নূর-ই-আলম চঞ্চল, শেরপুর
প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৪ ১২:২৪ পিএম
ভারত সীমান্ত ঘেঁষা শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের গারো পাহাড়ের শাল-গজারির বনে জ্বলছে আগুন। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো
ভারত সীমান্ত ঘেঁষা শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ও নলকূড়া ইউনিয়নের গারো পাহাড়ের শাল-গজারির বনে অন্তত ১৫টি স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে বন ও পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য। পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে মাটির গুণগত মান।
কয়েক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে কয়েকটি পাহাড়ি বন পুড়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, বনের জমি দখল ও কাঠ সংগ্রহ করতে আসা দুর্বৃত্তরা এ আগুনের ঘটনা ঘটিয়েছে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, বছরের পর বছর ধরে চলছে বন পোড়ানো। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে বনে আগুন দেওয়ার ফলে পুড়ে যায় ছোট গজারি গাছ (শালকপিচ), ঝোপঝাড়, লতাপাতা, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গসহ নাম না জানা বিভিন্ন প্রাণী। এতে নতুন গাছ যেমন গজায় না তেমনি নষ্ট হচ্ছে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহ বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের আওতায় ৩টি বিট কার্যালয় রয়েছে। এ তিনটি বিট কার্যালয়ের আওতায় বনভূমি রয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৮৮০ একর। এর মধ্যে বেশিরভাগ জমিতে শাল-গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালাসমৃদ্ধ বন রয়েছে। প্রতি বছরের ফাল্গুন-চৈত্র মাসে শাল-গজারিসহ বিভিন্ন গাছপালার পাতা ঝরে। বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলাচলের জন্য সড়কপথ থাকায় খুব সহজেই দুর্বৃত্তরা রাতে আবার কখনও দিনেও বনে আগুন দেয়। শুকনা ঝরাপাতার কারণে মুহূর্তেই বনে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। কিন্তু এসব ঘটনায় জড়িতরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয়রা বলছেন, আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় বছরের পর বছর চলছে বন পোড়ানোর মতো ঘটনা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঝিনাইগাতী-কামালপুর সড়কের ময়মনসিংহ বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের গজনী বিট এলাকায় পাহাড়ের কয়েকটি স্থানে বড় জায়গাজুড়ে আগুন জ্বলছে। আবার দুইটি স্থানে অল্প পরিসরে আগুন জ্বলছে। স্থানীয়দের
কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, কে বা কারা ঘণ্টাখানেক আগে এখানে আগুন দিয়েছে। তারা আরও জানান, গত দুই সপ্তাহে শাল-গজারি বনের কমপক্ষে ১৫টি স্থান আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
গান্ধীগাঁও গ্রামের বাসিন্দা আল আমিন। তিনি বলেন, বনের ভেতর অসংখ্য রাস্তা রয়েছে। কে কখন কোন রাস্তা দিয়ে এসে আগুন দিচ্ছে, তা আসলেই বোঝার উপায় নেই। তবে কিছুদিন ধরে মাঝেমধ্যেই বনের ভেতর আগুনের দেখা মিলছে।
রাংটিয়া রেঞ্জের কাংশা ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য হযরত আলী বলেন, প্রতি বছর এ মৌসুমে বনে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। মাঝেমধ্যে বিট কার্যালয়ের আশপাশের বনেও আগুন জ্বলতে দেখি। এরপরও এসব বন্ধের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয় না বন বিভাগ।
বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি ঝিনাইগাতী শাখার সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন বলেন, যুগ যুগ ধরে মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে পরিবেশের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে। মানুষের অপতৎপরতা, বিশেষ করে বিজ্ঞানের উন্নতির পর থেকে দ্রুতগতিতে ছোট-বড় প্রাণী, গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশ করেছে। এসবের ক্ষতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। এর প্রমাণ বর্তমানে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। পৃথিবীর সব অঞ্চলেই খরা, বন্যা ও পশু-পাখির বিলুপ্তি ঘটছে। জরুরি ভিত্তিতে সাধারণ মানুষকে পরিবেশ ও বন সম্পর্কে সচেতন করতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। মানুষকে যেহেতু পরিবেশে বাস করতেই হবে, সেহেতু তাদের উচিত নিজেদের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবেশের মৌলিক উপাদানগুলো যথাযথ সংরক্ষণ করা।
পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রীন ভয়েজের জেলা শাখার সভাপতি সংবাদকর্মী রফিক মজিদ বলেন, শেরপুরের বনভূমি উজাড় রোধে এবং পাহাড় থেকে পাথর ও বালু উত্তোলন বন্ধ, বনভূমি বেদখল, বনের ভেতর আলো ও শব্দদূষণ রোধের দাবি আমাদের অনেক দিনের। পাশাপাশি বনে আগুন দেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
রাংটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল করিম বলেন, বর্তমান সময়ে শাল-গজারিসহ বিভিন্ন গাছপালার পাতা ঝরে পড়ে দুই-তিন ইঞ্চি উঁচু স্তরে জমা আছে। এতে আগুন ধরিয়ে দিলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বনের ভেতর আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে আমার অল্পসংখ্যক কর্মী নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। পাশাপাশি দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।