ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:৪৯ এএম
প্রতীকী ছবি
দীর্ঘদিন ধরে স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে আইনি সহায়তা খুঁজতে এসে ধর্ষণের শিকার হন এক নারী। স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রতিকারের জন্য অনেক জায়গায় গেছেন। সেই সূত্রে শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে তার পরিচয়। ভুক্তভোগী ওই নারী স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইলে শাহরিয়ার তাকে সহায়তার আশ্বাস দেন। পরে নিজের বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করেন। বর্তমানে ভুক্তভোগী ওই নারী ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওসিসিতে (ওয়ান স্টপ ক্রাইসি সেন্টার) ভর্তি আছেন।
ওসিসিতে গিয়ে জানা যায়, তার অবস্থা এখন আগের চেয়ে ভালো। তিনি একাই আছেন হাসপাতালে। আসামিকে গ্রেপ্তার করা হলেও তা এখনও ইনভেস্টিগেশনের মধ্যে রয়েছে। সেখানে দাযিত্বপ্রাপ্ত একজন জানান, ওই নারী ঢাকায় থাকেন না। স্বামীর সঙ্গে সমস্যা হচ্ছিল। ভাইয়ের বাসায় এসেছিলেন। এ ঘটনার পর প্রথমে ভয় পেলেও পরে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন।
ঢামেকের ওসিসিতে এখন ভর্তি আছেন ৭ জন ভুক্তভোগী। গতকাল ছিলেন ১১ জন। শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীরাই এখানে সেবা নেন। তবে এর মধ্যে ৪০ শতাংশই ধর্ষণের শিকার। শিশুরাও এ ঘটনা থেকে বাদ পড়েনি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরে সেক্সুয়াল অ্যাসাল্টের ঘটনায় ওসিসিতে আসেন ১৫২ জন নারী ও শিশু। এর মধ্যে অপহরণ, ধর্ষণচেষ্টা ও ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুও ছিলেন। এ ছাড়া ছেলেশিশুরাও এই যৌন হয়রানির বাইরে নয়। গত জানুয়ারিতে ২৫ জন ভুক্তভোগী ওসিসির সেবা নিতে আসেন। এ মাসে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আসেন ২৪ জন। ওসিসির দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন এর মধ্যে ৪০ শতাংশই ধর্ষণের ঘটনা।
সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি চলন্ত বাসে ডাকাতি করতে এসে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি বাসে
ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি তবে শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে। সেদিন বাসে থাকা এক ভুক্তভোগী নারী বলেন, একটি মেয়ের সঙ্গে তার স্বামী ও ভাই ছিলেন। ডাকাত দলের দুইজন মেয়েটিকে টেনেহিঁচড়ে বাসের পেছনের সিটে নিয়ে যায়। পরে সবার সামনে মেয়েটাকে শারীরিক নির্যাতন করে। অন্য নারীদের শরীরের স্পর্শকাতর স্থানেও স্পর্শ করে তারা। মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। সেদিন শারীরিক শ্লীলতাহানির শিকার হন তিনিও। কথাগুলো বলতে বলতে কাঁপছিলেন তিনি।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ফুল সংগ্রহ করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয় ১১ বছর বয়সি এক শিশু। ধর্ষণের শিকার শিশুটি দিনমজুরের মেয়ে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে স্কুলের শহীদ বেদিতে ফুল দেওয়ার জন্য রুহুল আমিন নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে ফুল আনতে গিয়েছিল শিশুটি। তখন রুহুল আমিন তাকে জোর করে ঘরে নিয়ে নির্যাতন করেন। পরে শিশুটির পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়। ভুক্তভোগী শিশুর পরিবারের এক সদস্য বলেন, অভিযুক্ত রুহুল আমিনের পরিবার এলাকায় প্রভাবশালী। অভিযুক্তের স্বজনেরা বিষয়টি কাউকে না জানাতে তাদের হুমকি দেন। তারা শিশুটিকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি না করতে চাপ দেন। এরে আগে ১৬ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে পদ্মার চরে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন আরেক নারী। এ ঘটনায় তিন তরুণকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা জানতে পেরে মা বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। দুপুরে কিশোরীটি তার ৩ থেকে ৪ জন বান্ধবীর সঙ্গে ঝিনাইগাতীর গজনী অবকাশকেন্দ্রে বেড়াতে যায়। সেখানে ইলিয়াছ নামের পূর্বপরিচিত একজন তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন।
মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শূন্যের পর্যায়ে আছে। সরকার মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে সব চলে গেছে। পত্রিকা খুললেই প্রতিদিন নারী নির্যাতন, ধর্ষণের খবর পাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে দেশটা পঙ্গু হয়ে যাবে। সুষ্ঠু সভ্যসমাজের চেহারা দেখতে পাচ্ছি না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৮টি, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৩ জনকে, আত্মহত্যা করেছে ১ জন, ধর্ষণচেষ্টা হয়েছে ২টি। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে জানুয়ারিতে। গত বছরের আগস্টে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৭টি, সেপ্টেম্বরে ২৬টি, অক্টোবরে ৩৯টি, নভেম্বরে ১৫টি, ডিসেম্বরে ২৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে নারী শিশু দমন আইনে মামলা হয়েছে ১০৭২টি, সেপ্টেম্বরে ১৫৭৮টি, অক্টোবরে ১৫৬০টি, নভেম্বরে ১৪৫২, ডিসেম্বরে ১২০৫টি। এ বছরে জানুয়ারিতে মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৪৪০টি।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা এবং ডাকাতিসহ বাসে নারী যাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন নারীরা। ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা যেন আর একটিও না ঘটেÑ বলছেন মানবাধিকার কর্মীরা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেন, যেকোনো দেশই যখন সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়ে, তখন নারীরাই শিকার হয়। পৃথিবীর যেকোনো দেশেই যুদ্ধাবস্থায় নারীদের আলাদা করে টার্গেট করা হয়। গণঅভ্যুথানের পর এখানে চার দিন কোনো সরকার ছিল না। তারপর পালাবদল হয়েছে সেটা স্মুদলি হয়নি। যার কারণে এখানে যে স্টেকহোল্ডাররা আছেন তাদের বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক কার্যক্রমও রয়েছে। দেশকে অস্থিতিশীলতা দেখালে যে দল সুবিধা পাবে তারাও এক ধরনের এসব কাজে জড়িত। পুলিশ এখনও নিষ্ক্রিয় রয়েছে। তারা কোনো ধরনের সহায়তা দিচ্ছে না। সবকিছু মিলিয়ে যে ঘটনা ঘটছে তা কোনোভাবে কাম্য নয়।
তিনি বলেন, এখন আমাদের প্রথমে এক্সেপ্ট করতে হবে যে ঘটনাটা ঘটেছে। বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যাবে না। অনেক ক্রিমিনালকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তারা তো চুপচাপ বসে নেই। এখন অপরাধী যে-ই হোক দলীয় পরিচয় সবকিছুর শেষে সে একজন ক্রিমিনাল। তাকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যেন কেউ আর এ কাজ করার সাহস না পায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, সংকট যত বাড়তে থাকে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়তে থাকে। এখন যা ঘটছে তা আরও ভয়ংকর। যেখানে একটি ঘটনাও হওয়া উচিত না, সেখানে এত ঘটনা ঘটছে। শুধু আইনের ওপর নির্ভর করলেই হবে না পারিবারিকভাবে শিক্ষা দিতে হবে। যখন যে সরকারই আসুকÑ নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। এখন গ্রামে-শহরে বিভিন্ন জায়গায় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আগে যা হয়েছে, এখন যেন আর একটাও ঘটনা না ঘটে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আর একটি ঘটনাও আমরা দেখতে চাই না। অতি দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।