মধুখালী (ফরিদপুর) প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:০৮ এএম
আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১১:২১ এএম
নিহত ২ ভাইয়ের বাবা অভিযোগ করেছেন, চাঁদা না দেওয়ায় তপন তার দুই ছেলেকে হত্যা করেছেন। ছবি: সংগৃহীত
ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় পঞ্চপল্লীতে আলোচিত দুই ভাই হত্যার হোতা চেয়ারম্যান শাহ্ আসাদুজ্জামান তপনকে দায়ী করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। নিহত দুই ভাইয়ের বাবা অভিযোগ করেছেন, চাঁদা না দেওয়ায় তপন তার দুই ছেলেকে হত্যা করেছেন।
তপন উপেজলা ডুমাইন ইউনিয়নের পূর্বপাড়া গ্রামের মৃত শাহ্ মোশাররফ হোসেনের ছেলে। স্বজনরা জানান, তপন এইচএসসি পাস করে রাজনীতিতে যোগ দেন। ছাত্রলীগ, যুবলীগ করার পর তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ লাভ করলেও পরে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বহিষ্কার হন। ৫৫ বছর বয়সি তপন ২০২২ সালের ২৭ জুলাই ডুমাইন ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। আনারস প্রতীকে ৩৮৫১ ভোট পেয়ে নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করেন তিনি। জনপ্রিয়তা থাকলেও তার ভিতরে রয়েছে দুর্নীতি প্রবণতা। সালিশ-দরবার করেও টাকা আদায়ের অভিযোগ মিলেছে তপনের বিরুদ্ধে।
নিহত দুই শ্রমিকের বাবা শাহজাহান খান অভিযোগ তুলেছেন, চাঁদা না দেওয়ায় হত্যা করা হয় তার দুই সন্তানকে। পঞ্চপল্লীতে শ্রমিকদের খুন, জখম ও মারধরের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন চেয়ারম্যান তপন। তিনি বলেন, ‘ঘটনার কয়েক দিন আগে আমার ছেলে মোবাইল ফোনে জানিয়েছিল, সেখানে ঝামেলা হয়েছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য অজিত বিশ্বাস চাঁদা চেয়েছিলেন। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হয়। এর পরই ঘটে হামলার ঘটনা।’
দুই ভাই হত্যায় চেয়ারম্যানের সঙ্গে এই ইউপি সদস্যের নামও এসেছে। তাকেও খুঁজছে পুলিশ।
ইউপি চেয়ারম্যান পদ ও উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে বরখাস্ত
২০২৩ সালের ৪ মে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর কার্যক্রমে বাধা প্রদান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা ও সরকারি গাড়ি ভাঙচুরে ইন্ধন দেওয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ও তৎকালীন ইউএনওকে মারধরের ঘটনায় চেয়ারম্যান তপন বরখাস্ত হন। পরে উচ্চ আদালতের আদেশে ফিরে পান পদ। এর আগেও টিসিবির কার্ড দুর্নীতির কারণে বরখাস্ত হয়েছিলেন। সেবারও উচ্চ আদালতে আপিল করে তিনি পদ ফিরে পান। সে সময় উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে।
এলাকায় অত্যাচার-নির্যাতন, চাঁদাবাজির অভিযোগ
দখল ও চাঁদাবাজিতে আগে থেকেই উঠে এসেছিল চেয়ারম্যান তপনের নাম। এলাকায় নিজস্ব বাহিনী দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের নিয়ন্ত্রণ। ডুমাইন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ডুমাইন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তারিকুল ইসলাম মাসুম বলেন, তপন নির্বাচনে জয়লাভ করলেও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। অবৈধ বিকাশ প্রতারক চক্রকে সহযোগিতা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, নিজস্ব দখলদার বাহিনী তৈরিসহ নানা ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডুমাইন ইউনিয়নের ভেল্লাকান্দী গ্রামের একজন বাসিন্দা বলেন, কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললে তাকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করেন তপন। এলাকায় টোপ, মাদক, বালুমহল দখল থেকে শুরু করে সকল অন্যায় কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িত। সরকারি যত অনুদান তা তিনি নিজের বাহিনীদের মাধ্যমে বিতরণ করেন।
মধুখালী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য খুরশীদ আলম বলেন, ‘তপনের পিছনে অনেকেই কাজ করছে।’ সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানান তিনি।
ডুমাইন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক টোকন বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নিয়ে ঝামেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের গাড়ি ভাঙচুর হয়, সে সময় থেকে তপন জড়িত থাকায় আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত। সম্প্রীতি ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে তিনি নিজের ইমেজ নষ্ট করেছেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হক বকু জানান, আওয়ামী লীগ পরিচ্ছন্ন দল। এ দলের নেতাকর্মীরা হবে জনগণের নিবেদিত প্রাণ। জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজকে আওয়ামী লীগ মেনে নেবে না। তপনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাকে সতর্ক করেছিলাম। তারপরও তিনি রাষ্ট্রবিরোধী কাজে যুক্ত থাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
গত ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী গ্রামের একটি কালী মন্দিরে আগুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর হামলা হয়। সেখানে পিটুনিতে উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের ঘোপেরঘাট গ্রামের ২১ বছর বয়সি আশরাফুল ও তার ভাই ১৫ বছর বয়সি আশাদুল নামের দুই শ্রমিকের প্রাণ যায়। শ্রমিকদের পিটিয়ে হত্যার একটি ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে।
হত্যায় চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপন ও ১ নং ওয়ার্ড মেম্বার অজিত কুমার সরকারের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। গত ২১ এপ্রিল ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ১৫ ও ৪৩ সেকেন্ডের দুটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক ব্যক্তিকে স্কুলের কক্ষে মেঝেতে ফেলে পেটানো হচ্ছে। চেয়ারম্যান তপন ও ইউপি সদস্য অজিত কুমার বিশ্বাসকে তাতে উস্কানি দিতে দেখা যায়। তাদের ধরিয়ে দিতে পারলে বা কোনো প্রকার তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলে আর্থিক পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।