× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সেচ থেকে প্রকল্প ব্যয় সবখানেই দুর্নীতি

রাজু আহমেদ, রাজশাহী

প্রকাশ : ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৪৬ পিএম

আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৫৮ পিএম

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প (বিএমডিএ) -এর লোগো।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প (বিএমডিএ) -এর লোগো।

নানা অনিয়মের কারণে প্রতি বছর অডিট আপত্তি জমলেও তা নিষ্পত্তির দিকে দৃষ্টি নেই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ)। কৃষি ও কৃষকবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএমডিএকে কার্যকর ও অর্থবহ করে তোলার উদ্যোগও নেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। সরকারের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটিতে বারবার প্রকল্পের নামে শত শত কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতি-অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কর্তৃপক্ষকে। 

এ অবস্থার মধ্যেই চলতি বছর আবারও প্রতিষ্ঠানটির একাধিক প্রকল্পের শতকোটি টাকার দুর্নীতি-অনিয়মের তদন্তে নেমেছে কৃষি ও পরিবেশ অডিট কার্যালয়ের আট সদস্যের দুই টিম। কৃষকদের সেচের পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও ক্রমেই বাড়ছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। পানি নিয়ে বৈষম্য ও অরাজকতার কারণে কৃষকদের আত্মহত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এমন সব অভিযোগের মুখে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, ‘নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলোতে নানা অসঙ্গতি থাকে। এখানেও রয়েছে।’

চার অর্থবছরে ৩৫০ কোটি টাকার অডিট আপত্তি

প্রসঙ্গত, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০, ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ এই চার অর্থবছরে সরকারি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বিএমডির বিরুদ্ধে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা অডিট আপত্তির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। এক্ষেত্রে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন প্রকল্পে ৩৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা ও পরবর্তী দুই অর্থবছরে বিভিন্ন প্রকল্পে মোট ১৮৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯৮ কোটি ৭১ লাখ টাকার অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম ত্রুটি হলো আইনের বাধ্যবাধকতা থাকার পরও বিএমডিএর প্রধান কার্যালয় কর্তৃপক্ষ বার্ষিক অডিট (আয়-ব্যয়ের হিসাব) প্রতিবেদন প্রস্তুত করে না। যে কারণে প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যয়ের প্রকৃত চিত্রও মানুষের সামনে আসে না। এভাবে প্রকল্পগুলো থেকে নানা কায়দায় অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে। এসব নিরীক্ষা প্রতিবেদনে তিন শতাধিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

১৩ প্রকল্পে নতুন তদন্ত 

চলতি বছর শতাধিক কোটি টাকার ১৩টি প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে নতুন করে তদন্তে নেমেছে কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তরের ৮ সদস্যের দুটি টিম। যার একটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন উপপরিচালক মো. নেয়ামত উল্লাহ এবং অপরটির প্রধান অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার মো. বশির উদ্দিন। টিম দুটি প্রকল্পগুলোর তিন মাসের (ফেব্রুয়ারিÑএপ্রিল) বিভিন্ন বিষয়ে যাচাই করে দেখবে। তবে এই তদন্তের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সংশ্লিষ্টরা। 

তদন্ত টিমের এক সদস্য জানান, তদন্ত শেষে আর্থিক অনিয়মের প্রতিবেদন বিএমডিএকে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে এর কপি বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) বরাবর পাঠানো হবে। সেখানে যাচাই-বাছাই শেষে প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে।

বিএমডিএতে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এসব নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বাইরেও অনেক প্রতিবেদন ও অভিযোগ রয়েছে। যেসব বিষয়ে তদন্ত হলেও অনিয়ম ও অভিযোগের কোনো সুরাহা হয়নি। দায়ীদের বিরুদ্ধেও নেওয়া হয়নি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তা নিয়ম অমান্য করে একাধিক ইনক্রিমেন্ট ও গ্রাচুইটি নিয়েছেন। তাদের অনেকে অবসরেও গেছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈষম্য ও অনিয়মের অভিযোগ।

সূত্রমতে, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের কার্যালয় থেকে দেওয়া প্রজ্ঞাপন অনুসারে নিরীক্ষা আপত্তির ক্ষেত্রে দায়ী থাকবেন অর্থ ব্যয়কারী কর্মকর্তাসহ প্রকল্প পরিচালক। অবশ্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের আরেকটি প্রজ্ঞাপনে অডিট আপত্তিগুলোর জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে। তবে বছর পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি বিএমডিএকে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকর্তা, বিশেষ করে নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশিদের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। উল্লেখ্য, তিনি একাধারে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক এবং প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন দীর্ঘদিন।

হিসাব সংরক্ষণ ও বার্ষিক বিবরণী প্রস্তুত করা হয় না

পরপর চার অর্থবছরের (২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২) বিভিন্ন নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতি ক্ষেত্রেই অভিযোগগুলো প্রায় একই। প্রায় একই কায়দায় বিভিন্ন প্রকল্প থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। 

যেমন বিএমডিএতে প্রতি বছর শতকোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও প্রতিষ্ঠানটির হিসাব সংরক্ষণ না করায় এবং সে অনুযায়ী আয়-ব্যয়ের বার্ষিক হিসাব বিবরণী প্রস্তুত না করায় এর আয়-ব্যয়ের প্রকৃত চিত্র মেলে না। বিএমডিএ আইন ২০১৮-এর ধারা ১৯ (১) অনুযায়ী সরকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষের হিসাবরক্ষণ এবং বাষিক বিবরণী প্রস্তুত করার এবং ওই আইনের ১৯-এর উপধারা ৪ অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের হিসাব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট দিয়ে নিরীক্ষার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ কিন্তু প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাবরক্ষণ এবং বার্ষিক নিরীক্ষা প্রস্তুত করা হয় না, যা থেকে কি না প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হতে পারে। এমনকি সরকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে হিসাবরক্ষণ এবং বার্ষিক বিবরণী তৈরির লক্ষ্যে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন ২০১৫-এর অধীনে গঠিত ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের কাছ থেকে কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়নি। 

এছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিপিআর ২০০৮ অনুসরণ না করে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে প্রকল্পের মালামাল কেনা হয়েছে। মালামাল কেনা হয়েছে দরপত্র ছাড়াই কিংবা নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে। পাশাপাশি ঠিকাদারকে বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে অনিয়ম, বিলে নির্ধারিত হারে কর না কাটা, অতিরিক্ত গাড়ি ব্যবহার করে জ্বালানি ও মেরামতের মাধ্যমে অর্থ ব্যয় করা, প্রকল্পের টাকা সরকারি ব্যংকে না রেখে অন্য কোথাও রাখা এবং গচ্ছিত অর্থের সুদের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না করা, গভীর নলকূপসমূহের ঘণ্টাপ্রতি ইউনিট কনজাম্পশন নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি হওয়ায় অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। তদন্তে দেখা গেছে, প্রকল্পের মালামাল ক্রয়ে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে এক প্রকল্পকে কয়েক ভাগে ভাগ করা, ভ্রমণ ভাতার নামে কর্মকর্তাদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন এড়াতে কোটেশনের মাধ্যমে মালামাল কেনার মতো অনিয়মও ঘটেছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে বিএমডিএর হিসাব শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কখনও বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব করেনি। তবে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আপত্তির পর তারা পূর্বের সকল হিসাব-নিকাশ বা পূর্বের জেরের সমাধান না করেই তড়িঘড়ি করে ২০২০ থেকে ২২ অর্থবছরের হিসাব প্রস্তুত করেছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সুপারিশ 

এসব বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সুপারিশও করেছে। প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছেন, বিএমডিএ এই সব অনিয়ম প্রসঙ্গে যেসব বক্তব্য জানিয়েছে, তা প্রতিষ্ঠানটিতে চলা অনিয়মের স্বীকৃতিস্বরূপ। একই সাথে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে হিসাব সংরক্ষণ এবং বার্ষিক বিবরণী প্রস্তুতের জন্য ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল কর্তৃক জারি করা পদ্ধতিতে আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুতের লক্ষ্যে হিসাব বিবরণী সংরক্ষণ বিধি ও স্ট্যান্ডার্ডস ও গাইডলাইন অনুসরণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। 

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

এসব প্রসঙ্গে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নির্বাহী পরিচালক ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) আব্দুল রশিদ বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে ৪ হাজারের মতো অডিট আপত্তি ছিল। যার মধ্যে এখন মাত্র ১০০টির কিছু বেশি জমা পড়ে আছে। আপত্তি হলেই যে দায়ী তা বলা যাবে না। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ওরা আপত্তি জানায়। পরে আবার ওদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়। ওরা প্রাথমিকভাবে আপত্তি জানায়, আমরা হয়তো প্রাথমিকভাবে সার্কুলারের কাগজপত্র দিতে পারি না। কিন্তু পরে তা দেওয়ার পর আর আপত্তির সুযোগ থাকে না।’ তিনি জানান, ‘বিএমডিএতে আগে বার্ষিক অডিট করা না হলেও এখন অডিট ফার্ম দিয়ে অডিট রিপোর্ট করা হচ্ছে।’ 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা