নড়াইল ইসলামিক ফাউন্ডেশন
এস কে সুজয়, নড়াইল
প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৪ ১২:১৪ পিএম
ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক জাকাতের নামে শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। প্রবা ফটো
নড়াইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, উৎকোচ না দেওয়ায় গত এক বছরে ৪৫ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, সেসব শূন্যপদের বিপরীতে অর্থের বিনিময়ে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষকরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি শুনানির জন্য ভুক্তভোগী শিক্ষক ও উপপরিচালক মিজানুর রহমানকে আগামী ৭ মে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সরাসরি উপস্থিত হতে বলা হয়েছে।
শিক্ষকদের লিখিত অভিযোগে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম নড়াইলে বেশ সুনামের সঙ্গে চলে আসছে। ২০২৩ সালের ১ মার্চ বর্তমান উপপরিচালক মিজানুর রহমান যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়ম শুরু হয়েছে। ফাউন্ডেশনের ৪৮২টি কেন্দ্রের শিক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের হয়রানি করা হচ্ছে। শিক্ষকদের কাছে ঘুষ দাবি করছেন তিনি। ঘুষ দিতে না পারায় ৪৫ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের কাছে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ নিচ্ছেন মিজানুর রহমান। দেড় লাখ টাকা ঘুষ দাবির একটি অডিও রেকর্ড রয়েছে বলে একজন ভুক্তভোগী দাবি করেছেন। জেলার কালিয়া উপজেলার বাবরা মধ্যপাড়ার সোনিয়া পারভীন বলেন, প্রায় আট মাস আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন অফিস থেকে আমার কাছে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করা হয়। আমি নিয়মিত কেন্দ্র পরিচালনা করলেও ঘুষের ৩০ হাজার টাকা দিতে না পারায় আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। জানুয়ারি থেকে সম্মানীর পাঁচ হাজার টাকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সোনিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিলে চাকরি থাকে, না দিলে থাকে না।
জেলা শহরের ভাওয়াখালী এলাকার খাজিদা খানম বলেন, আমাকে অফিসে ডেকে নিয়ে সাদা কাগজে সই নেওয়া হয়েছে। পরে জানতে পারি, আমার চাকরি নেই। ঘুষের টাকা দিতে না পারায় আমাকে চাকরি হারাতে হয়েছে।
লোহাগড়া উপজেলার মাকড়াইল খানপাড়া কেন্দ্রের শিক্ষক সানজিদা খানম একইভাবে বলেন, ‘আমি অসহায় বিধবা। এই চাকরি আমার সংসারের একমাত্র আয়ের উৎস। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনে আমি কোনো রকম সংসার চালাতাম। আমাকে বিনা নোটিসে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
শুধু শিক্ষকদের কাছে ঘুষ দাবি নয়, তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা রকম আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ। ২০২৩ সালে ৪৮২ শিক্ষকের কাছ থেকে জাকাতের কথা বলে জোরপূর্বক জনপ্রতি এক হাজার টাকা করে মোট ৪ লাখ ৮২ হাজার টাকা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। একই কথা এ বছর নেওয়া হয়েছে জনপ্রতি দুই হাজার টাকা করে। ২০২৩ সালে নড়াইল থেকে ৫০০ ইমাম ঢাকায় ইমাম সম্মেলনে যোগ দেন। তাদের প্রত্যেককে ১ হাজার ২০০ টাকা করে দেওয়ার কথা থাকলেও কেউ টাকা পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে জনসচেতনতামূলক উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও শিক্ষকদের কোনো সম্মানী দেওয়া হয়নি। সদর উপজেলার কমলাপুর কেন্দ্রের শিক্ষক মাওলানা ইদ্রিস আলী বলেন, আমার উঠান বৈঠকে ৪০ জনের বেশি উপস্থিত ছিল। আমাকে সম্মানী বাবদ ১৫০০ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও আমি আজও কোনো টাকা পাইনি। ফাউন্ডেশনের সুপারভাইজার ফাইজার রহমানের কাছে টাকা চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি টাকা কাকে দেব না দেব সেটা আমার বিষয়। এই টাকার ভাগ উপপরিচালক মিজানুর রহমানকে দেওয়া লাগে। অভিযোগ করে কোনো লাভ হবে না।’ ইদ্রিস আলী ঘটনাটি উপপরিচালক মিজানুর রহমানকে জানান। তখন মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমি দেখছি।’ কিন্তু তার সেই দেখা এখনও শেষ হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফাউন্ডেশন অফিসের এক কর্মচারী বলেন, ‘উপপরিচালক মিজানুর রহমান স্যার আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। প্রায় আট বছরের চাকরিজীবনে তিনি কয়েকটি ট্রাক ও মাটিকাটার মেশিনের মালিক হয়েছেন। তার বাগেরহাটের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি নড়াইলের মহাজন এলাকায় রয়েছে কোটি টাকার জমি।’
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সুপারভাইজার ফাইজার রহমান ও উপপরিচালক মিজানুর রহমান। ফাইজার রহমান বলেন, ‘চাকরির জন্য কারোর কাছে কোনো প্রকার টাকা দাবি করিনি। উঠান বৈঠকের টাকাও আত্মসাতের প্রশ্ন ওঠে না। কারোর চাকরি খাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।’ আর উপপরিচালক মিজানুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা ঠিক নয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে আমার একার কোনো হাত নেই। অফিসিয়াল নিয়মানুযায়ী চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ইমাম সম্মেলনে ইমামদের সম্মানীর টাকা যাতায়াত ও খাওয়া খরচ বাবদ ব্যয় করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে জাকাত বাবদ ২০২৩ সালে এক হাজার ও ২০২৪ সালে দুই হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে।’
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে কে বা কারা চাপ দিয়েছে সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কারও নাম বলতে পারেননি। এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) এম এম আরাফাত হোসেন বলেন, ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’