সিদ্দিকুর রহমান রোমন
প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৪ ১০:৫৭ এএম
আপডেট : ০৯ মে ২০২৪ ১৮:০১ পিএম
পাইলিংয়ের গভীরতা ‘গভীর’ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার মালেক মিয়া মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রের নির্মাণকাজ নিয়ে। প্রবা ফটো
ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইনে পাইলিংয়ের গভীরতা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তা অর্ধেকের বেশি কমিয়ে দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পাইলিংয়ের গভীরতা নিয়ে এমন ‘গভীর’ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের লুন্দি এলাকায় নির্মাণাধীন মালেক মিয়া মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রের নির্মাণকাজ নিয়ে। ৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ে এই তিনতলা ভবনের নির্মাণকাজ করছে মারুফ ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন ভবনটি নির্মাণের আগে সয়েল টেস্ট করা হলে দেখা যায়, সেখানকার মাটির গুণগত মান খুব একটা উপযোগী নয়। ফলে ডিজাইনের সময় সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী পাইলিংয়ের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে দেন ৭০ থেকে ৭২ ফুট। ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে শুরু থেকেই অনিয়ম ধরা পড়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজে। ডিজাইনে পাইলিংয়ের শর্ত মানেনি তারা। ড্রয়িং অনুযায়ী ২ ফুট লেপিংসহ ৭২ ফুট গভীর পর্যন্ত পাইল বসানোর কথা থাকলেও তারা মোট ৫৪টির মধ্যে ৪৯টি পাইল করেছে ৩০ ফুট করে। কেবল যেদিন প্রকৌশলীর উপস্থিতিতে কাজের উদ্বোধন হয় সেদিন একটি পাইলিংয়ের কাজ সঠিকভাবে করা হয়, যা ছিল পুরোপুরি ৭২ ফুটের। এ ছাড়া বোরিং শেষ করার পর ২০ থেকে ৩০ মিনিট ওয়াশ করার কথা থাকলেও গোপনে ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, ওয়াশ ছাড়াই খাঁচায় ঢুকিয়ে ঢালাই শেষ করা হয়েছে। গোড়াতেই এমন অনিয়মের ফলে ভবনটির স্থায়িত্ব নিয়ে এখনই দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে।
ভিডিওতে আরও দেখা গেছে, ঢালাই সিমেন্ট সিম-ওয়ান (সিম-১) দিয়ে করার কথা থাকলেও মারুফ ইন্টারন্যাশনাল তা না করে কম শক্তিসম্পন্ন সিম-টু (সিম-২) ব্যবহার করেছে। যেটা পরে বড়সড় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রসঙ্গত, সিম-ওয়ান মাটির নিচে দ্রুততার সঙ্গে জমাট বাঁধতে সহায়তা করে, যা দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিন্তু সিম-টু হচ্ছে সিম-ওয়ানের বিপরীতধর্মী। চুক্তিতে সিম-১ ব্যবহারের কথা থাকলেও তারা ব্যবহার করে কম দামি সিমেন্ট সিম-২। অন্যদিকে প্রতিটি পাইলিংয়ের অ্যাড-মিক্সার (সাদা তরল পদার্থ) ব্যবহার করার কথা থাকলেও তারা কোনো প্রকার অ্যাড-মিক্সার বা সাদা তরল ব্যবহার করেনি।
আরও জানা যায়, ইস্টিমেট অনুযায়ী প্রতিটি পাইলিংয়ে ২২ থেকে ২৭ ব্যাগ সিমেন্ট লাগার কথা। কিন্তু বাস্তবে মাত্র ৭ থেকে ৮ ব্যাগ সিমেন্ট দিয়েই কাজ শেষ করা হয়েছে। অন্যদিকে ৭২ ফুট পাইল ঢালাইয়ের জন্য অন্তত দুটি খাঁচি ব্যবহার করার কথা ছিল, যেমন একটি খাঁচি ৪০ ফুটের ও অন্যটি ৩২ ফুটের। এই দুই খাঁচি ওয়েল্ডিং করে ঝালাই দেওয়ার কথা। কিন্তু এ ভবনে একটি খাঁচি ব্যবহার করে কোনোরকমে কাজ সেরেছে।
এই অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে স্কুল কমিটির সভাপতি শাওন হালদার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, জায়গাটিতে পাইলিং করার সময় স্কুল কর্তৃপক্ষের কোনো লোককেই রাখা হয়নি। মারুফ ইন্টারন্যাশনাল কাউকে না জানিয়েই পাইলিংয়ের কাজ শুরু করে দেয়।
তিনি আরও জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির কথা জানার পর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) অফিস থেকে ঢালাইয়ের আগে ওই পাইল টেস্টের রিপোর্ট দেওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত কোনো রিপোর্ট না দিয়েই তারা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ঢালাই দিতে নিষেধ করা সত্ত্বেও তারা শুনছে না।
এ বিষয়ে পিআইও এইচএম মাহবুব হোসেন অবশ্য ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, স্কুল সভাপতির সঙ্গে কথা বলেই ঢালাইয়ের কাজ করা হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে নির্মাণকাজের সাইটে গেলেও সেখানে দায়িত্বরত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমানের কাছে বিষয়টি তুলে ধরা হলে তিনি স্কুল বা আশ্রয়কেন্দ্রের প্রকল্প নিয়ে কোনো রকম দুর্নীতি হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান।