সাইফ বাবলু
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৪১ এএম
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৯ পিএম
ফাইল ফটো
এখনও সন্ধান মিলছে না পুলিশের লুট হওয়া দুই হাজারের বেশি আগ্নেয়াস্ত্রের। উদ্ধার করা যায়নি লুণ্ঠিত গোলাবারুদ, টিয়ার শেল ও অন্যান্য সরঞ্জামের উল্লেখযোগ্য অংশ। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও এর আগে-পরের দুদিন মিলিয়ে মোট তিন দিনে এসব অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম বিভিন্ন থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা থেকে খোয়া যায়। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, হামলা-পাল্টা হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সময় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় প্রায় ৬ হাজার অস্ত্র ও প্রচুর গোলাবারুদ লুট হলেও এখনও দুই হাজারের বেশি আগ্নেয়াস্ত্রের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
এই হিসাবের বাইরে গণভবন এবং সংসদ ভবন থেকেও খোয়া যাওয়া স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) অনেক অস্ত্র রয়েছে। এই দুই জায়গা থেকে কত অস্ত্র খোয়া গেছে বা সেসবের মধ্যে কয়টি উদ্ধার হয়েছে, সে পরিসংখ্যান পুলিশ জানাতে পারেনি। লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে যৌথ অভিযান। কিন্তু ফলাফল হতাশজনক। উদ্ধার না হওয়ায় এসব অস্ত্র নানা রাজনৈতিক সংঘাত, সহিংসতা ও ভয়ানক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
এ পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ৩৭৬৩ লুণ্ঠিত অস্ত্র
পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত শনিবার পর্যন্ত তাদের লুণ্ঠিত অস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩ হাজার ৭৬৩টি। এসব অস্ত্রের প্রায় সবই পাওয়া যায় সরকারের পক্ষ থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র স্বেচ্ছায় ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানানোর পর। অন্যদিকে যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে মাত্র ১৮৫টি অস্ত্র। এর মধ্যে পুলিশের কাছ থেকে খোয়া যাওয়া অস্ত্রের সংখ্যা একেবারেই কম। উদ্ধার হওয়া এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছেÑ ১১টি রিভলবার, ৫৬টি পিস্তল, ১১টি রাইফেল, ২৫টি শটগান, ৫টি পাইপগান, ২০টি শুটারগান, ১৩টি এলজি, ২৫টি বন্দুক, একটি এ কে ৪৭, একটি চাইনিজ রাইফেল, তিনটি এয়ারগান, চারটি করে এসবিবিএল ও এসএমজি, দুটি করে গ্যাসগান, টিয়ার গ্যাস লঞ্চার ও থ্রি-কোয়াটার। এসব অস্ত্রের বেশিরভাগেরই লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব বলছে, ঢাকাসহ সারা দেশে ৫ হাজার ৮২৯টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র লুট হয়েছে। এর মধ্যে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে ৩ হাজার ৭৬৩টি। এখন পর্যন্ত ২০৬৬টি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। উদ্ধার না হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ৩৩৯টি রাইফেল, ৬৭টি এসএমজি, ১১টি এলএমজি, ৮৪৯টি পিস্তল, ৬২২টি শটগান, ১৭৬টি টিয়ার গ্যাস লঞ্চার এবং দুটি সিগন্যাল পিস্তল। উদ্ধার না হওয়া গোলাবারুদের মধ্যে রয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ৬৬০টি বিভিন্ন বোরের গুলি। ৮ হাজার ৯০৫টি টিয়ার গ্যাস শেল, ৭৫১টি টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড, ২ হাজার ৫৭৬টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং ৭৮টি স্মোক গ্রেনেড।
একাধিক ইন্টেলিজেন্ট টিম তৎপর
পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. ময়নুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে অভিযান এখনও চলমান। ইতোমধ্যে অর্ধেকের বেশি অস্ত্র পাওয়া গেছে। তবে এখন পর্যন্ত যেসব অস্ত্রের খোঁজ মেলেনি, সেগুলো নিয়ে পুলিশের একাধিক ইন্টেলিজেন্ট টিম কাজ করছে। তাদের দেওয়া তথ্যের মাধ্যমে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। যৌথ অভিযানের পাশাপাশি পুলিশ বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমেও অস্ত্র লুটের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রেপ্তার এবং অস্ত্র উদ্ধারে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।’
পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, ‘লুট হওয় অস্ত্র দিয়ে অপরাধীরা নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করার চেষ্টা করতে পারে। লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর একটা অংশ অনুপস্থিত বা পলাতক পুলিশ সদস্যদের কারও কাছেও থাকতে পারে। এগুলোও দেখা হচ্ছে। তবে থানায় যারা হামলা করেছে, তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অপরাধী, দুর্বৃত্তসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্ত ছিল। মনে করা হচ্ছে, লুট হওয়া অস্ত্রগুলো দাগী অপরাধীদের কাছেই থাকতে পারে।’
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগ ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এসব অস্ত্রের অপব্যবহারে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে। আশঙ্কা রয়েছে যেসব দুর্বৃত্ত পুলিশের অস্ত্র লুট করেছে, তারা নিজেদের স্বার্থে অপহরণ, হত্যা, জিম্মি করা, চুরি ডাকাতিসহ নানা অপরাধে এসব ব্যবহার করবে।’
যৌথ অভিযানেও মিলছে না লুণ্ঠিত অস্ত্র
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, খোয়া যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিকটস্থ থানায় জমা দেওয়ার জন্য ৩ সেপেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সরকার। কিন্তু অস্ত্র ও গোলাবারুদ সব জমা না পড়ায় গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় যৌথ অভিযান। এই অভিযানে গত শনিবার পর্যন্ত সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের ১৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে ৮৪ জন। তবে উদ্ধার অস্ত্রের মধ্যে লাইসেন্সবিহীন এবং লাইসেন্স বাতিল অস্ত্রের সংখ্যাই বেশি। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই বিভিন্ন মামলা রয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে পুলিশের অস্ত্র লুটে জড়িত কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে কি না, সেই তথ্যও পাওয়া যায়নি। পুলিশের কোন কোন স্থাপনা থেকে কী ধরনের অস্ত্র খোয়া গেছে, উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলো পুলিশের কোন কোন ইউনিটের কোন সদস্যদের নামে বরাদ্দ ছিল, এসব বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য এখনও দিতে পারেনি পুলিশ সদর দপ্তর।
৫ আগস্টের পর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের ১৮৭ জন সদস্য এখনও কর্মস্থলে অনুপস্থিত। এর মধ্যে ডিআইজি ১ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি ৭ জন, পুলিশ সুপার ২ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১ জন, সহকারী পুলিশ সুপার ৫ জন, পুলিশ পরিদর্শক ৫ জন, এসআই ও সার্জেন্ট ১৪ জন এবং কনস্টেবল ১৩৬ জন। অবশ্য অনুপস্থিতদের মধ্যে ছুটিতে আছেন ৯৬ জন, চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় ইস্তফা দিয়েছেন ৩ জন। পলাতক আছেন ৩৯ জন। এদের কাছেও অস্ত্র আছে কি না, সে ব্যাপারেও পুলিশ স্পষ্ট করে কিছু বলছে না।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সার্বিক পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তার একটা সংকট তৈরি হয়েছে। যার ফলে লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান জোরদার হচ্ছে না। থানা পুলিশের কার্যক্রম শুরু হলেও সরাসরি অপারেশনাল কার্যক্রমে এখনও সক্রিয় হতে পারেনি পুলিশ। ঊর্ধ্বতন মহল থেকে যা-ই বলা হোক না কেন, থানা পুলিশ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও ক্ষেত্রবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মামলার এজাহার নেওয়া ছাড়া কার্যত অস্ত্র উদ্ধারে কোনো অভিযান পরিচালনা বা লুট হওয়া অস্ত্র বহনকারীর অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।
অস্ত্র কোথায় যেতে পারে
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অস্ত্রের বেশিরভাগই লুণ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন থানা থেকে। এছাড়া গণভবন ও সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় থাকা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) বিপুল পরিমাণ অস্ত্রও খোয়া গেছে। এসব হামলার সময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে অংশ নিতে দেখা গেছে। বিভিন্ন এলাকার দাগী অপরাধী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অতি উৎসাহী কর্মীরাও অংশ নিয়ে অস্ত্র লুট করেছে। কিন্তু লুণ্ঠিত অস্ত্র কার বা কাদের কাছে গেছে, সে তথ্য বের করা যায়নি।
কর্মকর্তারা আরও জানান, লুণ্ঠিত অস্ত্রের বড় অংশ বিভিন্ন দাগী অপরাধীদের কাছে রয়েছে। কারণ কোনো সাধারণ মানুষ এগুলো রাখবে না। কিছু অস্ত্র আত্মগোপনে থাকা পুলিশ সদস্যদের কাছেও থাকতে পারে। এমনও হতে পারে, অসৎ কতিপয় পুলিশ সদস্য অস্ত্র নিজেদের কাছে রেখে বা বিক্রি করে দিয়ে লুট হয়ে যাওয়ার গল্প ফাঁদছেন। আবার মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের বিহারী ক্যাম্পের একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র রাজধানীতে বিভিন্ন থানায় হামলা ও অস্ত্র লুটে জড়িত রয়েছে বলে জানা গেছে। পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন গ্রুপও এসব অস্ত্র লুটপাটে জড়িত।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, লুট হওয়া অস্ত্র ব্যবহারে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ ছাড়া ব্যবহার করা বিপজ্জনক। তাই এসব অস্ত্র উদ্ধার না হলে সাধারণ মানুষের জন্য ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এমনকি জঙ্গি কার্যক্রমেও এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে।