অডিট প্রতিবেদন
এস এম ইমদাদুল হক
প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:১১ এএম
আপডেট : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৪৮ পিএম
বিটিআরসি ভবন। ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর আগারগাঁও প্রশাসনিক এলাকায় ২৬০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নিজস্ব ভবন পেয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। প্রতিষ্ঠার ২১ বছর পর গত বছরের আগস্টে ১২ তলাবিশিষ্ট এই ভবনে অফিস শুরু করে কমিশন। ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ৬টি অডিট আপত্তিতে অন্তত কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ রয়েছে। সরকারের নিরীক্ষা বিভাগের অডিট প্রতিবেদনে এসব তথ্য এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভবনের নকশা নিয়ে সময়ক্ষেপণ ও ক্রয়ে ১০ মাসের বেশি সময় নিলেও জরুরি দেখিয়ে খোলা দরপত্রের বদলে সরাসরি কার্যাদেশ দিয়ে এমন লোপাটের পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্প সময় বাড়িয়ে ৫৯ কোটি ২১ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয়, আসবাবপত্র ক্রয়ে ২ কোটি টাকার অনিয়ম, ব্যাংক গ্যারান্টি ছাড়াই ১ কোটি টাকা অনিয়মিত ব্যয় ছাড়াও ভ্যাট না কেটে ৩০ লাখ টাকার মতো রাজস্ব ক্ষতির তথ্য রয়েছে প্রতিবেদনে।
এর বাইরেও প্রকল্পের গাড়ি সরকারি যানবাহন পুলে জমা না দিয়ে আইন ভঙ্গসহ সরকারি অর্থের যথেচ্ছ ক্ষতি করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরির বিষয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাইট কেয়ারটেকার মোস্তাক আহমেদ বলছেন, দফায় দফায় বিল্ডিংয়ের নকশা পরিবর্তন, বিদেশ থকে বিভিন্ন সরঞ্জাম আমদানি ও ফোকাল পয়েন্ট পরিবর্তন করায় কাজ করতে বেগ পেতে হলেও করোনার বন্ধতেও তাদের কাজ থেমে থাকেনি। তারপরও এই কাজ করতে গিয়ে তাদের এক বছরের মতো সময় বসে থাকতে হয়েছে। তবে বিল্ডিংয়ের কাঠামো নির্মাণে মান নিয়ে তারা কোনো ছাড় দেননি। ফলে জাইকা প্রতিবেদনে শতভাগ মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন বলে দাবি করেছেন তিনি।
সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের অনুসন্ধান বলছে, বিটিআরসি ভবন নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৮ সালে ১ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ২০২৩ সালের ৩০ জুন। প্রকল্প কাজে ১০টি কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি, ২ সেট অফিস ইক্যুইপমেন্ট ২ কোটি টাকার আসবাবপত্র, ৬৫ লাখ ৭০ হাজার টাকার একটি জিপ গাড়ি, জেনারেটর, ৬টি প্যাসেঞ্জার লিফট, ১টি প্যাসেঞ্জার কাম বেড লিফট, এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম ইত্যাদি বিপুল ভৌতসেবা ও সরঞ্জাম কেনা হলেও সেগুলোর যথাযথ তালিকাসহ প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদন প্রণয়ন, প্রেরণ ও আইএমইডির মাধ্যমে তা মূল্যায়ন করা হয়নি।
সূত্রমতে, এই লিফট কিনতে বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণ করেছেন ভবন নির্মাণে সংশ্লিষ্ট উপ-প্রকল্প পরিচালক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা আসবাবপত্র ও মনিহারি পণ্যের দাম ও মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
নিরীক্ষা প্রকল্পের আরডিপিপি, আসবাবপত্র ক্রয়সংক্রান্ত নথি ও বিল-ভাউচার যাচাইয়ে দেখা গেছে, ডিপিএম পদ্ধতিতে চুক্তি ছাড়াই আসবাবপত্র ক্রয়ের জন্য চট্টগ্রাম ড্রাই ডক লিমিটেডকে ২ কোটি টাকার কার্যাদেশ দিয়ে অগ্রিম ১ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পিপিআর ২০০৮-এর বিধি ৩৯-এর ৯ ধারা লঙ্ঘন করে কোনো ব্যাংক গ্যারান্টি পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। প্রতিবেদনে আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা উল্লেখ করে অনিয়মের ফিরিস্তি তুলে ধরে কারণ জানতে চাওয়ার পর এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়নে নিযুক্ত কর্মকর্তারা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভবনটিতে এখন পুরোদস্তুর প্রশাসনিক কাজ শুরু হওয়ার এক বছর পরও প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন আইএমইডির মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে আইএমডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, প্রকল্পের গাড়ি ফেরত দেওয়ার জন্য এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্প মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিতে বিলম্বকারীদের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ও সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হচ্ছে। তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও ৬ মাসেও তা হাতে না পাওয়ার বিষয়টিও আমরা গুরুতর হিসেবে দেখছি।
