শরিয়ত উল্যাহ রিফাত, সোনাগাজী (ফেনী)
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৪ ১৫:৫১ পিএম
নিয়ম না মেনে বালু উত্তোলনের ফলে ছোট ফেনী নদীর ওপর নির্মিত সাহেবেরঘাট সেতুর পশ্চিমে ৫ কোটি টাকার পাড় রক্ষা ব্লকগুলো নদীতেই তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। প্রবা ফটো
ফেনীর সোনাগাজীতে ইজারা বহির্ভূত অবৈধ বালু মহাল গড়ে তুলেছে একটি প্রভাবশালী চক্র। নিয়ম না মেনে বালু উত্তোলনের ফলে ছোট ফেনী নদীর ওপর নির্মিত সাহেবেরঘাট সেতুর পশ্চিমে ৫ কোটি টাকার পাড় রক্ষা ব্লকগুলো নদীতেই তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে চারণভূমি। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারদলীয় ছত্রছায়ায় থাকা এসব অবৈধ বালু উত্তোলনকারীর বিরুদ্ধে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে বারবার অবহিত করা হলেও অজ্ঞাত কারণে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলা প্রশাসনের অনুমোদনে সাহেবেরঘাট সেতুর এক কিলোমিটার উত্তরে ছোট ফেনী নদীর চরদরবেশ মৌজায় বিএস খতিয়ানের ২০০২ দাগের সাড়ে ৯ একর জায়গাজুড়ে রয়েছে বালুমহাল। তবে গত চার বছর ধরে বালুমহালের ইজারাদার নদীর অনুমোদিত জায়গা থেকে বালু উত্তোলন না করে সাহেবেরঘাট সেতুসংলগ্ন জায়গা থেকে বালু উত্তোলন করেছে। এতে নদীর পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি পিলারের নিচে মাটি সরে গিয়ে হুমকির মধ্যে পড়েছে সেতু। উত্তোলনকৃত বালু খালে স্তূপ করায় বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহের পথ বন্ধ হয়ে চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের বিশাল এলাকা জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এ বিষয়ে প্রশাসনের কাছে বারবার অভিযোগ দিলেও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। এদিকে গত তিন মাস ধরে প্রভাবশালী চক্রটি সেতুর দক্ষিণে ছোট ফেনী নদীর পশ্চিম চরদরবেশ মৌজার বিএস খতিয়ানের ৯২১ দাগের কয়েক একর জায়গাজুড়ে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন শুরু করেছে। চক্রটি পাইপের মাধ্যমে নদীর পাড়ের সরকারি খাসজমি ও কয়েকটি পুকুরে জমা করে অবৈধ বালুমহাল গড়ে তুলেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বালুমহালে একটি এক্সকাভেটর ট্রাকে বালু তুলে দিচ্ছে, বালুভর্তি একাধিক ট্রাক বিভিন্ন গন্তব্যে আসা-যাওয়া করছে। এক্সকাভেটর চালক আব্দুল হালিম জানান, স্থানীয় যুবলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক সেন্টু দৈনিক মজুরিতে তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। বালু বহনকারী ট্রাকের ড্রাইভার কামাল উদ্দিন বলেন, সরকারি ঠিকাদার জামাল উদ্দিনের কেনা বালু তিনি ভাড়ায় গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছি। এসময় তিনি একটি মেমো দেখান। যেখানে লিখা রয়েছে, ‘প্রত্যয় এন্টারপ্রাইজ, প্রোপাইটার-মজিবুল হক, রেফারেন্স সেন্টু মিয়া’।
একাধিক ট্রাকচালক জানান, প্রতিদিন অন্তত ৬০-৭০ ট্রাক বালু ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে হয়। প্রতি ট্রাক বালুর দাম ১ হাজার ৯০০ টাকা।
বালুমহালের পাহারাদার আব্দুল মতিন বলেন, ‘আমাকে উপজেলা প্রশাসনের স্যার নিয়োগ দিলেও বেতন দেয় সেন্টু মিয়া।’
আলাউদ্দিন নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, প্রতিদিন অন্তত ২০টি ট্রাককে দুইশ ট্রিপ বালু বহন করতে দেখেছেন। এ হিসাবে প্রতিদিন অন্তত চার লাখ টাকার আর প্রতিমাসে প্রায় এক কোটি টাকার বালু বিক্রি হচ্ছে। এরা নদী থেকে বালু তুলে পুকুর ও জমিতে জমা করার পর বালু উত্তোলন কয়েক দিন বন্ধ রাখে। এভাবে গত তিন মাস ধরে প্রকাশ্যে বালু উত্তোলন ও বিক্রি করা হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
চরচান্দিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন আকুল বলেন, আগে চরচান্দিয়া ও চরদরবেশ ইউনিয়নের দুই শতাধিক খামারি উপকূলীয় অঞ্চলটিকে গরু মহিষ লালন-পালন করত। গত কয়েক মাস ধরে ছোট ফেনী নদীর জেগে ওঠা চারণভূমির পাশে থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে চারণভূমি ভেঙে নদীতে হারিয়ে যাওয়ায় পশুরা খাদ্য সংকটে পড়েছে। একই সঙ্গে নদীর পাড় ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পেতে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা ব্লকও নদীতে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
অভিযুক্ত আব্দুর রাজ্জাক সেন্টু ওরফে সেন্টু মিয়া সোনাগাজী উপজেলা যুবলীগের ৭১ নম্বর সদস্য। অতীতে ছাত্রলীগ-যুবলীগের রাজনীতিতে জড়িত না থাকলেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী রহিম উল্যাহর সঙ্গে সখ্য থাকায় ঠিকাদারিতে যুক্ত হন। পরে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আজিজুল হক হিরনের আস্থাভাজন হয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন। সম্প্রতি সাহেবেরঘাট ব্রিজের টোল আদায়ের দরপত্র জমা দানকালে সেন্টু তার বাহিনী ঠিকাদার আক্কাস আলীকে অপহরণ ও মারধর করে দরপত্র ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় মামলা হয়। পরে ফেনীর সড়ক ও জনপদ বিভাগ টেন্ডার বাতিল করে সাহেবের ঘাট সেতুর টোল আদায়ে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করে।
বালুমহাল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আব্দুর রাজ্জাক সেন্টু ওরফে সেন্টু মিয়ার মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি সাংবাদিকদের নামে বিষোদগার করে জানান, এ বিষয়ে কেউ তার কিছুই করতে পারবে না।
সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান জানান, ছোট ফেনী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়টি তার জানা নেই। উপজেলা প্রশাসন থেকে বালু উত্তোলনকারীদের সহায়তার অভিযোগও সত্য নয়। আমরা অবৈধ বালু উত্তোলনের খবরে অভিযান পরিচালনা করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
ফেনী জেলা প্রশাসক মোছাম্মদ শাহিনা আক্তারকে এ বিষয়ে অবহিত করা হলে তিনি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়ে বিস্তারিত তার হোয়াটসঅ্যাপে জানাতে অনুরোধ করেন। প্রতিবেদক বিস্তারিত হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানোর তিন দিন পরও সরেজমিনে প্রশাসনের কাউকেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে দেখা যায়নি।