× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাবার আকুতি মেয়েকে কি আর ফিরে পাব না

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৪ ১১:৪২ এএম

আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৪ ১২:০৯ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

১২ বছর বয়সের মেয়েটি নারায়ণগঞ্জ সদরের একটি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট সে। প্রতিদিনের মতো আল-আমিন নগরের বাসা থেকে কোচিং সেন্টার ও স্কুলের উদ্দেশে বের হয় মেয়েটি। কোচিং শেষ করে বের হতেই দেখা হয় পূর্বপরিচিত তানভীর ও তার স্ত্রী মীমের সঙ্গে। তারা আগে থেকেই একটি প্রাইভেটকার নিয়ে অপেক্ষায় ছিল। মেয়েটিকে পার্কে ঘুরতে নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে গাড়িতে তোলা হয়। কোনো ফাঁকে অচেতন করে শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। কৈশোরে পা রাখতে চলা মেয়েটি বুঝতে পারে, এক ভয়ংকর ফাঁদে পড়ে গেছে সে। নিজেকে বাঁচানোর উপায় খুঁজতে থাকে সে। একসময় কৌশলে পালিয়ে গিয়ে যোগাযোগও করে বাবার সঙ্গে। শিশুটির বাবা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানিয়েছেন শিশু পাচারের এ ঘটনার আদ্যোপান্ত।

মেয়েকে ফিরে পেতে ব্যাকুল হয়ে থাকা অসহায় বাবা জানান, পাচার চক্রের হাত থেকে রক্ষা পেলেও এখনও মেয়েকে ফিরে পাননি। পাসপোর্ট-ভিসা করে ভারতে গিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করে আনার সামর্থ্যও নেই তার। তাই মেয়েকে ফিরে পেতে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, গত ১২ জুন থেকে নিখোঁজ মেয়েটি সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে না পেয়ে থানায় জিডি করতে যান তার বাবা। ওই সময় থানার ডিউটি অফিসার পরামর্শ দেন আরও একটি দিন অপেক্ষা করার। এর দুই দিন পর গত ১৪ জুন শুক্রবার মধ্যরাতে মেয়েটির বাবার কাছে মেসেঞ্জারে একটি রিকোয়েস্ট আসে। সেটি একসেপ্ট করতেই কল আসে। কলটি ছিল আসাম জেলার বনগাঁও রেলওয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তার।

ওই কর্মকর্তা মেয়েটির বাবাকে জানান, একটি মেয়েকে তারা উদ্ধার করেছেন যার সঙ্গে কথা বলে তিনি এই যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চারজন রেলস্টেশনে ডিউটি করছিলাম। প্ল্যাটফর্মে একটি ট্রেন ভিড়তেই বগি থেকে দৌড়ে এসে আপনার মেয়ে এসে আমার পায়ে ধরে বলে, আঙ্কেল আমাকে বাঁচান। ওরা আমাকে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসেছে। কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে; জানি না। আমার অনেক ভয় লাগছে। পুলিশ বগিতে তল্লাশি চালায়। এ সময় দুজন পালিয়ে যায়। এর সঙ্গে আরও একটি শিশুকেও উদ্ধার করা হয়েছে।’

এ খবর পাওয়ার পর ভুক্তভোগী মেয়েটির বাবা নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ভারতে পাচারকালে ওই দেশের পুলিশের উদ্ধার করা মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন তিনি।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আহসানুল আলম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা ভুক্তভোগীর শিশুটির বাবার সঙ্গে কথা বলেছি। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে শিশুটিকে ফিরিয়ে আনার জন্য। 

ভুক্তভোগী শিশুটির স্বজনরা জানান, নারায়ণগঞ্জ সদরের সৈয়দপুর এলাকায় একটি বাড়িতে ভাড়া থাকার সুবাদে প্রতিবেশী মিমের সঙ্গে তাদের প্রথম পরিচয়। চার বছর আগে তারা ওই বাড়ি ছেড়ে আল-আমিন নগরে বাসা নিলেও মিমের সঙ্গে যোগাযোগ রয়ে যায়। মাসখানেক আগে মিমরা নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে ঢাকার গুলশান এলাকায় বসবাস শুরু করে। মিম আগে থেকেই অসৎ প্রকৃতির বলে অনেকেই তাকে এড়িয়ে চলত। এমনকি ভুক্তভোগী শিশুটির পরিবারও তাকে এড়িয়ে চলত। কিন্তু মেয়েটিকে পাচারের জন্য তানভীর ও মিম অনেক দিন ধরেই ওঁৎ পেতে ছিল বলে তাদের ধারণা। 

