রূপগঞ্জ কব্জায় নিতে ভূমিদস্যুর নতুন ষড়যন্ত্র
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:২৩ এএম
নারায়ণগঞ্জ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক খোকনের (গোল চিহ্নিত) সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলম। ছবি : সংগৃহীত
রূপগঞ্জ কব্জায় নিতে এবার বিএনপি নেতাদের ঘাড়ে চড়ে বসেছেন ভূমিদস্যু বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলম। এরই মধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক খোকনের নেতৃত্বে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে একাধিক বিশেষ মিটিংও করে ফেলেছেন তিনি। সেই মিটিংয়ে রূপগঞ্জ থানা বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী আবদুল্লাহ আল মামুন নয়ন, থানা বিএনপির অর্থ সম্পাদক শামীম ভূঁইয়া এবং ‘হাইব্রিড’ বিএনপি নেতা ও সশস্ত্র ক্যাডার মোশারফ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। গ্রহণ করেছেন কোটি কোটি টাকা এবং অস্ত্রও।
বৈঠকের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ রকম একটি ছবির সঙ্গে দেওয়া পোস্টে লেখা হয়, নিজ সাম্রাজ্য বাঁচাতে বিএনপি নেতাদের সাথে মিটিং চালাচ্ছেন আকবর সোবহান। আমৃত্যু শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বসুন্ধরার চেয়ারম্যান এখন বিএনপির সাথে আঁতাত করছেন। মাসখানেক আগেও বিএনপি-জামায়াত নেতাদের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করা আকবর সোবহান আগস্টের ৩১ তারিখে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক খোকনের সঙ্গে মিটিং করেন। মিটিংয়ে খোকন বসুন্ধরার পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে গোলাম ফারুক খোকনের বৈঠকের ছবি ছড়িয়ে পড়লেও এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বিএনপি। অথচ এর মধ্যেই বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের গাড়ি ব্যবহার, দখল, চাঁদাবাজি এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনসহ কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় অনেক নেতাকে শোকজ করা হয়েছে।কাউকে কাউকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। বিলকিস জাহান শিরীন, শামা ওবায়েদ ও শহীদুল ইসলাম বাবুলের সাংগঠনিক পদ স্থগিত করা হয়েছে। পদাবনতি হয়েছে রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, রূপগঞ্জ কব্জায় রাখতে শাহ আলম এর আগে হত্যাসহ অন্তত ৬০ মামলার আসামি আওয়ামী যুবলীগের শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশারফ হোসেন মোশাকে দলে ভেড়ান। তাকে দেশি-বিদেশি অস্ত্র দিয়ে রূপগঞ্জ ও নাওড়া এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তাদের হাতে রূপগঞ্জে বেশ কিছু হত্যা, দখল ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে। গত ৬ জুন মোশার ছেলে নীরবের ফিল্মি স্টাইলে ছোড়া গুলিতে দ্বীন ইসলাম নামে স্থানীয় এক তরুণের মৃত্যু হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশাকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বিশাল আস্তানা বানিয়ে দেন শাহ আলম। সেখানেই শতাধিক ক্যাডারের বাহিনী নিয়ে অবস্থান করছেন মোশা। সবার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ভয়ানক দেশি-বিদেশি অস্ত্র। এগুলো দিয়ে তারা প্রকাশ্যে রূপগঞ্জ এলাকায় মহড়া দিয়ে বেড়াচ্ছে। এমনকি অতীতে র্যাব, পুলিশ ও সেনা সদস্যদের ওপরও আক্রমণ চালিয়েছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর মোশা ও তার বাহিনী গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে চলে যায়। দেশের পটপরিবর্তনের পর নিজেও দ্রুত ভোল পাল্টে ফেলেন শাহ আলম। এখন তিনি বিএনপি নেতাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে রূপগঞ্জ দখলে নেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। গত ৩১ আগস্ট শাহ আলমের বাসভবনে বিশেষ মিটিংয়ে অংশ নেওয়া বিএনপি নেতাদের হাতে মোটা অঙ্কের অর্থ তুলে দেওয়া হয়। তাদের দিয়ে নতুন ক্যাডার বাহিনী গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শাহ আলম। তার পুরোনো ক্যাডারদেরও এখন বিএনপি নেতা খোকন, নয়ন, শামীম ও মোশারফের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়েছেন।
রূপগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে গোলাম ফারুক খোকন রূপগঞ্জে বিভিন্ন কারখানায় লুটপাটের মূল হোতা হিসেবে কাজ করেছেন। খোকনের নির্দেশে তার লোকজন বিভিন্ন কারখানায় দখল ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছে। খোকন কেন্দ্রীয় বিএনপির এক নেতার ছত্রছায়ায় এলাকায় এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানা গেছে।
সচেতন মানুষ জানান, ভূমিদস্যু শাহ আলম একসময় মোশা বাহিনীর মাধ্যমে রূপগঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিলেন। তার নির্দেশে অসংখ্য অঘটন ও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এই এলাকায়। মোশা নিরীহ গ্রামবাসীকে তুলে নিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা আস্তানায় মাসের পর মাস আটকে রেখে নির্যাতন করেছে। টাকাপয়সা দিয়ে প্রতিপক্ষ শিল্পমালিকদের বিরুদ্ধে হামলা ও মামলা দেওয়া হতো। শাহ আলমের প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী মোশা বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলো রূপগঞ্জের মানুষ। হাওয়া বদলে যাওয়ায় মোশা বাহিনীর বিকল্প হিসেবে এখন বিএনপি নেতা খোকন ও নয়নের তার বাহিনী দিয়ে রূপগঞ্জ কব্জায় নেওয়ার নতুন খেলা শুরু করেছেন শাহ আলম।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ঘণ্টা বাজার পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনায় রয়েছে। সংস্কার শুরু হয়েছে সর্বক্ষেত্রে। এমন একটা সময়েও শাহ আলম কীভাবে বিএনপি নেতাদের হাত করে ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছেন, তা নিয়ে বিস্মিত রূপগঞ্জের মানুষ। তারা বলছেন, রূপগঞ্জ ঘিরে এক আজব লীলাখেলায় মেতেছেন ভূমিদস্যু শাহ আলম। অপরাধ করে এবং অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে তিনি বারবার আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছেন না। খুন-খারাবি, জবরদখল করেÑযেকোনো উপায়ে হোক রূপগঞ্জকে নিজের মুঠোয় রাখতে এবং চাঁদাবাজির বিশাল সাম্রাজ্য রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন এই ভূমিদস্যু।
গত ২১ আগস্ট রাজধানীর বাড্ডা থানায় বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহ আলম ও তার ছেলে সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে ৩টি হত্যা মামলা করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলি করে মানুষ হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে এসব মামলা হয়। এ ছাড়া গত ২৯ আগস্ট বগুড়ার আদালতে শাহ আলম ও আনভীরের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার দুটি মামলা হয়েছে। ২৮ আগস্ট ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে শাহ আলম ও তার স্ত্রী আফরোজা বেগমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। গত ১ সেপ্টেম্বর শাহ আলম ও আনভীরের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে মানহানির পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। তার আগে গত ২২ আগস্ট কর ফাঁকির অভিযোগে শাহ আলমের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন উপায়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী বসুন্ধরার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির বিশেষ অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)। এতকিছুর পরও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভূমিদস্যু শাহ আলম। অফিস করছেন নিয়মিত। সেই সঙ্গে বিএনপি নেতাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে নতুন করে হামলা ও মামলা দেওয়ার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ভূমিদস্যুকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা না গেলে সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন আরও বাড়বে। তা ছাড়া যেসব বিএনপি নেতা তাকে সহযোগিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন এবং তার সঙ্গে যাদেরকে ব্ঠৈক করতে দেখা যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত সাংগঠনিক ব্যবস্থা হিসেবে দল থেকে বহিষ্কার করার জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন রূপগগঞ্জের আপামর জনগণ।