পারভেজ খান
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:১৪ এএম
আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ১০:২৫ এএম
আগস্টের পর রাজধানীতে হঠাৎ করে ডাকাতির ঘটনা বেড়ে গেলেও এলাকাভিত্তিক গণপ্রতিরোধের মুখে সেই পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কিন্তু ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। পুলিশ ও র্যাবের সূত্রমতে, রাজধানীতে ছিনতাই যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। মাসে ঘটছে শতাধিক ঘটনা। সব ঘটনা আবার জানাজানিও হয় না। ঢাকার দেড় শতাধিক স্পট এখন ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আতঙ্ক বেড়েছে পথচারীদের মনে। তাই সন্ধ্যা নামলেই এখন অনেক স্থানেই লোক চলাচল কমে আসে। ভয় আর অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করছেন সেখানকার বাসিন্দারা। বিশেষ করে একটু রাত করে যাদের বাড়ি ফিরতে হয়, তারা ভোগেন ভীষণ টেনশনে। পুলিশ বলছে, সেনা, র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযান চলছে পুরো ঢাকা শহরে। এর ফলে পরিস্থিতি শিগগির স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
পুলিশ, বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং ঢাকার চারটি সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সূত্রমতে, গত আগস্ট থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ৪২৮টি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আহত হয়ে ৪৩৪ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। যারা চিকিৎসা নিয়েছেন এটা শুধু তাদের হিসাব। ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েকগুণ বেশি। পুলিশের ভাষ্য, অধিকাংশ ঘটনাতেই থানায় মামলা বা জিডি হয় না। বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই কোনো লিখিত অভিযোগ করেন না। ছিনতাইয়ের ঘটনায় খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হলে খুব কম মানুষই থানা-পুলিশ করতে যান। ফলে যে হারে ছিনতাই ঘটে, সে তুলনায় থানায় মামলার সংখ্যা কম।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্টে ৩৮, সেপ্টেম্বরে ১৫ ও অক্টোবরে ৩২টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। এই পরিসংখ্যান সামনে রাখলেও দেখা যাবে, সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে দ্বিগুণ।
একটি এলাকার খণ্ডচিত্র
রাজধানীর উত্তরা এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মীর আজম এই প্রতিবেদককে জানান, অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের নাম বেশি আলোচনায় এসেছে। কিন্তু তার কাছে মনে হয়েছে, উত্তরা এলাকার অবস্থা আরও বেশি ভয়াবহ। সন্ধ্যার পরপর এই এলাকার সড়কগুলোতে একটা আলো-আঁধারি পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা আতঙ্ক হয়ে নেমে আসে। মাঝেমধ্যে যৌথ বাহিনীর অভিযান ছাড়া পুলিশের কোনো টহল নেই বললেই চলে। এখানকার ছিনতাইকারীদের বেশিরভাগই গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকার মাদকসেবী। অপরাধ করেই তারা আবার নিজ এলাকায় ফিরে যায়। বিমানবন্দর গোলচত্বর থেকে আবদুল্লাহপুর ব্রিজ পর্যন্ত অপরাধের হার সবচেয়ে বেশি। এখানে একাধিক টানা পার্টি ছুরি ও সুইচ গিয়ার চাকু হাতে সক্রিয় থাকে। দিনে থাকে মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি ও পকেটমার। প্রতিদিন এই এলাকায় গড়ে ১০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঝামেলা এড়িয়ে চলতে ভুক্তভোগীরা থানায় যান না।
