আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১২:১৩ পিএম
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১২:১৪ পিএম
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের বড় ছড়ার পাথরের ওপর বসা স্বচ্ছ ডানা বন মহিমা। ছবি : লেখক
এক দশক আগের ঘটনা। অতি বিরল ও সংকটাপন্ন এক পাখির সন্ধানে রাঙামাটির কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে এসেছি। পাখির সন্ধান অভিযানের প্রথম দিন উদ্যানের বিভিন্ন স্পট ঘুরে ব্যাঙছড়ির মারমাপাড়ায় এলাম। উষা মং মারমার টং দোকানে বিকালের নাশতা ও চা পান শেষে যখন কাপ্তাই শহরের উদ্দেশে রওনা হলাম তখন সূর্য অস্ত যায়যায়। হাঁটতে হাঁটতে যখন ব্যাঙছড়ির সেগুনবাগানের সামনে চলে এসেছি, ঠিক তখনই বড় একটি পাখি ডানপাশের ঘন জঙ্গলের একটি বড় গাছের কাণ্ডে বসল। পাখিটির ডাক, ওড়া ও গাছে বসার ভঙ্গি দেখে চিনতে তেমন একটা অসুবিধা হলো না।
দ্বিতীয় দিন উদ্যানের পিকনিক স্পটের উল্টোপাশের বিজিবি ক্যাম্প থেকে ছড়ায় নামার আগ মুহূর্তে হঠাৎ গতকালের সেই পুরোনো ডাকটি কানে বাজল। এদিক ওদিক তাকিয়ে নাকবরাবর একটা গাছের কাণ্ডে ব্যস্ত অবস্থায় বড় একটি ধূসর-কালো পাখি আবিষ্কার করলাম। আমি বিজিবির টিলার ওপর, পাখিটি আমার সামনের উঁচু জায়গার একটি গাছের কাণ্ডে। আমার এখান থেকে স্পষ্ট দেখা গেলেও দূরত্ব বেশি হওয়ায় ছবি ভালো হবে না। কাজেই বিজিবির টিলা থেকে নেমে পাশের উঁচু জায়গাটায় যেতেই হবে। অতএব দ্রুত টিলা থেকে নেমে সাবধানে সামনে এগিয়ে গিয়ে পজিশন নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাগ্য ভালো বলতে হবে, আরও দুটি একই পাখি এসে সঙ্গে যোগ দিল। দিনের শুরুতেই আরাধ্য পাখিটির ছবি তুলতে পেরে মনটা আনন্দে ভরে উঠল।
বিরল পাখিটির ছবি তোলা শেষে উদ্যানের বড় ছড়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। পায়ের পাতা ভেজা সর্পিল ছড়ার কাকচক্ষু জলে দেহ-মন জুড়িয়ে গেল। মার্চের ৮ তারিখ। শীত পেরিয়ে বসন্তকাল চলছে।
পাহাড়ি এলাকায় রাত ও ভোরে শীত থাকলেও এই রোদেলা সকালে বেশ গরমই লাগছে। গায়ের ফুলহাতা শার্টটি খুলে কোমরে জড়িয়ে নিলাম। গায়ে এখন হাফহাতা টি-শার্ট। ছড়ার শীতল পানিতে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে শরীরটা জুড়িয়ে নিলাম।
ছড়ার এই অংশ কিছুটা খোলামেলা। এখানে তেমন একটা পাখি দেখলাম না। হাঁটা শুরু করব, এমন সময় হঠাৎই সামনের ছোট্ট পাথরটির দিকে দৃষ্টি গেল। স্বচ্ছ ডানার পাতা রঙের সরুদেহী একটি পতঙ্গ বসে আছে। এমন সুন্দর পতঙ্গ জীবনে খুব কম দেখেছি। ধীরে ধীরে ওর কাছাকাছি এগিয়ে গেলাম। নিরাপদ দূরত্বে এসে দ্রুত এক ক্লিকে চারটা ছবি তুলতেই পতঙ্গটি উড়ে পালাল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও ওর দেখা পেলাম না। ফিরতি পথে আবারও খোঁজ করলাম। কিন্তু ওর টিকিটিরও দেখা পেলাম না। অবশ্য পরবর্তীতে ওকে দেখেছি বহুবার, বহু জায়গায়। কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান বাদে বেশি দেখেছি মৌলভীবাজারের আদমপুর ও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এবং হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে।
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে দেখা সেদিনের সেই অনিন্দ্য সুন্দর পতঙ্গটি আর কেউ নয়, এদেশের দুর্লভ ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন এক ফড়িং প্রজাতি। এটি একটি সুরুদেহী ফড়িং (Damselfly)। ইংরেজি নাম Clear-winged Forest Glory। ওর কোনো বাংলা নাম নেই। ইংরেজি নামের অনুবাদে স্বচ্ছ ডানা বন মহিমা বলা যায়। ক্যালোপ্টেরিজিডি গোত্রের সরুদেহী ফড়িংটির বৈজ্ঞানিক নাম Vestalis gracilis। এরা সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের বনাঞ্চলের পাহাড়ি জলধারার পাশে বাস করে। বিশ্বব্যাপী দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।
স্বচ্ছ ডানা বন মহিমা অনিন্দ্য সুন্দর এক ফড়িং। উদর বা পেট ৪৩ থেকে ৫৬ মিলিমিটার। পেছনের ডানার বিস্তার ৩৩ থেকে ৩৯ মিলিমিটার। দেহের রঙ ধাতব সবুজ। ডানা স্বচ্ছ হলেও একটা ধাতব আভা রয়েছে তাতে। লম্বা লম্বা পাগুলো বাদামি রঙের। মাথা সবুজ ও মাথার দুপাশে অবস্থিত পুঞ্জাক্ষি (যৌগিক চোখ) সবুজাভ-বাদামি। পুরুষ একনজরে দেখতে উজ্জ্বল সবুজ। বক্ষ সবুজ হলেও তাতে হলদে দাগ থাকে। দেহতল হলুদ ও কালো। নীল-আভাময় স্বচ্ছ ডানা। স্ত্রীও দেখতে অনেকটা একই রকম। তবে দেহের রঙ কিছুটা ফ্যাকাশে সবুজাভ-বাদামি।
সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের বনলাগোয়া রৌদ্রোজ্জ্বল উন্মুক্ত স্থান ও পথের পাশের ঘন উদ্ভিদসম্পন্ন ছড়ার পাশে পাথরের ওপর সচরাচর একাকী বসে থাকতে দেখা যায়। এরা অত্যন্ত লাজুক ও মাঝারি মানের উড়ুক্কু। সারা বছর ওড়াউড়ি করলেও জুন থেকে আগস্টের মধ্যে বেশি ওড়ে। এরা মূলত পাহাড়ি জলধারায় প্রজনন করে। তবে উপদ্রুত ও চাষাবাদের এলাকাতেও প্রজনন করতে পারে।