সূত্রমতে, বিটিআরসি ভবন তৈরি প্রকল্পের পুরো টাকাই এসেছে বার্ষিক উন্নয়ন তহবিল থেকে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে ভবন নির্মাণ কাজটি বাস্তবায়ন করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড (এনডিই)। আর অর্থ ছাড়ের দায়িত্বে ছিল বিটিআরসি নিজেই। আর এ ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন বিটিআরসি কমিশনার মো. দেলোয়ার হোসাইন এবং উপ-প্রকল্প পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান।
এর মধ্যে গত ৩ সেপ্টেম্বর চুক্তি বাতিল আদেশ দেওয়ায় চাকরি হারান দোলোয়র হোসাইন। প্রকল্পের অডিট আপত্তির কথা স্বীকার করে দায়িত্বে থাকা আসাদুজ্জামানের দাবি, তারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেছেন, কমিশন বৈঠকে আমাদের কাছে মানসম্মত আসবাবপত্রের কথা বলা হয়েছিল। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই আমরা সেই ইচ্ছার বাস্তবায়ন করেছি।
ওপেন টেন্ডারে মানসম্মত আসবাবপত্র সংগ্রহে আস্থা না থাকায় ভালো কোম্পানির কাছ থেকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কেনাকাটা করা হয়েছে। মূলত আমরা পিডব্লিউডির সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেছি। জিওবি ফান্ড থেকে পাস হওয়া টাকা যেহেতু বিটিআরসির হিসাব থেকে দেওয়া হয়েছে সে ক্ষেত্রে অর্থ ছাড়ের কাজটা আমরা করেছি। সব কাজের ডকুমেন্ট আমার কাছে আছে।
অডিট অধিদপ্তর, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ হতে অডিট আপত্তির জবাব দিতে ২১ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। উত্থাপিত ১৬টি আপত্তির মধ্যে গত ১১ জুলাই এসএফআই অনুচ্ছেদ নং ৬, ৯ ও ১০-এর জবাব ডি-নথির মাধ্যমে দেওয়া হলেও হার্ডকপি জমা না দেওয়ায় আরও দুই সপ্তাহের সময় দেওয়া হয়। ১৬ জুলাই সংস্থার অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগ থেকে অডিট অফিসে তাগিদ দিয়ে প্রকল্প পরিচালদের সতর্ক করা হয়েছে।
এদিকে নিরীক্ষা প্রকল্পের আরডিপিপি, আসবাবপত্র ক্রয়সংক্রান্ত নথি ও বিল ভাউচার যাচাইয়ে দেখা গেছে, সরাসরি ক্রয়-প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেডকে চুক্তি করেই ইনভয়েস ও সরবরাহকারীর বিল দাখিল সাপেক্ষে চূড়ান্ত বিল হিসেবে এক কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। একইভাবে পিপিআর ২০০৮ তফসিল ৩-এর ফ্লো চার্ট লঙ্ঘন করে ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা ও দরকষাকষি করেনি।
এমনকি অডিট কোডের বিধি-৫৯ এবং ট্রেজারি রুলসের অধীন সাবসিডিয়ারি রুলস-৪৩৭-এর নির্দেশনা অনুযায়ী জবাব দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা অনুসরণ করেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাই অনিয়মিত ক্রয় প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।
অপরদিকে চাকরিচ্যুত দেলোয়ার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। বাণিজ্যের বিষয় লুকাতে ২০১৮ সালে ওয়েবসাইট থেকে ‘জনবল নিয়োগের জন্য মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি’ পর্যন্ত সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। আর দলীয়, বন্ধু ও আত্মীয়দের নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ও বিটিআরসিতে ছিল ওপেন সিক্রেট।
ইতোমধ্যেই দেলোয়ার হোসাইন সিন্ডিকেটের অবৈধ নিয়োগের বিষয়ে বিটিআরসি তদন্ত কমিটি করে কয়েকজনকে বহিষ্কার করেছে। অধিকতর তদন্তের জন্য ডাক ও টেলি যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে ৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর তদন্ত শেষ করার জন্য কমিটিকে আরও ১৫ দিনের সময় দেওয়া হয়।
অভিযোগ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে চাহিদা অনুযায়ী কাজ দিলে টেন্ডারের দরকার হয় না। তাই আমি অগ্রিম টাকা দিয়ে কোনো চুক্তি করিনি। আমি যাওয়ার পর আসবাবপত্র নিয়ে পুরো টাকা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভ্যাট চালান না দেওয়ার দায়িত্ব আমার ছিল না। যেহেতু আমি ২০২৩ সালের ২৩ মার্চ বদলি হয়েছি এবং ৩০ জুন কাজ শেষ হয়েছে, সেজন্য নিরীক্ষার আপত্তিগুলোর বিষয়ে আমার কোনো দায় নেই। এই দায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকা ডিপিডি আসাদ ও প্রকল্প শেষ করা ডিজি (এডমিন) মো. মামুনের।
ডিপিডি (উপ-প্রকল্প পরিচালক) আসাদ দাবি করেছেন, ছয়টি অডিট আপত্তির মধ্যে দুটির জবাব এরই মধ্যে দেওয়া হয়েছে। বাকি জবাব প্রস্তুত হচ্ছে। ডিজি (এডমিন) মো. মামুনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন।