ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার
প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:০৬ পিএম
শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়নের মাজদিহী চা-বাগানে প্রতি বছরের মতো এবারও অনুষ্ঠিত হয় চড়ক পূজা। শুক্রবার তোলা। প্রবা ফটো
চড়ক পূজা বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতি বাংলা বছরের শেষ দিবসে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিন থেকে শুরু করে বৈশাখ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
মৌলভীবাজার জেলার প্রতিটি উপজেলায় শত বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী এ পূজাটি। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয় প্রতি ১৩ বৈশাখ শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়নের মাজদিহী চা-বাগানে। গতকাল শুক্রবার অনুষ্ঠিত মাজদিহী চা-বাগানের চড়ক পূজা দেখতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু জড়ো হন। বিকাল ৪টার দিকে মূল পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতে থাকে মাজদিহী চা-বাগানের খেলার মাঠে।
চড়ক পূজার আরও একটি নাম রয়েছে। এটি হলো নীল পূজা। গাম্ভীরা পূজা বা শিবের গাজন চড়ক পূজারই রকমফের। চড়ক পূজার আগের দিন চড়কগাছটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়। যা পূজারিদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত।
চড়ক পূজায় বিভিন্ন দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় ভক্ত বা সন্ন্যাসীদের। লোহার তৈরি বড়শি শরীরে গেঁথে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয় চকড়গাছের চারপাশে। ভক্ত বা সন্ন্যাসীর পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায়, চোখের কোণে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রতি বছর ঐতিহ্যবাহী এ চড়ক উৎসবের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে থেকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য পূজারির মধ্যে প্রায় ৫০ জন পূজারি সন্ন্যাস হয়ে এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ‘শিব-গৌরী’ ভূমিকায় নৃত্যগীত করে ভিক্ষাবৃত্তি করে থাকেন। এ সময় তারা সারা দিন উপবাস থেকে এবং রাতে নিরামিষ খেয়ে পবিত্রতার সঙ্গে এ সন্ন্যাস ব্রত পালন করেন। চড়ক পূজার দুই দিন আগে তারা স্থানীয় শ্মশানে গিয়ে পূজা করেন। এ সময় গৌরীর বিয়ে, গৌরীনৃত্য ও বিভিন্ন সংগীত ও ঢাকঢোলের বাজনায় গোটা এলাকা সরগরম করে তোলেন। নির্দিষ্ট দিনে মাজদিহী খেলার মাঠে ‘হাজরা নৃত্য’ করার জন্য কলাগাছ ও বাঁশের খুঁটি দিয়ে মণ্ডপের ন্যায় তৈরি করে। এদিন চড়ক ঘোরানোর আগে স্থানীয় কিছু পূজারি কালী সেজে নৃত্য করেন। এরপর বিশাল দা (বলিচ্ছেদ) দিয়ে সম্মিলিত নৃত্য, শিব ও কালীর নৃত্য পরিবেশিত হয়। এর পরপরই ভক্তরা স্থানীয় এক বাড়ির পুকুরে স্নান করেন। স্নান শেষে ভক্তদের লোহা দিয়ে তৈরি বড়শি বা শিক শরীরের বিভিন্ন অংশে গেঁথে দেওয়া হয়। পিঠে লোহার দুটি করে বিরাট আকৃতির বড়শি গেঁথে রশিতে বেঁধে ঝুলিয়ে চড়কগাছ ঘোরানো হয় চার ভক্তকে। সন্ধ্যায় মূল পূজার আনুষ্ঠিকতা সম্পন্ন হয়।
প্রতিবারের মতো এবারও চড়ক পূজা উপলক্ষে বসেছে মেলা। মেলায় শিশুদের খেলনা, হস্তশিল্পজাত পণ্য, খই, উখরা, খাবার হোটেল ইত্যাদি স্থান পায়। এ ছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ ও পণ্যের স্টল ছিল।