মানব পাচার
সাইফ বাবলু, ঢাকা ও সাইফুল ইসলাম, মাদারীপুর
প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৪ ১২:১৭ পিএম
আপডেট : ০৪ মে ২০২৪ ১২:২৭ পিএম
ভূমদ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে তিউনিসিয়া উপকূলে মারা যান মাদারীপুরের পাঁচজন ও গোপালগঞ্জের তিনজন। শুক্রবার ময়নাতদন্তর জন্য তাদের মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল মর্গে। প্রিয়জনের লাশ নিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন মাদারীপুরের এক নারী। ছবি : আলী হোসেন মিন্টু
‘আমাদের আর কেউ রইল না। এখন দুই মেয়েকে নিয়ে কীভাবে বাঁচব। আমার স্বামীকে যারা মেরেছে তাদের বিচার যেন আল্লাহ দুনিয়াতেই করেন।’
শুক্রবার (৩ মে) সকাল ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এভাবেই বিলাপ করছিলেন মাদারীপুরের রাজৈর থানার কেশরদিয়া গ্রামের গৃহবধূ নাজমা বেগম। আড়াই মাস আগে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার সময় নৌকার ইঞ্জিনরুমে আটকে থেকে তিউনিসিয়ার উপকূলে মারা যাওয়া স্বামী কায়সার খলিফার মরদেহ বুঝে নিতে এসেছেন তিনি। একই এলাকার আরও কয়েকজন এসেছেন তাদের স্বজনের মরদেহ নিতে। তাদের সবার মিলিত আহাজারিতে মর্গের চারপাশে হৃদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
কাউসার খলিফাসহ ২২ জন বাংলাদেশি ভাগ্যান্বেষণে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে অবৈধভাবে ট্রলারযোগে ইতালির পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাদের সবাই মাদারীপুরের রাজৈর ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বাসিন্দা। এদের মধ্যে ৯ জনের মৃত্যু হয়। তবে ৮ জনের লাশ ২ মে দেশে ফেরে কফিনবন্দি হয়ে। এই ৮ জনের পাঁচজনই মাদারীপুরের রাজৈরের বাসিন্দা। বাকি তিনজন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের।
মাদারীপুরের নিহতরা হলেনÑ রাজৈরের কেশরদিয়া গ্রামের তোতা খলিফার ছেলে কায়সার খলিফা, কোদালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান কাজীর ছেলে সজীব কাজী, পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ, সোনাদিয়া গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী ও উত্তরপাড়া গ্রামের পরিতোষ বিশ্বাসের ছেলে নয়ন বিশ্বাস।
রাজৈরে স্বজনদের মাতম
ইতালি যাওয়ার সময় তিউনিসিয়ার উপকূলে লাশ হওয়া ৮ বাংলাদেশির ৫ জনেরই বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর থানার বিভিন্ন ইউনিয়নে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার ৭৮ দিন পর গতকাল তাদের মরদেহ এসে পৌঁছে অ্যাম্বুলেন্সে। তার আগে স্বজনরা দাফন এবং দাহ করার প্রস্তুতি নিয়ে রাখে।
স্বরমঙ্গল গ্রামের মামুন শেখের মরদেহ যখন বাড়ি পৌঁছে, তখন ছেলের কফিন দেখে বুকফাটা আর্তনাদ করতে থাকেন মা হাফিজা বেগম। স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। মা হাফিজা বেগম বলেন, ‘আমার বাজানে আমাগো ভালো রাখতে চাইছিল। আমাগো জন্য নতুন ঘর বানাইয়া দিব। লাখ টাকা আয় করব। আমার বাজানের কত স্বপ্ন ছিল। সব শেষ হইয়া গেছে। হায় কপাল আমার।’
একই দৃশ্য দেখা গেছে কোদালদিয়া গ্রামের মিজানুর শেখ, সোনাদিয়ার সুনীল বৈরাগী, উত্তরপাড়ার পরিতোষ বিশ্বাস এবং কেশরদিয়ার তোতা খলিফার বাড়িতে।
পুলিশ জানায়, অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার সময় নিহত ৯ বাংলাদেশিকে তিউনিসিয়ার উপকূল থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি উদ্ধার করার পর সেখানে প্রত্যেকের ময়নাতদন্ত করা হয়। দীর্ঘ আড়াই মাস পর তাদের মধ্যে ৮ জনের মরদেহ ঢাকায় পৌঁছানোর পর সেগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। গতকাল কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে বিমানবন্দর থানা পুলিশ। মরদেহ বুঝে পেয়ে স্বজনরা বিকাল ৫টার দিকে যার যার গ্রামের বাড়িতে রওনা হয়।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আল আমিন জানান, বিদেশ থেকে সবার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে দেশে পাঠানো হয়েছে। তারপরও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের একজন চিকিৎসকের উপস্থিতিতে ময়নাতদন্তের কাগজপত্র পরীক্ষা করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
