× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সংস্কারের অভাবে ৩০০ লোহার সেতু মারণফাঁদ

রাসেল মাহমুদ, বরগুনা

প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:২৭ পিএম

আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:০৫ পিএম

বরগুনার তালতলী উপজেলার বেহালা গ্রামের ভেঙে পড়া ব্রিজ। ফলে যাতায়াতে সমস্যায় পড়েন এলাকার জনগণ। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো

বরগুনার তালতলী উপজেলার বেহালা গ্রামের ভেঙে পড়া ব্রিজ। ফলে যাতায়াতে সমস্যায় পড়েন এলাকার জনগণ। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো

‘ব্রিজটা ভাঙা, হেইতে অ্যাম্বুলেন্স মোগো বাড়তে আইতে পারে না। নিরুপায় অইয়া মোরে মোর স্বামী কোলে কইরা পার করাইতে লইছিল, হেই ব্রিজের মইদ্দেই মোর বাচ্চাডা প্রসব হয়। বাচ্চাডার এহন আষ্ট (৮) বচ্ছর বয়স অইছে, কিন্তু ব্রিজটা এহনও ভাঙাই রইয়া গ্যাছে।’ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার বেহালা গ্রামের অনিতা রানী। ২০১৭ সালের মধ্যভাগে প্রসূতি অনিতা সেতুর ওপর সন্তান প্রসব করেছিলেন। সেই রাতের বিবরণ দিতে গিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন অনিতা।

তালতলী উপজেলার বেহালা দ্বীপের মতো জনপদ। চারদিকে চারটি শাখা নদী (নালা) দিয়ে ঘেরা। শুকনো মৌসুমে কাঠের সেতু দিয়ে পার হওয়া গেলেও বর্ষায় এ অঞ্চলের মানুষ চরম দুর্ভোগে থাকে। এ সময় নৌকা বা ট্রলারে যাতায়াত করতে হয়। বর্ষার সময় ঘরে অসুস্থ রোগী থাকলে ডাক্তার দেখানোর উপায় থাকে না। এছাড়া এখানে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার মধ্যে বেহালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কড়ইবাড়িয়া দাখিল মাদ্রাসা, হলদিবাড়িয়া স্কুল, আলীরবন্দর স্কুল ও পি কে মাধ্যমিক বিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে খালের ওপর সেতু পারাপার হতে হয়। যোগাযোগের জন্য এখানে রয়েছে পাঁচটি লোহার সেতু। কিন্তু সংস্কারের অভাবে সেগুলোর অবস্থা এতই বেহাল যে, যানবাহন দূরের কথা, মানুষ চলাচলেরও অনুপযোগী। তবু বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে হয়। সেতুর কারণে অনিতার মতো প্রসূতি, শিশু, নারী ও বয়স্কদের কষ্টের শেষ নেই। প্রায় ৮ বছর ধরে ভোগান্তির শিকার এই এলাকার ২০ হাজার মানুষ। 

হলুদিয়া গ্রামের রমণী হালদার বলেন, ‘সেতুর অভাবে এ পর্যন্ত চারজন প্রসূতি মা তাদের সন্তান প্রসব করেছেন ট্রলারে। একজন প্রকাশ্যে সন্তান প্রসব করেছেন সাঁকোর কাছে। এসব সেতু দ্রুততম সময়ে নির্মাণের দাবি জানাই।’ স্থানীয়রা জানান, একই উপজেলার শারিকখালী খালের ওপর একটি সেতু কয়েক বছর আগে ভেঙে গিয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মেরামত না করায় ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীসহ দুই পাড়ের হাজারো মানুষ। সেখানেও স্থানীয়রা বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপার হচ্ছে। 