জানা যায়, গত ২৫ অক্টোবর পাবনা থেকে বাসে চেপে ঢাকায় আসেন ব্যবসায়ী রফিক মোল্লা। ভোরে নামেন উত্তরা জসীমউদদীন রোডে। বাসায় যাওয়ার জন্য রিকশা বা সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ওই সময় হঠাৎ চার-পাঁচ যুবক এসে ছুরি মেরে তার কাছে থাকা মোবাইল ফোন, মানিব্যাগসহ সবকিছু কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।
গত ২ অক্টোবর আত্মীয়কে বিদায় জানাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন সবজি বিক্রেতা আলমগীর। রাত ১২টার দিকে উত্তরার প্রধান সড়কে মাইক্রোবাসে আসা কয়েক দুর্বৃত্ত নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে মারধর করে তার টাকা ছিনিয়ে নেয়।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, উত্তরা হাউস বিল্ডিং, আবদুল্লাহপুর ব্রিজ ও বিমানবন্দর গোলচত্বর এলাকায় বহিরাগত ও মাদকাসক্তদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। তারাই সংঘবদ্ধভাবে ছিনতাই করছে। কেবল অক্টোবরেই সন্দেহভাজন ৬৭ ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে বিমানবন্দর থানা পুলিশ। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের স্বল্পমেয়াদের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।
ডিএমপির উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার আহমেদ আলী বলেন, এই এলাকার তিন স্পটে ছিনতাই বেশি হচ্ছে। ভোরে কিংবা রাতে বাইরে থেকে আসা যাত্রীরা নামলে, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসে এসে ছোঁ মেরে জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। জড়িতদের বেশিরভাগই উত্তরার আশপাশের বাসিন্দা। এসব স্পটে পুলিশকে সতর্ক রাখা হয়েছে।
ছিনতাইয়ের যত হটস্পট
পুলিশ ও র্যাবের তথ্যমতে, রাজধানীর দেড় শতাধিক পয়েন্ট ছিনতাইয়ের ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে, মতিঝিল ব্যাংকপাড়া, বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড ও স্টপেজ, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, ধানমন্ডি লেক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, চন্দ্রিমা উদ্যান, গাবতলী থেকে শুরু করে মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছন পর্যন্ত বেড়িবাঁধ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও সংলগ্ন এলাকা, রমনা পার্ক ও পাশের রাস্তা, রায়ের বাজার, হাজারীবাগ, লালবাগ কেল্লার মোড়-শহীদনগর-কালুনগর, মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পসহ পুরো মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা এলাকা, নীলক্ষেত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, তিতুমীর কলেজ এলাকা, ঢাকা কলেজের সামনের সড়ক, মিরপুর মাজার রোড, ১০ নম্বর গোল চত্বর, বেনারসী পল্লী ও বাঙলা কলেজ এলাকা, পল্লবী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের রাস্তা, পুরান ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ এবং কামরাঙ্গীরচর এলাকা। তালিকায় আরও রয়েছে বিমানবন্দর এলাকা ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনসহ গোলচত্বর এলাকা, গুলিস্তান, শান্তিনগর, শাহজাহানপুর রেল কলোনি ও মতিঝিল এজিবি কলোনি, মুগদাপাড়া, মাণ্ডা ও বাসাবোর নিচু এলাকা, মাদারটেক, মহাখালী, সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাসস্ট্যান্ড, ফকিরেরপুল-আরামবাগ, সদরঘাট, তেজগাঁও রেলস্টেশন, কারওয়ান বাজার এলাকা, হাতিরঝিল, ভাটারা থানা এলাকার ৩০০ ফুট ও ১০০ ফুট সড়ক এবং উত্তরার আশকোনা ও দিয়াবাড়ী। এ ছাড়াও রাজধানীর সব ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাসে প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
ঝোপ বুঝে কোপ মারে ছিনতাইকারীরা
ছিনতাইয়ের সময় কখন আর টার্গেট হন কারা- এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাবের নিজস্ব গবেষণা রয়েছে। মূলত সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ভোর পর্যন্তই রাজধানীতে ছিনতাই বেশি ঘটে। অলিগলিতে সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয়। প্রধান সড়কগুলোতে বাড়ে রাত একটু গভীর হলেই। যদিও আগে থেকে টার্গেট করা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কোনো সময় নির্দিষ্ট করা থাকে না। সাধারণত বেশি পরিমাণে টাকা-পয়সা বহনকারীরাই এদের টার্গেট। তবে এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় তারা টার্গেটকে একাধিক দিন অনুসরণ করে এবং নির্দিষ্ট সোর্সের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েই অভিযান চালায়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা উত্তোলন বা জমাদানকারী, রাত ১১টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত চলাচলকারী ব্যক্তি, রমজান মাসে ইফতারের আগে ও জুমার নামাজ পড়তে বের হওয়া ব্যক্তি, লেক ও পার্কে ঘুরতে বের হওয়া দর্শণার্থী, গাড়িতে বসে মোবাইলে কথা বলা ব্যক্তি, গাড়িতে ভাড়া শেয়ার করায় আগ্রহী ব্যক্তি, জুয়েলারি ব্যবসায়ী, প্রবাসী, ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহারকারী, রিকশা বা সিএনজিতে অসতর্কভাবে বসে থাকা ব্যক্তিরা সচরাচর ছিনতাইকারীর শিকারে পরিণত হন। রাস্তায় টহলরত পুলিশ বা আনসার সদস্যদের এরা নজরদারিতে রাখলেও এমন অভিযোগও রয়েছে যে, কখনও কখনও পুলিশের সঙ্গে তাদের একটা বোঝাপড়া হয়ে থাকে। কিছু ঘটনায় এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
ছিনতাইকারী কত প্রকার ও কী কী!
পুলিশের পরিভাষায় ছিনতাকারী চার প্রকার। পেশাদার, মাদকাসক্ত, টানা পার্টি ও শৌখিন। এই চার প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে পেশাদার ও মাদকাসক্তরা। ছিনতাইয়ের সময় একটু এদিক-সেদিক হলে কাউকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা বোধ করে না এই অপরাধীরা।
পেশাদার : এদের ক্ষেত্রে ছিনতাই করাটাই একমাত্র পেশা। রাজধানীতে এই চক্রই সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। এরা যথেষ্ট সংঘবদ্ধও থাকে। এরা কবে কোন এলাকায় এবং কখন ছিনতাই করবেÑ সেটা পরিকল্পনা করেই মাঠে নামে। অনেক সময় আগে থেকে পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ করে থাকে। কোন এলাকায় কোন দিন কোন পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে টহল হবে, র্যাবের অভিযান আছে কি নেই, সেনা টহল হবে কিনাÑ এগুলো আগে থেকে জেনে নিয়েই তারা সুবিধামতো স্পট নির্ধারণ করে। পুলিশ এবং এই ছিনতাইকারীদের পরিভাষায় তাদের নাম ‘কামলা’। এই সিন্ডিকেটের একটি অংশ গাড়িচালক পেশা বেছে নিয়ে ভয়াবহ ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের শনাক্ত ও আটক করার ক্ষেত্রেও বিপাকে পড়ছে পুলিশ। বিমানবন্দর, সদরঘাট, কমলাপুরসহ বাস, নৌ ও রেলস্টেশন বা টার্মিনালগুলো এদের প্রধান স্পট। চালকবেশে বিদেশ থেকে বা ঢাকার বাইরে থেকে আসা যাত্রীদের উঠিয়ে নিয়ে সুবিধামতো জায়গায় গিয়ে এরা সর্বস্ব লুটে নেয়। যাত্রী একা ও নারী হলে ধর্ষণের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। এই পেশাদার ছিনতাইকারীরা অনেক ক্ষেত্রে মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল এবং প্রাইভেট কারও ব্যবহার করে।
মাদকাসক্ত : এই চক্র অনেক বেশি ভয়ংকর ও নির্মম। রাজধানীতে এখন এই চক্রের সংখ্যাই বেশি। এদের সবাই বিভিন্ন নেশায় আসক্ত। নেশাগ্রস্ত অবস্থাতেই অনেক সময় তারা মাঠে নামে এবং কাউকে আঘাত করতে বিন্দুমাত্র চিন্তাভাবনা করে না। হত্যার উদ্দেশ্যে এরা কাউকে আঘাত না করলেও তাদের এলোপাতাড়ি চাপাতি বা ছুরির আঘাতে এ পর্যন্ত অনেকেরই মৃত্যু ঘটেছে। কেবল বস্তি বা নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে নয়, অনেক সম্ভ্রান্ত ও ধনী পরিবারের নেশায় আসক্ত সন্তানরাও এই পেশায় নেমেছে।
শৌখিন : বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ ছিনতাইয়ে জড়িত বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। এই চক্র রাতে পলাশী, চানখাঁরপুল, শিববাড়ী, শহীদ মিনার, শাহবাগসহ আশপাশের এলাকায় মোটরসাইকেলে ঘোরে ও আড্ডা দেয়। এরাও অনেক সময় সিগারেট বা নেশার টাকার জন্য ছিনতাই করে থাকে। এদের ছিনতাইয়ের একটি কৌশল হচ্ছেÑ নিজেদের মোটরসাইকেলের সঙ্গে ইচ্ছাকৃত অন্য কারও মোটরসাইকেলের টক্কর লাগানো। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তিকে হলে ধরে নিয়ে মারধর করবে বলে ভয় দেখায় এবং শেষ পর্যন্ত নগদ যা পায় তা রেখে তাকে তাড়িয়ে দেয়। এরা পুলিশের কাছে শৌখিন ছিনতাইকারী হিসেবে পরিচিত। তবে এরা সাধারণত ছুরিকাঘাত বা হত্যার মতো ঘটনা ঘটায় না।
টানা পার্টি : টানা পার্টি হচ্ছে ছিনতাইকারীদের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নস্তরের। ছিনতাইকারীদের ভাষায় এদের ‘অজাত-কুজাত’ বা ছোট জাতের বলে পরিচয় দেওয়া হয়। এরা সাধারণত কোনো পথচারী, রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, জানালা খোলা রাখা প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, ট্রেন বা বাসযাত্রীদের হাতে থাকা মোবাইল ফোন, ব্যাগ, গলার চেইন, কানের গয়না, এসব থাবা দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। ট্রাফিক জ্যামে এরা বেশি তৎপর থাকে। অনেকে মোটরসাইকেলে করেও এসব ঘটনা ঘটায়। সাধারণত মোটরসাইকেলের পেছনে বসা একজন থাবা মারার কাজটা করে। টানা পার্টির ছিনতাইকারীরা মোটরসাইকেলে ভুয়া নাম্বার প্লেট আর পুরো মুখ ঢেকে রাখা হেলমেট ব্যবহার করে থাকে। এরা সরাসরি কাউকে আঘাত না করলেও তাদের হ্যাঁচকা টানের জেরে রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে অনেকে গুরুতর আহত হন। এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
র্যাব-পুলিশের ভাষ্য
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ মাইনুল হাসান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ঢাকায় এখন পুলিশের যেসব সদস্য মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন তাদের অধিকাংশই নতুন। যানবাহনের স্বল্পতাও রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের ১৭৭টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক পুলিশ স্থাপনার ক্ষতি হয়েছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশ আরও সক্রিয় হবে। টহল ও চেকপোস্ট কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। যৌথ অভিযানও চলছে। শিগগির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
র্যাবের মুখপাত্র লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস জানান, রাজধানীতে সম্প্রতি ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় তারা ছিনতাইয়ের হটস্পটগুলো চিহ্নিত করেছেন। বিশেষ করে যেসব এলাকায় অধিক পরিমাণে ছিনতাই হয়েছে বা হচ্ছে, সেসব এলাকায় টহল ও তল্লাশি কার্যক্রম চালাচ্ছে র্যাব। এরই মধ্যে ছিনতাইকারী গ্রুপের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। র্যাবের সব ইউনিটকে সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা তৈরির পাশাপাশি গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কারা জামিনে বেরিয়ে এসে আবার একই অপরাধ করছে তারও তালিকা তৈরি করতে।
