চিম্বুক-নীলগিরি
সুফল চাকমা, বান্দরবান
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৪ ১৫:৫৯ পিএম
আপডেট : ০৩ মে ২০২৪ ১৬:০৩ পিএম
বান্দরবানে বিশুদ্ধ পানির সংকটের এলাকাগুলোতে রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে খাবার পানি বিতরণ করা হচ্ছে। পানি নিয়ে ফিরছেন এক নারী। বুধবার দুপুরে রুমা উপজেলার কোরাংপাড়ায়। প্রবা ফটো
শুকিয়ে যাচ্ছে ঝরনাগুলো। প্রায় শীর্ণ এমন ঝরনা-ঝিরি থেকে মাত্র এক কলসি পানি সংগ্রহ করতেও কেটে যায় সারা বেলা। অবশ্য ঝিরিতে পানি থাকলেও কষ্ট একেবারে কম হয় না। মাইলের পর মাইল বিপদসংকুল পথ হেঁটে পৌঁছতে হয় ঝিরির কাছে। তবেই না খানিকটা পানি মেলে।
এমন তীব্র পানি সংকটে ভুগছেন চিম্বুক-নীলগিরি এলাকার লোকজন। সচরাচর নারীরাই যান ঝিরি থেকে পানি আনতে। পানি এনে সব সময় তারাই যে পান করেন, তা কিন্তু নয়। বেঁচে থাকার তাগিদে সেই পানি বেচে দেন তারা অপেক্ষাকৃত স্বাবলম্বী এলাকাবাসীর কাছে। প্রতি লিটার ঝরনার পানি তারা বিক্রি করে থাকেন মাত্র দুই টাকায়!
গত বুধবার দুপুরে কোরাং পাড়ায় কথা হচ্ছিল স্থানীয় নারীদের সঙ্গে। রেডক্রিসেন্ট থেকে সেদিন সেখানে বিতরণ করা হচ্ছিল খাওয়ার পানি। জেলা সদর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-নীলগিরি সড়কের পূর্ব পাশেই অবস্থান রুমা উপজেলার গ্যালেঙ্গা ইউনিয়নের কোরাং পাড়ার। সড়কের পশ্চিম পাশে বসবাস করে বান্দরবান সদর ইউনিয়নের কোরাং বাজার পাড়ার বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিসত্তার প্রায় ২১০টি পরিবার।
কোরাং পাড়া থেকে প্রায় এক হাজার ফিট নিচে নামলে দেখা মেলে ছোট ছোট ঝিরি আর ঝরনার। সেই ঝিরির পানি দিয়েই পারিবারিক দৈনন্দিন কাজকর্ম সারতে হয় এলাকাবাসীকে। শুষ্ক মৌসুমে এগুলো শুকিয়ে গেলে মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। তখন ভরসা বলতে ওই ভাঙাচোরা পাতকুয়া। কিন্তু সবাই পানি আনতে গেলে কুলায় না পাতকুয়াতেও। এভাবে এখানে-ওখানে থেকে এক কলসি পানি নিয়ে ফিরে আসতে কেটে যায় কমপক্ষে দেড়ঘণ্টা!
কোরাং পাড়া বাজারের অধিবাসী রেং য়ক ম্রো (৫০) বলেন, প্রচণ্ড গরমে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। তার মধ্যে পানি সংকট, এলাকায় মানুষের বসবাস জীবনযাপন অত্যন্ত কঠিন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে বলে জানান তিনি।
কোরাং পাড়া নিবাসী লিয়াং বম বলেন, শুষ্ক মৌসুমে এলাকার মানুষের খাদ্যের চাইতে পানি সংকটই বেশি হয়। পাড়া থেকে কয়েক হাজার ফুট নিচে নেমে গোসল করে রান্নার ও খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়। এতেই দিন পেরিয়ে যায়। যাদের একটু টাকাপয়সা আছে তারা ঝরনার পানি কিনে পান করছেন বলে জানান তিনি।
কোরাং পাড়া এলাকায় ম্রোসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ২১০ পরিবারের আবাস। এলাকাবাসী চিংহ্লাউ খেয়াং (৪২) বললেন, তিনি ১৫ বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস করছেন। পাড়ার আশপাশের ছোট ছোট ঝিরি-ঝরনাগুলো এখন শুকিয়ে গেছে। গোসল করা তো দূরে থাক, খাবার পানিই ঠিকমতো পান না তারা। এই সংকটে রেডক্রিসেন্ট খাওয়ার পানি বিতরণ করায় এলাকাবাসী খুবই উপকৃত হয়েছে বলে জানান তিনি।
গ্যালেঙ্গা ইউনিয়নের আরেক বাসিন্দা রেং ওয়াই ম্রো বলেন, ‘ঝিরি থেকে এক কলসি পানি পেতেই তাদের এখন ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। স্বাবলম্বীরা মাত্র দুই টাকায় এক লিটার পানি সংগ্রহ করে নিতে পারেন কোনো কষ্ট ছাড়াই। কিন্তু পানি কেনার সামর্থ্য যাদের নেই, তারা ভারী কষ্টে আছে এখন।’
গত বুধবার বিশুদ্ধ পানি বিতরণের অন্যতম উদ্যোক্তা সাংবাদিক বাটিং মারমা বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন সময় পানি সংকট নিয়ে রিপোর্টিং করতে গিয়ে পানি সমস্যার কথা জানতে পারি। তাই মানবিক কারণেই গত দু’বছর ধরে চিম্বুক-নীলগিরি এলাকায় বিশুদ্ধ পানি বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছেন। চলতি বছরও রেডক্রিসেন্ট, জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সার্বিক সহযোগিতায় পানি সংকটে থাকা এলাকায় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।’
রেডক্রিসেন্ট বান্দরবান ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক অমল কান্তি দাশ বলেন, ‘দুর্গম এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে তীব্র খাবার পানি সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর উশৈসিং-এর সার্বিক পরামর্শে ও সাংবাদিকদের সহযোগিতায় বিশুদ্ধ পানির সংকটের এলাকাগুলোতে রেডক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে খাবার পানি বিতরণ করা হচ্ছে।’
বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে বলেন, বান্দরবান জেলায় সুপেয় পানির সংকট নিরসনে বান্দরবান সদর ও লামা পৌরসভায় এডিবির অর্থায়নে দুটি প্রকল্পের কাজ চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আরও দুটি প্রকল্প অনুমোদনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো অনুমোদন পেলে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় সুপেয় পানির সংকট কমে যাবে বলে অভিমত দেন তিনি।