চম্পক কুমার, জয়পুরহাট
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৪ ১৫:৩৯ পিএম
মোস্তাকিম মন্ডল। প্রবা ফটো
বছর দশেক আগে, ২০১৪ সালে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মো. মোস্তাকিম মন্ডল। ‘মৎস্যচাষি’ ছিলেন তখন তিনি। বিত্ত-বৈভবের কথাও খুব একটা শোনা যায়নি। তবে ২০১৯ সালে চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে সম্পদ-সম্পত্তি বেড়ে চলেছে তার। কোটিপতি বনে গেছেন তিনি, স্ত্রীর নামেও কেনা হয়েছে ১১ বিঘা জমি। অথচ ২০১৯ সালের আগে তার স্ত্রীর নামে কোনো জমিই ছিল না। নির্বাচন কমিশনে তার দেওয়া ২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪ সালের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য মিলেছে।
হলফনামার তথ্যমতে, ভাইস চেয়ারম্যান হওয়ার আগে ২০১৪ সালে মৎস্যচাষি মোস্তাকিম মন্ডল কৃষি খাত থেকে বছরে আয় করতেন ৮০ হাজার টাকা; ব্যবসায় থেকে আসত এক লাখ টাকা। নির্ভরশীলদের নামে তখন কোনো আয় ছিল না। অস্থাবর সম্পদ ছিল নগদ দুই লাখ টাকা। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৫ ভরি স্বর্ণও ছিল। যার অর্জনকালীন মূল্য ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ইলেকট্রনিক সামগ্রীর এক লাখ টাকা ও আসবাবপত্রে ২০ হাজার টাকা মূল্য ধরা হয়েছিল। নির্ভরশীলদের মধ্যে মায়ের কাছে ২০ ভরি স্বর্ণ ছিল। তার দাম ধরা হয়েছিল ১০ লাখ টাকা। স্থাবর সম্পদে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া নিজের নামে ৮ বিঘা কৃষিজমি ছিল। যার দাম ধরা হয়েছিল ২০ লাখ টাকা। এক বিঘা বসতভিটাও পেয়েছিলেন পৈতৃক সূত্রে। সেই সঙ্গে ছিল তার লিজ নেওয়া ১০ বিঘা মৎস্য খামার। মায়ের নামে ছিল কৃষিজমি পাঁচ বিঘা। কোনো দায়-দেনা ছিল না। মামলাও ছিল না।
ভাইস চেয়ারম্যান থেকে প্রথমবারের মতো ২০১৯ সালে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হন মোস্তাকিম মন্ডল। সে সময়ও তার মৎস্য চাষের ব্যবসা ছিল। আর কৃষি খাতে বছরে আয় ছিল ৮০ হাজার টাকা। ব্যবসা থেকে বছরে আয় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। নির্ভরশীলদের নামে কোনো আয় ছিল না। অস্থাবর সম্পদে নগদ টাকা ছিল ৮ লাখ টাকা। ২ লাখ ৫ হাজার টাকা মূল্যের একটি মোটরসাইকেল, এক লাখ টাকা মূল্যের ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ও ৫০ হাজার টাকার আসবাবপত্র ছিল। সে সময় তিনি বিবাহে ২০ ভরি স্বর্ণ পান। তবে স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের নামে কোনো কিছু ছিল না। স্থাবর সম্পদে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া নিজ নামে কৃষিজমির পরিমাণ সঠিকই হয়েছিল, তবে দাম ১৮ লাখ টাকা কমে ধরা হয়েছিল দুই লাখ টাকা। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ২৩ শতক জমির ওপর পাকা বাড়ি ছিল তার। তবে স্ত্রী, নির্ভরশীল ও যৌথ মালিকানার ক্ষেত্রে কিছুই ছিল না। সে সময়ও তিনি ঋণ ও মামলামুক্ত ছিলেন।
২০১৯ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর সম্পদ বেড়ে যায় মোস্তাকিমের। নগদ টাকা, মোটরসাইকেল, কৃষি ও অকৃষি জমি, দালাল এবং স্ত্রীর নামে জমিও দেখানো হয়েছে তার ২০২৪ সালের হলফনামায়। এতেও তিনি মৎস্য চাষ ব্যবসার কথা উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া উল্লেখ করেছেন কৃষি খাত থেকে বছরে আয় দেড় লাখ টাকা, বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট বা দোকান বা অন্যান্য ভাড়া থেকে ২ লাখ টাকা এবং ব্যবসা থেকে বছরে ৩ লাখ টাকা আয় করার কথা। তবে নির্ভরশীলদের নামে এতেও কোনো আয়ের উল্লেখ করা হয়নি। অস্থাবর সম্পদে নগদ টাকা ১২ লাখ, ৫ লাখ টাকা মূল্যের তিনটি মোটরসাইকেল, ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও ৩ লাখ টাকার আসবাবপত্র দেখানো হয়েছে। স্ত্রীর নামে শুধু স্বর্ণ দেখানো হয়েছে। ২০১৯ সালের হলফনামায় বিবাহে ২০ ভরি স্বর্ণ পাওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও এবার স্ত্রীর নামে ২৪ ভরি স্বর্ণ দেখানো হয়েছে।
স্থাবর সম্পদে ২০১৯ সালের হলফনামার চেয়ে ২০২৪ সালে মোস্তাকিম মন্ডলের জমি বেড়েছে ২ দশমিক ৫০ বিঘা। মোট ১০ দশমিক ৫০ বিঘা জমির মূল্য ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬৬ টাকা। এবার ১০ লাখ টাকা মূল্যের অকৃষি ৫০ শতক জমি এবং ৯৫ লাখ টাকা মূল্যের ৮ দশমিক ৫০ শতক দালান জমি দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এই জমি মায়ের কাছ থেকে দান পেয়েছেন। তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, এই জমি তিনি কৌশলে মায়ের নামে কিনে পরে নিজের নামে দান করিয়ে নিয়েছেন। তার নামে রয়েছে দুটি মৎস্য খামার। স্ত্রীর নামেও রয়েছে ১১ বিঘা জমিÑ যা তার আগের কোনো হলফনামাতে উল্লেখ করা হয়নি। এবারও তার নামে কোনো মামলা নেই। তবে ৩৫ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। তিনি চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করার সময় যে ভাতা পেয়েছেন, সেটির কোনো উল্লেখ নেই তার হলফনামায়।
এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে মোস্তাকিম মন্ডল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার স্ত্রীর নামে যে সম্পদ দেখানো হয়েছে, তা স্ত্রীর বাবার দেওয়া। কিন্তু সেটি হলফনামায় উল্লেখ করা হয়নি। চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ভাতা পেয়েছি। তবে অনেকেই বলেছে উল্লেখ করতে হবে না। তাই সেটিও উল্লেখ করা হয়নি। আর চেয়ারম্যান মার্কেট (৯৫ লাখ টাকার সম্পদ) মা কেনার পর আমাকে দান করেছেন।’ সুকৌশলে মায়ের নামে কেনার পর নিজের নামে দান হিসেবে সেটি নিয়েছেন কি না,Ñ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অনেকেই তো অনেক কথা বলবে। তবে আমার টাকায় নয়, ওটা মায়ের টাকায়ই কেনা হয়েছে।’
স্নাতক পাস করা মো. মোস্তাকিম মন্ডল ক্ষেতলাল উপজেলার বাখেড়া কোমলগাড়ী গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষেতলাল উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরে ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত দলীয় প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে নির্বাচিত হন। এবার ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি আবারও উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়েছেন। মোস্তাকিম মন্ডল ক্ষেতলাল উপজেলা শাখা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।