আবু রায়হান তানিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪ ১৫:১৫ পিএম
ফাইল ফটো
টানা তিনবারের নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান বিএর মৃত্যুতে গত বছরের মে মাসে সন্দ্বীপের উপজেলা চেয়ারম্যান পদে উপ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচন ঘিরে সন্দ্বীপের আওয়ামী লীগের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার ‘নিয়ন্ত্রিত’ উপজেলা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নাগরিক কমিটির ব্যানারে বেশ আটঘাট বেঁধে সেবার মাঠে নামেন ৭৫ পরবর্তী সময়ে আন্দোলন সংগ্রামে সম্মুখসারিতে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। সেই নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাইন উদ্দিন মিশন। মাহফুজুর রহমান মিতার বলয়ের প্রধান সিপাহসালার ছিলেন তিনি।
অন্যদিকে নাগরিক কমিটির প্রার্থী হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মুজিব বাহিনীর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম। নির্বাচনে এমপির হস্তক্ষেপে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে মিশনকে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন নাগরিক কমিটির নেতারা।
সেই বিরোধের জের পড়ে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। সেখানে দুই পক্ষ মুখোমুখি সংঘর্ষেও জড়ায় একাধিকবার। এর ফলে একাধিক পাল্টাপাল্টি মামলা ও নির্বাচনের পর নাগরিক কমিটির নেতাকর্মীদের অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে সন্দ্বীপ ছাড়া করার অভিযোগ করেন নাগরিক কমিটির নেতারা। তবে বছর ঘুরতেই উপজেলা পরিষদের নির্বাচন ঘিরে বদলে গেছে সন্দ্বীপে আওয়ামী রাজনীতির দৃশ্যপট। এক বছর আগে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া মাইন উদ্দিন মিশন হঠাৎ করেই যেন একঘরে হয়ে গেছেন। স্থানীয় রাজনীতির গুঞ্জন, এমপির আনুকূল্য হারিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি এক বছর আগে যে নাগরিক কমিটির বাধার মুখে পড়েছিলেন তিনি তাদের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাধতে হবে তাকে। এরই মধ্যে নাগরিক কমিটির নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রাজিবুল আহসান সুমন, জেলা যুবলীগের সহসভাপতি মিজানুর রহমানসহ কয়েকজনের সঙ্গে মিশনের একটি বৈঠকের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করছেন এমপির অনুসারীরা।
প্রথম ধাপে হতে যাওয়া চট্টগ্রামের এই উপজেলার নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্থানীয়রা এগিয়ে রাখছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম আনোয়ার হোসেনকে। সরেজমিনে ঘুরে সেই এগিয়ে রাখার কারণগুলোও দেখা যায়। উপজেলার সব এলাকায় আনোয়ার হোসেনের পোস্টার-ব্যানারের ছড়াছড়ি। আরও চার প্রার্থী থাকলেও তাদের ব্যানার-পোস্টার সেভাবে চোখে পড়ে না। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের প্রায় সবাইকে এস এম আনোয়ার হোসেনের পক্ষে মাঠে নামতে দেখা গেছে। গত রবিবার বিকালে সন্দ্বীপ উপজেলা কমপ্লেক্সে প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ের উদ্বোধন করেন তিনি। সেখানে কয়েকশ নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। অন্য দিকে বাকি চার প্রার্থীর কেউ এখন পর্যন্ত কার্যালয় উদ্বোধন করেননি। প্রচার-প্রচারণায়ও দেখা গেল মোটামুটি দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীকে। একজন মাইন উদ্দিন মিশন, অন্যজন এস এম আনোয়ার হোসেন। মাইন উদ্দিন মিশন একলা প্রচারণায় বের হলেও এস এম আনোয়ার হোসেনের প্রচারণায় দলীয় নেতাকর্মীরা থাকছেন। বাকি তিনজন প্রার্থী হলেনÑ সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ফোরকান উদ্দিন আহমেদ, নাজিম উদ্দিন জামসেদ ও শেখ জুয়েল।
বিভিন্ন এলাকার ভোটার ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর হঠাৎ করে প্রেক্ষাপট বদলে যায়। গুঞ্জন ওঠে মাইন উদ্দিন মিশনকে মনোনয়ন জমা দিতে মানা করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা। সেই গুঞ্জন বিশ্বাসে পরিণত হয় মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিনে। ওইদিন শেষ মুহূর্তে মনোনয়ন জমা দেন মিশন। এর মধ্যে এস এম আনোয়ার হোসেনের কিছু ভোট ব্যাংক আছে। বিভিন্ন দুর্যোগে ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে সহযোগিতা করে আলাদা পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। এর সঙ্গে এমপির সমর্থন তাকে অনেকটা শক্তিশালী করে তুলেছে। আনোয়ার হোসেনের এই হঠাৎ উত্থান মানতে পারছেন না স্থানীয় রাজনীতিতে আনোয়ার হোসেনের সহকর্মী থাকা অনেক নেতা। প্রকাশ্যে বিরোধ না করলেও সুযোগ পেলে পাশার দান উল্টে দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন তারা। এমপির আনুকূল্য হারিয়ে একলা হয়ে যাওয়া মাইন উদ্দিন মিশনের জন্য নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার বেশ কঠিন হবে বলেই মনে করেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
উপজেলা আওয়ামী লীগের পদধারী একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা দুইজনই দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। এর মধ্যে মিশন হঠাৎ একা হয়ে গেলেন। এটা নিয়ে অনেকে বিব্রত। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। পুরো রাজনীতি এমপি মহোদয়ের নিয়ন্ত্রণে। উনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস কেউ করবে না। আনোয়ার হোসেনেরও জনপ্রিয়তা আছে। এ কারণে নেতাকর্মীরা কেউ ঝুঁকি নিবেন বলে মনে হয় না।’
যদিও এই নির্বাচনের বিষয়ে প্রকাশ্যে একটি শব্দও ব্যয় করেননি সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা। তবে ঘনিষ্ঠদের এরই মধ্যে আনোয়ার হোসেনের পক্ষে মাঠে নামার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। আবার দলীয় নেতাকর্মীদের যারা আনোয়ার হোসেনকে সমর্থন দিতে চাইছেন না তারা এমপির এই নীরবতাকে হাতিয়ার করতে চাইছেন। সেই প্রেক্ষিতে গত সোমবার সন্তোষপুর ইউনিয়নে এক পথসভায় আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অনেকে বলেন, এখনো কোনো সিগন্যাল পাইনি। আবহাওয়াতো ভালো, সিগন্যালের কী দরকার। যাকে যাকে বলার এমপি মহোদয়তো বলে দিয়েছেন।’
নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদের কথা জানিয়ে এস এম আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিন সন্দ্বীপের মানুষের বিপদে-আপদে, সুখ-দুঃখে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। নেতাকর্মীদের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো। যেখানে যাচ্ছি ভালো সাড়া পাচ্ছি। নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী ‘
অন্যদিকে মাইন উদ্দিন মিশন বলছেন, শেষপর্যন্ত লড়ে যাওয়ার কথা। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি থেকে ধাপে ধাপে উঠে এসেছি। দলের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পাওয়ার পর উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এই যাত্রায় কখনও কারও সঙ্গে বেইমানি করিনি। আশা করি, আমার সঙ্গেও কেউ বেইমানি করবে না। পরিস্থিতি যাই হোক আমি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে থাকব।’
সংসদ সদস্যের সঙ্গে হঠাৎ বিরোধ কী নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কিছু জানা নেই। বিরোধ আছে কি না সেটাইতো জানি না।’ একা নির্বাচনী প্রচারণা করার প্রসঙ্গে বলেন, ‘গরমের কারণে নেতাকর্মীদের কষ্ট দিতে চাই না। নেতাকর্মী নিয়ে প্রচারণায় যাওয়ার কী আছে। যে এলাকায় প্রচারণা করব সেখানকার ভোটারদের পেলেই হয়। সেটা তো পাচ্ছি।’
প্রচারণায় এস এম আনোয়ার হোসেন এগিয়ে থাকলেও হঠাৎ বদলে যাওয়া এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে এখনও হজম করতে পারছেন না সন্দ্বীপের সাধারণ ভোটাররা। আগের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তারা শেষ মুহূর্তে এমপি মাইন উদ্দিন মিশনের পক্ষে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিতে পারেন। যদিও দলটির সক্রিয় নেতাকর্মীরা সেই সম্ভাবনা দেখছেন না। তবে তারা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছেন ভিন্নভাবে। তাদের হিসেবে এই নির্বাচনে সন্দ্বীপের সার্বিক রাজনীতিতে এমপির একক নিয়ন্ত্রণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার মঞ্চ বলেই মনে করছেন তারা। উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘এমপি যদিও অনেককেই এর মধ্যে বলে দিয়েছেন, বাকিদেরও আকারে ইঙ্গিতে বলেছেন। তবু স্পষ্ট নির্দেশনা না পাওয়াও অনেক নেতাকর্মী মাঠে নামছে না। আবার উনি চুপচাপ থাকলেও বিরোধী পক্ষ মাঠে নামার সাহস পাচ্ছে না। শুধু উনার ইচ্ছায় রাতারাতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একলা হয়ে গেলেন। যদিও বাধা নেই তবু কেউ সাধারণ সম্পাদকের আশপাশে যাওয়ার সাহস পর্যন্ত পাচ্ছে না। সব মিলিয়ে দল ও দ্বীপের রাজনীতিতে এমপি মহোদয় কতটা একক কর্তৃত্ব স্থাপন করেছেন নীরবভাবে তার ঘোষণা দিয়ে দিলেন তিনি।’
সন্দ্বীপ উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ওমর ফারুক। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করছেন উপজেলা যুব মহিলা লীগের দুই নেত্রী হালিমা বেগম শান্তা ও নাহিদ তানমি।