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তথ্যমতে, ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বরগুনার ছয়টি উপজেলায় হালকা যান চলাচল প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩০০টি লোহার সেতু নির্মাণ করা হয়। জেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, নির্মাণের পর এসব সেতু রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই তাই জরাজীর্ণ হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সেতুগুলোর সিমেন্টের স্লিপার, হাতলসহ অন্যান্য অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। দুয়েক জায়গায় স্থানীয়রা বাঁশ, গাছ ও কাঠ দিয়ে মেরামত করে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০০৫ সালে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মেয়াদ বৃদ্ধি না করায় এসব সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। বর্তমানে অধিকাংশ চলাচলের অনুপযোগী। সরেজমিন বরগুনা সদর, বেতাগী, আমতলী, পাথরঘাটা, বামনা ও তালতলী উপজেলার বেশকিছু এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।

তালতলীর শারিকখালী এলাকার শাহীন মিয়া বলেন, দীর্ঘদিন সেতুগুলো ভাঙা অবস্থায় থাকলেও কোনো জনপ্রতিনিধি অথবা প্রশাসন বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না। অথচ এ বিষয়ে স্থানীয়রা একাধিকবার এলজিইডি কর্তৃপক্ষ এবং চেয়ারম্যানসহ সংসদ সদস্যের শরণাপন্ন হয়েছেন। 

শারিকখালী এলাকার কৃষক আব্দুস সোবহান বলেন, সেতু ভাঙা থাকায় প্রতি মণ ধান বাজারের তুলনায় অন্তত ৫০ টাকা কমে বিক্রি করতে হচ্ছে। এছাড়া আমতলী উপজেলার আড়পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের যুগিয়া, তালুকদার বাড়িসংলগ্ন খাল এবং চরকগাছিয়া নতুন বাজারসংলগ্ন পচাকোড়ালীয়া খালের ওপর নির্মিত সেতুসহ অন্তত ৫টি লোহার পুল অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে।

সুন্দরিয়া গ্রামের বৈশাখী। ভাঙা সেতু পার হতে ভয় করত তার। প্রতিদিন তার পরিবারের কেউ না কেউ তাকে সেতু পার হতে সহযোগিতা করত। বর্ষায় সেতু পার হওয়ার সময় পড়ে গিয়ে আঘাতও পায় সে। ফলে স্কুলে না যাওয়ার কারণে বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয় তাকে। অথচ তার বান্ধবী সোনিয়া বেহালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। কথা হয় সোনিয়ার সঙ্গে। সে বলে, সুন্দরিয়া সেতুর কারণে আমার অনেক সহপাঠীর বিয়ে হয়ে গেছে। লেখাপড়ার ইচ্ছা থাকলেও যাতায়াতের সমস্যায় তারা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। ফলে পরিবার থেকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় তাদের।

আড়ঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোহেলী পারভীন বলেন, এসব সেতু দ্রুত মেরামত করা না হলে ভোগান্তির সীমা থাকবে না। শুধু এসব এলাকায়ই নয়, বরগুনার সদর উপজেলার চালিতাতলী, সোনাখালী, আমতলী, চৌমুনী, ডালভাঙা, ঢলুয়া, রায়ভোগ, নলী, আয়লা, বৈঠাকাটাসহ একাধিক খালের ওপর লোহার সেতু জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। একইভাবে বরগুনার ছয়টি উপজেলায় তিনশর বেশি সেতু চলাচলের অনুপযোগী।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) বরগুনা অফিসের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ২০০৫ সালে আয়রন সেতু নির্মাণের প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেতুগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। এই অঞ্চলের পানিতে লবণাক্ততার কারণে দ্রুতই সেতুগুলো চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নতুন কোনো প্রকল্প না এলে এগুলো মেরামত করা সম্ভব নয়। 

এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ আয়রন সেতুগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে এবং এগুলো পর্যায়ক্রমে মেরামত করার চেষ্টা চলছে।

বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম সরোয়ার টুকু বলেন, জরাজীর্ণ সেতুগুলো সরেজমিন দেখেছি। এ বিষয়ে জাতীয় সংসদকেও জানিয়েছি। মাননীয় মন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। যতটা সম্ভব দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেতুগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা