‘মুল্লুকে চলো’ আন্দোলনের ১০৩ বছর
ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৪ ১৩:১২ পিএম
মৌলভীবাজারের একটি চা-বাগানে কর্মরত নারী শ্রমিকরা। প্রবা ফটো
আজ ২০ মে- চা-শ্রমিক দিবস। ১০৩ বছর আগে; ১৯২১ সালের এই দিনে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ও মালিকপক্ষ কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর মহকুমার (বর্তমান চাঁদপুর জেলা) জাহাজ ঘাটে চা-শ্রমিকদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায়। তাতে প্রাণ হারান হাজারো চা-শ্রমিক। নিরীহ চা-শ্রমিকদের রক্তে ভেজা এ আন্দোলন চা শিল্পাঞ্চলে ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলন হিসেবে পরিচিত।
ইতিহাসের নানা বই এবং প্রবীণ চা-শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশরা সিলেট ও আসামের বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে চায়ের বাগান গড়ে তোলে। চা-বাগানগুলোতে আবাদ ও অন্যান্য কাজের জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর শ্রমিকের। স্থানীয়রা এসব কাজে আগ্রহী না হওয়ায় উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে ভারতের দারিদ্রপীড়িত বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজনকে চা-বাগানে আনা হতো। এছাড়া দলিত ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজনও উন্নত জীবনের প্রলোভনে পাড়ি জমাত সিলেট ও আসামের চা শিল্পাঞ্চলে। তবে বাস্তবতা বুঝতে তাদের সময় লাগেনি। নানা বিপত্তি আর মালিকপক্ষের অমানবিক আচরণ ও নির্যাতন মেনে নিয়েও অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হতেন তারা। বাগানের বাইরে যাওয়া ছিল তাদের জন্য নিষিদ্ধ। পারিশ্রমিক হিসেবে ‘টি-টোকেন’ নামক একধরনের ধাতব বস্তু দেওয়া হতো তাদের। এসব ধাতব বস্তু দিয়ে বাইরে কেনাকাটা করার কোনো সুযোগ ছিল না। শুধু চা-বাগানের অভ্যন্তরে স্থাপিত নির্ধারিত দোকান থেকেই তারা কেনাকাটা করতে পারতেন। এমনকি চাইলেও এ চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে পারতেন না তারা। এসব নিয়ে চা-বাগানের শ্রমিকদের মাঝে জমা হতে থাকে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ।
আসাম লেবার এনকোয়েরি কমিটির ১৯১৯-২১ সালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অসন্তোষ জমতে জমতে ১৯২১ সালের মে মাসে চা-শ্রমিকরা ‘মুল্লুকে চলো’ বা নিজ জন্মস্থানে যাত্রার ব্যাপারে মনস্থির করেন। ‘মুল্লুক’ যাওয়ার জন্য করিমগঞ্জে আগত প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিককে আটকে দিতে বন্ধ করে দেওয়া হয় সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা। শ্রমিকরা সিদ্ধান্ত নিলেন তারা পায়ে হেঁটেই দেশে ফিরবেন। আসাম থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক করিমগঞ্জ, বদরপুর, সিলেটের কুলাউড়া হয়ে ১৯২১ সালের ১৯ মে চাঁদপুর জাহাজ ঘাটে পৌঁছান। এর আগে খাদ্য ও পানির অভাবে পথেই মৃত্যু হয় অনেকের। ২০ মে রাতে জাহাজে উঠতে থাকা শ্রমিকদের ওপর চাঁদপুর মহকুমার তৎকালীন প্রশাসক সুশীল কুমার সিংহের নেতৃত্বে রাইফেলসের গুর্খা সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সময় জাহাজের পাটাতন সরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শত শত শিশু, বৃদ্ধ ও নারী-পুরুষ মেঘনার জলে ভেসে যায়। এ ছাড়া গুর্খা সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালায় এবং বেয়নেট চার্জ করে। শ্রমিকের রক্তে লাল হয়ে ওঠে প্রমত্তা মেঘনার জল। তবে এ আন্দোলনে কতজন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছিলেন আর কতজন আহত হয়েছিলেন, তার কোনো হিসাব কোথাও নেই।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল যে মেঘনার পাড় সেখানে নেই কোনো স্মৃতিচিহ্ন বা স্তম্ভ। তবে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি চা-বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের উদ্যোগে ও অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে ‘মুল্লুক চলো’ ভাস্কর্য। এ ছাড়া ২০০৮ সাল থেকে দেশের প্রায় সবগুলো চা-বাগানের শ্রমিকরা প্রতিটি বাগানে অস্থায়ী বেদী নির্মাণ করে দিনটিকে চা-শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন।
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রামভজন কৈরি বলেন, ‘শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও বারবার দাবি জানিয়েও এ দিবসের স্বীকৃতি মেলেনি। এখনও চা-শ্রমিকরা বঞ্চিত। আমরা চা-শ্রমিক দিবসের স্বীকৃতি চাই।’