গ্রেপ্তার ছিনতাইকারীরা কেন দ্রুত জামিন পায়Ñ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রেপ্তারের পর ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আদালতে হাজির করা হলে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয় সংশ্লিষ্ট অপরাধের বিষয়ে। কিন্তু দেখা যায় যে, আদালতে আইনি প্রক্রিয়ায় সে সময় অনেকে জামিন পেয়ে যায়। জামিন পেলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তখন কিছু করার থাকে না।
প্রতিকার কী
পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীকে নানাভাবে বুঝিয়ে মামলা করা থেকে বিরত রাখে। কখনও কখনও ঘটনার বর্ণনায় ‘তালকে তিল’ বানিয়ে একটি জিডি নিয়ে অভিযোগকারীকে কোনোরকমে বিদায় করা হয়। এটা তারা করে থাকে ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে ভাগ পাওয়ার জন্য নয়, বরং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে কঠোর জবাবদিহিতার মুখোমুখি না হওয়ার চেষ্টা হিসেবে। তারা চায়, তাদের থানা এলাকায় সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা কম দেখাতে। এটি মাঠ পর্যায়ে পুলিশের অনেক পুরোনো অভ্যাস। মূলত এই বাজে আর অনিয়মজনিত অভ্যাসগুলোই ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ। কেননা এতে করে ছিনতাইকারীরা পুলিশকে প্রকারান্তরে তাদের পক্ষের লোকই ভেবে বসে।
তিনি আরও বলেন, ছিনতাইয়ের সঙ্গে মাদকের একটা বড় যোগসূত্র আছে। মাদক বেচাকেনা যত বেশি হবে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে ছিনতাইয়ের ঘটনা। নেশার টাকা জোগাতেই ছিনতাইকে পেশা হিসেবে বেছে নেয় অনেকে। এটি বিবেচনায় নিয়ে ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করার পাশাপাশি পুলিশকে প্রতিরোধমূলক একটি শক্ত জাল তৈরি করতে হবে। মাদক উদ্ধারে ও ঘাঁটি বন্ধ করতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং পুলিশের ভূমিকা নেই বললেই চলে। বরং দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই দুই সংস্থার অবৈধ আয়ের বড় উৎস এই মাদক। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নইলে ছিনতাই কোনোদিনই কমবে না।
খন্দকার হাসান মাহমুদ পরামর্শ দেন, সবার আগে জামিনে বেরিয়ে আসা বা সন্দেহভাজন ছিনতাইকারীদের নজরদারিতে রাখতে হবে। পেশাদার ছিনতাইকারীদের ছবি থানার বোর্ডে জনসমক্ষে ঝুলিয়ে রাখতে হবে, যেটা এখন নেই বললেই চলে। ছদ্মবেশে বা সাদা পোশাকে ও পায়ে হেঁটে অথবা সিভিল যানবাহনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নজরদারির ব্যবস্থা করাও জরুরি।
আইনজীবী ব্যারিস্টার সাইদুল মুনীম পিয়াস বলেন, সাধারণত ছিনতাই হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ সেখানে পৌঁছে এবং সাক্ষ্যগ্রহণ করে থাকেন। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অভিযান চালিয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করলেও সে যদি প্রকৃতভাবে ওই ঘটনায় সম্পৃক্ত হয়েও থাকে তবুও তার বিরুদ্ধে জোরালো সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। পুলিশ এসব ঘটনায় যাদের সাক্ষী করে তারাও আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেন না। সাক্ষীদের ভাষ্য মতে, পুলিশের নথিতে অনেকটা জোর করেই তাদের সাক্ষী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে এসব মামলা থেকে আসামিরা সহজেই রেহাই পেয়ে যায়। দ্রুত জামিনও পায় এবং আবার ফিরে যায় আগের পেশায়। বরং পুলিশের উচিত, কোনো গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে আসামি করে আদালতে পাঠালে তার বিরুদ্ধে জোরালো এবং ঘটনার প্রকৃত সাক্ষীকে সম্পৃক্ত করা। পাশাপাশি সাক্ষী যেন আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেনÑ সেটা নিশ্চিত করা। এটা কার্যকর হলে ছিনতাই কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন।