভয় দেখিয়ে শুরু হয় প্রতারণার ফাঁদ। কথার মারপ্যাঁচে সম্পদের মালিক হওয়া থেকে শুরু করে জটিল রোগের সমাধান, সবই করতে পারেন কথিত ‘জিনের বাদশা’- সহজ-সরল মানুষকে এভাবেই বোকা বানিয়ে আখের গুছিয়ে নিচ্ছিল চক্রটি।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ভুক্তভোগীর মামলার তদন্তে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় প্রতারক চক্রটিকে শনাক্ত করা হয়। এরপর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে অভিযান চালিয়ে গত ৯ জুন উজ্জ্বল মিয়া নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। রিমান্ডে উজ্জ্বল বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। তদন্তের স্বার্থে তা বলা যাচ্ছে না। এ চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলে জানান গোয়েন্দা পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
জানা গেছে, আসামি উজ্জ্বল মিয়া বড় ভাই রুবেলের সঙ্গে প্রায় দেড় বছর ধরে এই প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত। আর উজ্জ্বল মিয়ার বড় ভাই রুবেল এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত বছর তিনেক ধরে। উজ্জ্বল বড় ভাই রুবেলের কাছ থেকেই প্রতারণার কৌশল রপ্ত করেছে। প্রথমে তারা বিভিন্ন মোবাইল নম্বর টার্গেট করে। এরপর প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত মোবাইল ফোন থেকে বড় ভাই রুবেল নিজেকে ‘আল্লাহর অলি ও জিনের বাদশা’ পরিচয় দিয়ে ফোন করে। ফোনে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন ও ভীতির সৃষ্টি করে বিকাশের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা।
গ্রেপ্তার উজ্জ্বল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি দেড় বছর আগে থেকে বড় ভাইয়ের মাধ্যমে এ কাজ শুরু করি।’ ইয়াছিনের কাছ থেকে নেওয়া ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে তাকে ৪ লাখ টাকা দেওয়া হয়, আর বাকি টাকা বড় ভাই নিয়ে গেছে বলে জানায় উজ্জ্বল।