কায়সার খলিফার মরদেহ নিতে ঢাকায় আসা স্বজনরা জানান, বিদেশে পাড়ি জমানোর আগে কায়সার ঢাকায় ফেরি করে আদা, রসুন, পেঁয়াজ বিক্রি করতেন। যে টাকা আয় হতো তাতে গ্রামে স্ত্রী নাজমা বেগম ও দুই মেয়ে জান্নাতুল ও ফাতেমাকে নিয়ে মোটামুটি দিন কেটে যেত। কিন্তু একসময় ইতালি প্রবাসী ছোট ভাই রাসেলের পীড়াপীড়িতে কায়সারও দালালের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী টাকাও দেন। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইতালির পথে রওনা হন। লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে রওনা হলেও শেষপর্যন্ত আর ইতালি পৌঁছতে পারেননি। তার আগেই তিউনিসিয়ার সমুদ্রে মাছ ধরা ট্রলারের ইঞ্জিন রুমে বিষক্রিয়ায় মারা যান তিনি। একই পরিণতি হয় আরও ৮ সঙ্গীর।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে কায়সারের স্ত্রী নাজমা বলেন, স্বামীর মৃত্যুতে দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে জানেন না তিনি। এখন তাদের দেখার আর কেউ রইল না। ছোট মেয়েটা বাবার জন্য পাগল ছিল। গত আড়াই মাস ধরে মেয়েরা তাদের বাবাকে দেখবে বলে আশায় বুক বেঁধে আছে। কিন্তু মেয়েরা জানে না তাদের বাবা আর নেই।
নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, মানব পাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের গজারিয়া গ্রামে রহিম শেখ ও সুন্দরদী গ্রামের বাদশা কাজীর ছেলে মোশারফ কাজী প্রলোভন দেখিয়ে একেকজনের কাছ থেকে ১০-১৫ লাখ টাকা নিয়েছে। বাংলাদেশি ২২ জনকে প্রথমে ট্যুরিস্ট ভিসায় পাঠানো হয় দুবাইতে। সেখান থেকে লিবিয়ায়। একপর্যায়ে লিবিয়ার উপকূলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ২২ জনকে ৮ দিন জেলেও থাকতে হয়। জেলে থাকা অবস্থায় কাউকে ঠিকমতো খাবার ও পানি দেওয়া হয়নি। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। দালালরা তখন দেশে থাকা স্বজনদের কাছে টাকা চেয়ে ফোন করে। এদের মধ্যে অনেকেই তাদের ছাড়াতে দালালদের ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা করে দেন। ৮ দিন জেলে থাকার পর ছাড়া পাওয়ার পর দালালরা তাদের নৌকায় তুলে দেয় ইতালি যাওয়ার জন্য। ২২ জনের কেউই তখন আর যেতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু দালালরা তাদের ট্রলারে উঠতে বাধ্য করে। ওই ট্রলারে বাংলাদেশি ছাড়াও পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের লোকজন ছিল। নির্যাতন করে যে ৯ জনকে ইঞ্জিনরুমে আটকে রাখা হয় তারা সবাই মারা যান।
ভাগ্য বদলাতে গিয়ে মৃত্যুর দেশে
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অবৈধ জেনেও ইতালির উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের এই ২২ জন। যাদের অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। মারা যাওয়া ৯ জনের একজন রাজৈরের সোনাদিয়া গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী। লিবিয়া প্রবাসী গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের সুন্দরদী গ্রামের মোশারফ কাজীর কথায় সজলকে ইতালি পাঠাতে রাজি হন বলে জানান তার বাবা সুনীল বৈরাগী। চুক্তি অনুযায়ী বাড়ি ও জমিজমা বন্ধক রেখে এবং বিভিন্ন জনের কাছে সুদের বিনিময়ে ১২ লাখ টাকা নিয়ে তুলে দেন মোশারফের হাতে। ছেলে লিবিয়ায় আটক হওয়ার পর ছাড়ানোর জন্য দেন আরও আরও সাড়ে তিন লাখ টাকা। গতকাল ছেলের মরদেহ নিতে আসা সুনীল বৈরাগী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ছেলেকে পাঠালাম ইতালি। বাড়িঘর, জমিজমা যা ছিল সব বিক্রি করে টাকা দিলাম। টাকাও গেল, ছেলেও শেষ। এখন কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেব।
গতকাল ঢাকা মেডিকেলে আসা স্বজনরা আরও বলেন, শুরু থেকে বলা হচ্ছে নৌকাডুবিতে সবাই মারা গেছে। কিন্তু আমরা নিশ্চিত হয়েছি, নৌকাডুবিতে কারও মৃত্যু হয়নি। প্রত্যেককেই ইতালি যাওয়ার সময় ট্রলারের ইঞ্জিনরুমে রাখা হয়েছিল। ইঞ্জিনরুমে পানি ঢুকে যায়। তখন ইঞ্জিন থেকে ডিজেল বের হওয়া শুরু হয়। এতে ইঞ্জিন রুমে থাকা ৯ জনের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়। ইঞ্জিনের তাপে প্রত্যেকের শরীর পুড়ে যায়। তিউনিসিয়ার উপকূলে ট্রলার থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করে কোস্ট গার্ড।
স্বরমঙ্গল গ্রামের মামুন শেখের ভাই সজিব শেখ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, তার ভাইসহ ৮ জনকে দালালরা বেধড়ক মারপিট করে নৌকায় তোলে। ২২ জনের মধ্যে ৯ জনকে ইঞ্জিন রুমের মধ্যে রাখা হয়। বাকিদের ওপরে রাখা হয়। ওপরে যারা ছিল তাদের মধ্যে ১১ বাংলাদেশি জীবিত অবস্থায় ফেরত এসেছেন। আর ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে একজনের মরদেহ দালালরা নদীতে ফেলে দিয়েছে।