× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আউটসোর্সিংয়ের কর্মীদের ঠকিয়ে ঠিকাদারদের ‘আউট ইনকাম’

ফসিহ উদ্দীন মাহতাব

প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ১০:১৬ এএম

আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ১০:৫০ এএম

বাংলাদেশ সচিবালয়। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ সচিবালয়। ছবি : সংগৃহীত

প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর থেকে সহকারী মেকানিক হিসেবে কাজ করছেন রকিব চৌধুরী। পত্রিকায় দেওয়া বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সরকারি হিসেবে তাকে মাসিক ১৭ হাজার ৯১০ টাকা বেতন দেওয়ার কথা। নির্ধারিত সময়ের বাইরে অর্থাৎ ওভারটাইম করলে তার জন্যও পারিশ্রমিক দেওয়ার নীতিমালাও রয়েছে। অথচ ওভারটাইম তো দূরের কথা, মূল বেতনেরও পুরোটা না দিয়ে উল্টো ২ হাজার ৯১০ টাকা কম দিচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কণা কারিগর। এসব টাকা যাচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তাদের পকেটে। প্রতি মাসেই ওই ঠিকাদার সরকারের কাছ থেকে টাকা তুলে নিজেদের পকেট ভারি করলেও কর্মচারীদের বেতন দিতে টালবাহানা করছে। 

সচিবালয়ে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে লিফটম্যান হিসেবে কাজ করছেন মো. হিরা মিয়া। আউটসোর্সিংয়ের কর্মী হিসেবে তার মাসিক ১৭ হাজার ৬১০ টাকা বেতন ধার্য করা থাকলেও তিনি পাচ্ছেন ১৫ হাজার টাকা। বাকি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন তাকে নিয়োগ দেওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আজিজ অ্যান্ড কোং-এর মালিক। 

লিফটম্যান হিরা অভিযোগ করেন, তাদের চলতি মাসসহ পাঁচ মাসের বেতন বাকি রয়েছে। কবে বেতন দেবে তা জানা নেই। ঠিকাদাররা তাদের চেকবই না দিয়ে আগাম সই করে নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছেন। চেকবই চাইতে গেলে চাকরি কেড়ে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। ফলে চাকরি বাঁচাতেই কম বেতন নিয়েও চুপ থাকতে হচ্ছে। 

হিরা-রকিবের মতো এরকম চার শতাধিক কর্মী সচিবালয়সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, যাদের নির্ধারিত বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে কম। সেটাও অনিয়মিত হওয়ায় দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সচিবালয়ে ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা ২০১৮-এর আলোকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে জনবল সরবরাহ করে আসছে। তাদের মধ্যে প্রাণ আরএফএল ছাড়া বাকি ১৩টি প্রতিষ্ঠান নিম্ন আয়ের মানুষদের অর্থ নয়ছয় করে নিজেদের পকেট ভারি করছে। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑ ইস্টার্ন এন্টারপ্রাইজ, কণা কারিগর, প্রায়ন্তী এন্টারপ্রাইজ, শুভ্রা ট্রেডার্স, ইকবাল এন্টারপ্রাইজ, ইউনিভার্সেল এন্টারপ্রাইজ, মান বাংলাদেশ, ক্রিয়েটিভ এন্টারপ্রাইজ, আজিজ অ্যান্ড কোং, রশিদ এন্টারপ্রাইজ, ড্যাফোডিল এন্টারপ্রাইজ, রিমন এন্টারপ্রাইজ এবং ধলেশ্বরী এন্টারপ্রাইজ। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ছিলেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের আশীর্বাদপুষ্ট। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও তারা বহাল তবিয়তে রয়েছেন। 

অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মচারীদের পদ ভেদে প্রতি মাসে জনপ্রতি ২ হাজার ৯১০, ৩ হাজার ৯১০ এবং ৫ হাজার টাকা করে কম বেতন দিচ্ছে। এভাবে চার শতাধিক কর্মচারীকে বঞ্চিত করে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। যার পরিমাণ বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। হাতিয়ে নেওয়া এসব টাকার একটি অংশ টেন্ডার পেতে সহায়তাকারী গণপূর্তের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এসব অপকর্ম নিয়ে গত ২১ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টার কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন ভুক্তভোগীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সচিব মো. নবীরুল ইসলামকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেন উপদেষ্টা। দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা বলা হয় তাকে। এই নির্দেশনার পর একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক ও যুগ্ম সচিবকে সদস্য সচিব করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এরই মধ্যে অনেক সময়ে পেরিয়ে গেলেও কোনো প্রতিবেদন জমা পড়েনি। তবে অভিযোগ দায়ের করার কারণে বেশ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্মীদের নানা রকম হুমকি দিচ্ছে বলে জানা গেছে। 

এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হামিদুর রহমান খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এসব অভিযোগ জমা হয়েছে তিনি সচিব হওয়ার আগেই। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটি কাজ করছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নীতিমালা অনুযায়ী জনবল সরবরাহের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো মোট জনবলের বেতনের ওপর ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে অতিরিক্ত অর্থ পায়। এরপরও নিম্ন আয়ের শ্রমিকদের প্রাপ্য বেতন থেকে আরও একটি অংশ কেটে নিচ্ছে ঠিকাদাররা। এই অতিরিক্ত টাকা বিভিন্ন খাতে খরচ করতে হয় বলে কর্মীদের সাফাই গাওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। চাকরি হারানোর ভয়ে তারা শেষ পর্যন্ত ঠিকাদারের এসব অনিয়ম জেনেশুনেই সহ্য করে যান। 

এদিকে বাড়তি কাজের জন্য অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার নিয়মও মানছে না সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা ২০১৮-এর ৭-এর (১)-এ বলা রয়েছেÑ ‘সেবা প্রদানকারী অতিরিক্ত সময় সেবাদানে নিয়োজিত থাকলে চুক্তি অনুযায়ী অতিরিক্ত সেবা মূল্য প্রদেয় হবে।’ যদিও ওভারটাইম করার পরও কর্মচারীরা নীতিমালা অনুযায়ী কোনো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। এ খাত থেকেও ঠিকাদাররা প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা পকেটস্থ করছেন। ঈদ কিংবা পূজা পার্বণেও কোনো ভাতা পান না এই কর্মীরা।

ঘুরেফিরে পুরোনোরাই 

নিয়ম অনুযায়ী কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করার কথা। এসব টেন্ডারের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। সেক্ষেত্রেও নেওয়া হয় অভিনব কৌশল। দেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকগুলোতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কথা থাকলেও নামসর্বস্ব কিছু পত্রিকায় এসব বিজ্ঞাপন দিয়ে এককভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এভাবে বিগত সময়ে নিয়ম না মেনে বছরের পর বছর নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই ঘুরেফিরে চুক্তি নবায়ন করে চলেছে। এ চক্রের বাইরে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে জনবল সরবরাহের নজির নেই। 

গতি নেই তদন্ত কমিটির কাজে

ঠিকাদারদের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। প্রশাসন অনুবিভাগ-২-এর অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক এবং একই শাখার যুগ্ম সচিবকে সদস্য সচিব করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তবে এ কমিটির কাছ থেকে এখনও প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। নেওয়া হয়নি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো সাময়িক পদক্ষেপও। এ বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক শাকিলা জেরিন আহমেদ বলেন, এটা নিয়ে কাজ চলছে। নথিপত্র দেখে বলতে হবে প্রতিবেদনের অগ্রগতি কতদূর। 

এ বিষয়ে সচিবালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী নিয়াজ মোহাম্মদ তানভীর আলম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, নির্ধারিত পরিমাণ বেতন না দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে তাদের জানানো হয়েছে। ঠিকাদারদের ডেকে এনে সতর্ক করেছেন। তারা যদি আবারও এ ধরনের অপরাধ করেন, তাহলে তাদের চুক্তি বাতিল করা হবে। ঠিকাদাররা বলেছেন, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এতদিন টাকা নেওয়া হয়েছে। এখন থেকে আর নেওয়া হবে না বলে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে কিছু প্রতিষ্ঠানের বিল আটকে রাখা হয়েছে। 

শ্রমিকদের বেতন কম দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শাহ আলম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, তার কর্মীদের এক মাসের বেতন এখনও দিতে পারেননি। হয়তো এক মাস বাকি থাকতে পারে। তবে নির্ধারিত বেতনের চেয়ে কম বেতন দেওয়া হয় না বলে দাবি করে তিনি বলেন, এখানে ১৩টির মতো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে। তাদের কেউ কেউ করলে করতে পারে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেন, সাবেক মন্ত্রী বা সচিবরাও প্রতিনিধির মাধ্যমে জনবল দিয়েছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে মন্ত্রী-সচিবদের আশেপাশে ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ চাপ দিয়ে জনবল নিয়োগ দিতে বাধ্য করেছেন। এসব নিয়োগ দেওয়ার বিনিময়ে তারা টাকাও নিয়েছেন। 

আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কণা কারিগরের মালিক মো. পারভেজ কামাল বলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খাতে কিছু টাকা খরচ করতে হয়। সেটা সমন্বয় করতে অনেক সময় কর্মচারীদের সঙ্গে পরামর্শ করেই তাদের বেতন থেকে কিছু টাকা সমন্বয় করা হয়। তবে সব সময় বেতন কম দেওয়া হয় না। সরকারের নিয়ম অনুযায়ীই তাদের বোনাস ও ছুটিও দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ঠিকাদারদের পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসার পরামর্শ দেন তিনি। 

এ বিষয়ে আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রায়ন্তী এন্টারপ্রাইজের মালিক আকিবুল হাসান পলাশকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি সাবেক ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান দুলালের ঘনিষ্ঠজন। মন্ত্রীর এলাকার লোক হিসেবে জামালপুর থেকেই অধিকাংশ কর্মী নিয়োগ পেয়েছে তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।



শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা