× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অনিয়ম-দুর্নীতি

নকশিকাঁথায় লুটের ছক আজমের

আরমান হেকিম

প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:০৬ এএম

আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:১৪ এএম

প্রবা গ্রাফিক্স

প্রবা গ্রাফিক্স

খাস জমি রেখে কৃষকের তিন ফসলি জমি অধিগ্রহণ করে জামালপুরে ‘নকশিপল্লী’ করার উদ‍্যোগ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। যেখানে ৭২২ কোটি টাকার প্রকল্পে প্রথমে সম্ভাব‍্য সমীক্ষা করা হয়নি। অথচ ৫০ কোটি টাকার অধিক ব‍্যয়ের প্রকল্প গ্রহণ করলেই সমীক্ষা করা বাধ‍্যতামূলক। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এবং নানা আপত্তির পরেও চাপ প্রয়োগ করে অনুমোদন করানো হয়েছিল প্রকল্পটি। এটির নেপথ‍্যে কারিগর ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও জামালপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম।

পরিকল্পনা কমিশনের তৎকালীন এক সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রকল্পটি অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রায় ৩০০ জন কারিগর থাকলেও ১ হাজার ২০০ জনের পুনর্বাসনের ব‍্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিলাসী ব্যবস্থাপনার প্রকল্পটির আওতায় থিমপার্ক, লেকপার্ক, খেলার মাঠ, ডকইয়ার্ড, ভাসমান রেস্টুরেন্ট, অ্যাম্ফিথিয়েটার, সিটিং এরিয়া ও রেস্ট হাউস নির্মাণের ব‍্যবস্থা রাখা হয়েছিল। এ ছাড়া আরও নানা অসংগতি ছিল। এগুলোর বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আমরা তখনকার পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানকে জানিয়েছিলাম। মন্ত্রী তখন উত্তর দিয়েছিলেন, এটাতে আমার কিছু করার নেই। এটি মির্জা আজম প্রধানমন্ত্রীর কাছে চেয়ে পাস করিয়ে নিচ্ছেন। এটি ফসলি জমির ক্ষতি করবে, কোনো কাজে আসবে না। 

স্থানীয়দের অভিযোগ, ভূমি অধিগ্রহণের টাকা আত্মসাৎ ও নিজের নাম ফুটানোর জন‍্যই প্রকল্পটি নিয়েছিলেন মির্জা আজম। এর আগেও অন‍্যান‍্য প্রকল্পে তিনি ভূমি অধিগ্রহণের অর্থ আত্মসাৎ করেছিলেন। অনেকে টাকা চাইলে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করেছেন। 
কৃষক ও গৃহবধূরা বলছেন, প্রকল্পের জন‍্য যে ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে সেসব জমিতে তারা আমন ধান, বোরো ধান, পাট, মরিচ, সরিষা, কপি, গোল আলু, মিষ্টিআলু, টমেটো, মুলা, গাজর, বেগুন, লাউসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল ও সবজি আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। আর যারা নকশির কাজ করেন তারা গৃহস্থালির সব কাজ করে। এরপর অবসরে নকশির কাজ করে। যারা প্রফেশনালি কাজ করেন, তারা স্থানীয় কয়েকটি এনজিওতে চাকরি করেন। এই সংখ‍্যা খুবই কম। সে হিসেবে এখানে নকশিপল্লীর কোনো দরকারই ছিল না।

ছয় বছরেও কোনো কাজ হয়নি, ক্ষোভে ফুঁসছেন স্থানীয়রা

সরেজমিনে ঝিনাইনদের তীরে নকশিপল্লীর জন‍্য নির্ধারিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয়রা শীতের নানা ধরনের ফসল ফলিয়েছেন। প্রতিবেদককে দেখে রফিক নামের এক কৃষক এগিয়ে এসে জানান, তাদের এলাকার কেউ এখানে নকশিপল্লী চান না। তারা চাষাবাদ করে জীবনযাপন করতে চান। তিনি দূরের স্টিলের ব্রিজ দেখিয়ে বলেন, ওখান থেকে শুরু করে ওই গাছ পর্যন্ত পল্লী করা হবে। দেখেন তো এই জায়গার মধ্যে কোনো জায়গা কি খালি পড়ে আছে? সব জায়গাতেই তো চাষ হচ্ছে।

জামালপুরের হাট চন্দা এলাকার মফিজ নামে আরেক কৃষক বলেন, ‘আমার জমি যদি সরকার নিয়ে নেয়, আমি বেকার হয়ে যাব। আমার জমি অত্যন্ত উর্বর, এখানে বছরে তিনটি ফসল হয়Ñ ধান, সরিষা, শসা, পাট সবই ফলাতে পারি।’
নকশিকর্মী জায়েদা আক্তার ট্রিপা বলেন, ‘আমাদের জমি যদি সরকার নকশিপল্লী প্রকল্পের জন্য নিয়ে নেয়, তারা তো টাকা দিয়েই নেবে। কিন্তু সেই টাকায় কতদিন চলতে পারব? আমাদের জমি থাকলে সারা জীবন ফসল লাগিয়ে খেতে পারব। তাই জমি বিক্রি করা আমাদের জন্য বড় ক্ষতি।’ 
গৃহিণী শাহিনুর বলেন, ‘আমরা বাড়ির সব কাজ শেষ করে অবসর সময়ে নকশির কাজ করি। যারা নকশির কাজকে চাকরি হিসেবে নিয়েছে তারা স্থানীয় কয়কটি এনজিওতে গিয়ে কাজ করে। এই সংখ‍্যা খুব কম। বেশিরভাগ মানুষই বাসায় বসে কাজ করে। পল্লীর দরকার আছে বলে আমরা মনে করি না।’ 
আপনাদের ক্ষতি করে মির্জা আজম এই প্রকল্প নিতে চাচ্ছেন কেন, তার কি এখানে কোনো জমি আছেÑ এমন প্রশ্নে স্থানীয় মুদি দোকানদার আলফাজ বলেন, ‘আজম সাহেবের এখানে কোনো জমি নাই। তার আত্মীয়দের কিছু থাকতে পারে।’ 
তাহলে তার লাভ কি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যখন জামালপুর মহাসড়ক করা হয়, তখন ভূমি অধিগ্রহণ হয়। রাস্তার পাশে যাদের বাড়ি ছিল সবার জায়গাই রাস্তায় গেছে। প্রথম কিস্তির টাকা আজম সাহেব তার বাড়িতে নিয়ে সবাইকে দেন, পরে আর কোনো টাকা পায়নি কেউই। সবার টাকার দায়িত্ব নিয়েছিল আজম সাহেব। কেউ টাকা চাইতে গেলে সে নানা তালবাহানা করে তাড়িয়ে দিত। কেউ জোরাজুরি করলে তার বাসায় পুলিশ পাঠিয়ে হয়রানি করা হতো। তিনি সবার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এই প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের টাকাও তিনি এভাবে খেয়ে ফেলতেন।
কৃষক আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমার ৫২ শতাংশ জমি রয়েছে। এখানে তিনটি ফসল হয়ে থাকে। এক লাখ টাকা ইনকাম হয়, এই টাকা দিয়ে আমার ৮ জনের পরিবার চলে। জমি চলে গেলে আমি কী করে খাব। আমরা চাই না এখানে নকশিপল্লী হোক, আমরা আমাদের জমি চাই।’

বাদ যাচ্ছে হাসিনার নাম, ব‍্যয় কমছে ৭২ শতাংশ 

শেখ হাসিনা নকশিপল্লী প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে ‘জামালপুর নকশিপল্লী’ করা হচ্ছে, যা প্রকল্পের খরচ ৭২ শতাংশ কমানোর প্রস্তাবসহ নতুন ডিপিপি (ডিটেইলড প্রজেক্ট প্রপোজাল) তৈরি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। 
এ বিষয়ে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন প্রধান মো. আয়ুব আলী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রকল্পটির মেয়াদ পাঁচ বছর হয়ে গেলেও এখনও কোনো অর্থ ছাড় হয়নি। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল ছোট আকারে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার। তবে পরবর্তীতে এটি বড় আকারে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার ফলে প্রচুর কৃষিজমি নষ্ট করতে হতো।’ 

তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটির আকারের পরিবর্তনের ফলে প্রকল্পের খরচও বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রথমে এটি ৭২২ কোটি টাকা বাজেটে করার পরিকল্পনা ছিল। তবে এখন তা কমিয়ে ২০০ কোটি টাকার মধ্যে করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫০০ উদ্যোক্তার জন্য নকশিপল্লী তৈরি করার প্রস্তাব পাঠানোর কথা ভাবা হচ্ছে, পূর্বে ৩ হাজার ৫০০ উদ্যোক্তার জন্য করার কথা ছিল।’ 
তিনি আরও বলেন, ‘উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে কাঁচামাল সংগ্রহ। তাই কাঁচামাল সাপোর্ট দেওয়ার জন্য একটি টেক্সটাইল ইউনিট তৈরি করা হবে। এ ছাড়া, সেখানে একটি বিশ্বমানের ডিসপ্লে সেন্টার এবং সপ্তাহে একটি হাট বসানোর পরিকল্পনাও রয়েছে, যেখানে নকশিপণ্য কিনতে পারবে দেশি ও বিদেশি ক্রেতারা।’

এই প্রকল্পটির মাধ্যমে উদ্যোক্তারা দুইভাবে পণ্য উৎপাদন করবেনÑ একদিকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে, আরেকদিকে ক্লাস্টারভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকবে। তবে, এখানেও কৃষকদের জমি রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করা হবে বলে তিনি জানান। 
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রভাবে অনেক প্রকল্প অনুমোদন হয়েছিল। তবে এখন তা পর্যালোচনার পর করা হচ্ছে। যদি কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত না হয়, তবে সরকারের অর্থনৈতিক টেকসইতা এবং মানুষের স্বার্থের জন্যই বাদ দেওয়া হবে।’

ছয় বছরেও অগ্রগতি শূন‍্য, ব‍্যয় নিয়ে নানা প্রশ্ন

‘শেখ হাসিনা নকশিপল্লী’ প্রকল্পটি জামালপুরের কম্পুর এলাকায় শিল্পী, হস্তশিল্পী এবং তাঁতিদের জন্য একটি বিশেষায়িত অঞ্চল তৈরির উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল। ২০১৯ সাল থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল। ছয় বছর পার হলেও প্রকল্পটির কোনো কাজ হয়নি। তবে কর্মকর্তারা বসে বসে তাদের বেতন-ভাতা পেয়েছেন। প্রকল্পটির মোট ব্যয় পরিকল্পনা ছিল ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। প্রথম পর্যায়ে জমি অধিগ্রহণ ও ভূমি উন্নয়নের জন্য ৭৭২ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ১০০ একরের জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা ছিল। তবে পরে তা ৩০০ একর করা হয়। মির্জা আজম ছোট পরিসরে করতে চাননি বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিলাসী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটির আওতায় থিমপার্ক, লেকপার্ক, খেলার মাঠ, ডকইয়ার্ড, ভাসমান রেস্টুরেন্ট, অ্যাম্ফিথিয়েটার, সিটিং এরিয়া ও রেস্ট হাউস নির্মাণের সংস্থান রয়েছে। এ বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে দরিদ্র নকশিশিল্পীদের পুনর্বাসনে। এমন প্রকল্পের আওতায় এসব স্থাপনা নির্মাণ যৌক্তিক বলে মনে হয় না। প্রকল্প অনুমোদনে সমীক্ষা না করার পাশাপাশি আরও কিছু ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করা হয়েছিল। 
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা