ভোলা সংবাদদাতা
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২২ ০৯:৪৯ এএম
আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২২ ১০:০৭ এএম
৭০-এর প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের পরের দৃশ্য। ফাইল ফটো
তখন ভোর সাড়ে ৩টা। হঠাৎ বাতাসের শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পানিতে তলিয়ে যায় পুরো ঘর। সবার যেন বাঁচার আকুতি। মুহুর্তের মধ্যে চোখের সামনে আটজন ভেসে যায়। এদের মধ্যে সাত জনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সকালে দেখা মিললো খেজুর গাছের ওপরে ছোট বোন রাশিদার লাশ।
শুধু তাই নয়, চারদিকে লাশের সারি। লাশ দেখলেই বোঝা যায়, জীবন বাঁচাতে তারা শেষ পর্যন্ত কত লড়াই করেছিলেন। কোনো লাশ গাছে ঝুলে আছে আবার কোনোটি মাটিতে পড়ে আছে। লাশের পাশে স্বজনদের কান্না আহাজারি। অনেক লাশ পানিতে ভেসে গেছে, খুঁজে পায়নি পরিবারের সদস্যরা। ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের এভাবেই বর্ননা দিচ্ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী ভোলার মদনপুরের অজিউল্ল্যাহ।
তিনি বলেন, হঠাৎ করেই দেখতে পান পাঁচটি মেয়ে পানিতে ভেসে এসেছে, তখনও তারা জীবিত। তাদের বাঁচাতে ছুটে যান তার বাবা মোজাম্মেল হক। পুরো এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তাদের চুল গাছের সঙ্গে বেঁধে বাঁচানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তাদের মধ্যে দুইজন বেঁচে গেলেও বাকিরা মারা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী ইউসুফ জানান, চারদিকে বাতাসের শো শো শব্দের সঙ্গে হঠাৎ করেই পানির স্রোতে রাতেই তাদের পরিবারের সাত জনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তখন একটি গাছের সঙ্গে তারা আশ্রয় নেয়।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মদনপুরের মজিবুল হক জানান, ওই ঝড়ে তার বাবাসহ পরিবারের চারজন মারা যান। পরিবারের তখন সাতজন একটি বড় গাছের ওপরে আশ্রয় নেয়, কিন্তু তার বাবা ঠাণ্ডার কারণে আস্তে আস্তে শরীর নিস্তেজ হয়ে মারা যান।
৭০ এর ভয়াল সেই দিনের লোমহর্ষক বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে ইউসুফ, অলিউল্ল্যাহ ও মজিবুলের মত অনেকেই কেঁদে ফেলেন। সেই ঝড়ে কেউ বাবা, কেউ মা, কেউবা পরিবারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যাক্তিকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। স্বজনদের হারিয়ে আজো কেঁদে ওঠেন ওই সব পরিবারগুলো। প্রলংকারী ঝড়ের কথা মনে করে আজো আতঁকে উঠেন মানুষ।
সেদিনের ঝড়ে স্বজনহারা মনির বলেন, ‘ঝড়ে আমার তিন বোনকে হারিয়েছি। তাদের কথা মনে করে আজো মা কাঁদেন।’
তুলাতলী এলাকার বাদশা মিয়া বলেন, ‘মেঘনা নদী দিয়ে মানুষের মরদেহ ভাসতে দেখেছি। অনেক মানুষ উদ্ধার করেছি। বাকি মরদেহ স্রোতে ভেসে গেছে।’
স্থানীয় রহমত আলী, ছিদ্দিক ও সিরাজ উদ্দিন বলেন, সেদিনের ঝড়ে মদনপুরের ১৮টি ঘরের মধ্যে ৪০ জনের মরদেহ পাওয়া যায়। একটি পরিবারে কেউ বেঁচে ছিলেন না।
প্রত্যক্ষদর্শী শাহে আলম বলেন, সেদিন দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল। রাতে পুরো দমে ঝড় শুরু হয়। ভোরে জলোচ্ছ্বাসে মানুষ মারা যায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন উপজেলায়।
প্রবীন সংবাদিক ও ভোলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এম হাবিবুর রহমান বলেন, বন্যার পরে দেখেছি সাপ আর মানুষ দৌলতখানের চৌকিঘাটে জড়িয়ে পড়ে আছে। স্নেহময়ী মা তার শিশুকে কোলে জড়িয়ে পড়ে আছে মেঘনার পাড়ে। সোনাপুরের একটি বাগানে গাছের ডালে এক মহিলার লাশ ঝুলছে। এমনিভাবে মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমুদ্দিন ও দৌলতখানসহ সমগ্র জেলায় মানুষ আর গবাদি পশু সেদিন বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলে ভেসে গেছে। জন-মানুষ শূন্য হয়ে পড়েছিলো দ্বীপজেলা ভোলা।
ভয়ানক সেই ঝড়ের কথা এখনো ভুলেনি উপকূলের মানুষ। গাছে ঝুলে ছিল অনেকের মরদেহ। বাঁচার লড়াই করেছেন অনেকে। কেউ বেঁচেছেন তবে বেশিরভাগই তাদের স্বজনদের হারিয়েছেন।
এদিকে উপকূলবাসীদের অভিযোগ, উপকূলে একের পর এক দুর্যোগ আঘাত হানলেও আজো উপকূলবাসীর জন্য টেকশই বেড়িবাঁধ কিংবা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ হয়নি। প্রতিবছরই ঝড় আসে। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু এখানের মানুষ মৃত্যু ঝুঁকিতে ভোগে। ঝড় কিংবা ঘূর্ণিঝড় আসলেই মৃত্যু তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।
১৯৭০ সালের এই দিনে পুরো উপকূলবাসীর জীবনে নেমে আসে এক মহাদুর্যোগ। এতে প্রাণ হারায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। মহাপ্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে নিমিষে উপকূলীয় চরাঞ্চলে ১০ থেকে ১২ ফুট পানিতে বাড়িঘর, সোনালি ফসলের মাঠ, উঠানে স্তূপাকার ও গোলা ভরা পাকা ধান তলিয়ে যায়। স্রোতের তোড়ে হাজার হাজার মানুষ ও কয়েক লাখ গরু-মহিষ ভেসে যায়। বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয় পুরো উপকূলীয় এলাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাপক ফসলি জমি, প্রাণী ও বনজসম্পদ।
এ কারণে এই ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস ঘোষণার দাবিতে ভোলায় বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটি প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও দিবসটি পালন করছে।
ওই কমিটির উদ্যোক্তা উপকূল সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, এ বছরের দেশের ৫০টি জেলায় দিবসটি পালিত হবে। ঝড়ে নিহতদের স্মরণ এবং ভয়াল সেই দিনটিকে মনে রাখতেই এ আয়োজন।