এদিকে ভুক্তভোগী শিশুটির বাবা জানান, মেয়ের সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয়েছে ১৯ জুন। শিশুটির বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রেবেশের আইনে মামলা হয়েছে। যেদিন কথা হয়েছে সেদিন তার মেয়েকে আদালতের মাধ্যমে গুয়াহাটি সেফহোমে রাখা হয়েছে। মেয়ের বরাত দিয়ে পাচারের বিস্তারিত বর্ণনা দেন তিনি। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, আমার মেয়ে বলেছে সেদিন বাসা থেকে কোচিংয়ে শেষে ফেরার পথে একটা প্রাইভেটকার নিয়ে তানভীর ও তার স্ত্রী মিম অপেক্ষা করছিল। মেয়েকে দেখে তারা বলেÑ ‘চলো তোমাকে পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাই।’ তখন সে বলেÑ ‘পাপা শুনলে আমাকে মেরে ফেলবে।’ ওরা বলে, ‘পাপা বুঝতে পারলে তো। পাপা জানে ৪টায় স্কুল ছুটি। আমরা ২টার মধ্যে পৌঁছে দেব।’ এরপর শিশুটি গাড়িতে ওঠে। কিছুদূর যাওয়ার পর তাকে জুস ও চিপস খেতে দেয় তারা। এগুলো খাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়ে সে। যখন ঘুম ভাঙে তখন নিজেকে একটা বন্ধ কক্ষে দেখতে পায়। এ সময় চিৎকার শুরু করলে মিম এসে বলে, ‘জানোস, তুই এখন কই? তুই এখন ইন্ডিয়ায়।’ এরপর মিম ওই ঘরের একটি জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখতে বলে শিশুটিকে। সে দেখে একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘কলকাতা’। এরপর কান্না শুরু করে মেয়েটি। তখন মিম ভয় দেখিয়ে বলেÑ ‘এই বিল্ডিংয়ের তিন তলায় আছি আমরা। এর দ্বিতীয় ও নিচতলায় অন্তত ২৫টি ছেলে আমাদের পাহারা দিচ্ছে। তুই যদি চিৎকার করিস, তাহলে ওরা তোকে রেপ করবে। এরপর হত্যা করে আনারের মতো টুকরা-টুকরা করে নদীতে ফেলে দেবে।’

মেয়েটি তার বাবাকে আরও জানায়, মিম হুমকি দেওয়ার কিছুক্ষণ পরে দুটি ছেলে মদের বোতল নিয়ে তার রুমে এসে মদ পান করে। তারা তাকেও খেতে বলে। তাদের আমি বলি, কখনও এগুলো খাইনি, খাব না। আমি চেষ্টা করি ওদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করতে। এর মধ্যে এক ছেলে এসে আমার দুই হাত চেপে ধরে। আরেক ছেলে জোর করে মুখ হাঁ করায়। আর মিম আমার মুখে মদ ঢেলে দেয়। তারপর কী হয়েছে আমার মনে নেই। আমি অচেতন হয়ে পড়ি। পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন আপুকে জিজ্ঞাসা করি, ভাইয়া আসেনি? মিম বলেÑ তোর ভাইয়ার ডিউটি বর্ডার পর্যন্ত। এখন অন্যের ডিউটি। শোন, আমরা এখন রেলস্টেশনে যাব। তারপর যেখানে যাব সেখানে যেতে তিন দিন লাগবে। সেখানে কাজ শেষে তোকে দেশে নিয়ে যাব। আমি তখন ওদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করি আর পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকি। রাত দেড়টার দিকে দেখি চারজন পুলিশ ট্রেনের বগি বরাবর দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে এক দৌড় দিয়ে এক পুলিশ আঙ্কেলের পায়ে ধরে বলি, ‘আমাকে বাঁচান। ওরা আমাকে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসছে। কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ তখন বগির মধ্যে গিয়ে মিমকে আটক করে।’

ভুক্তভোগী শিশুর বাবার অভিযোগ, ভারতীয় পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পরও মিম আমার মেয়েকে ভয় দেখিয়ে বলেছে, ‘ওই রাতে তোর অনেক আপত্তিকর ছবি তোলা হয়েছে। যদি আমি ফেঁসে যাই তাহলে তুই আর দেশে কাউকে মুখ দেখাতে পারবি না। শিশুটির বাবা আরও বলেন, স্বল্প বেতনের চাকরি করে কোনোভাবে জীবনযাপন করছি। আমার পক্ষে পাসপোর্ট, ভিসা করে ভারত যাওয়ার মতো টাকা জোগাড় করা অসম্ভব। আমার মেয়েটা কেমন আছে, কীভাবে আছে জানি না। শুনেছি একটা সেফ হোমে তাকে রাখা হয়েছে। আমি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে সবার কাছে অনুরোধ জানাই।’

নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা পরিদর্শক (অপারেশন) আয়ান মাহমুদ এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের ধারণা এটা সংঘবদ্ধ মানব পাচার চক্রের কাজ। এর সঙ্গে জড়িতদের সন্ধান চলছে। ভুক্তভোগী মেয়েটি দেশে ফিরলে মামলা নেওয়া হবে। আসামিদেরও গ্রেপ্তার করা হবে। এখন মেয়েটিকে কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।’ 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা