× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বঙ্গোপসাগরে জাহাজে সত্যিই চুরি নাকি নিছক অভিযোগ

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম

প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৫১ এএম

ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় বাণিজ্যিক জাহাজে চুরির সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করেছে। চলতি বছরের চার মাসে এ ধরনের ছয়টি ঘটনা ঘটেছে। যদিও আগের বছরগুলোতে এ জাতীয় ঘটনা প্রায় শূন্যের ঘরে নেমে এসেছিল।

গত বছর সামুদ্রিক জাহাজে চুরির ঘটনা ঘটে মাত্র একটি। তার আগে ২০২২ সালে পাঁচটি ঘটনা ঘটলেও ২০২১ সালে চুরির একটি ঘটনাও ঘটেনি। কিন্তু সেই তুষ্টি বজায় রাখতে দিচ্ছে না দুর্বৃত্তরা। বরং একের পর এক চুরি হতে থাকায় বিদেশি জাহাজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে ৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে। ওইদিন সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী এমভি মায়ের্সক চট্টগ্রাম নামের জাহাজে উঠে দুজন দুষ্কৃতকারী রঙ, সেফটি চেইন, ব্রাশফায়ার ও ফায়ার হোশ চুরি করে নিয়ে যায়। তবে এসব ঘটনা নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জাহাজের ক্যাপ্টেনই নাকি বাইরে থেকে লোকজনকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মালপত্র বিক্রি করে দেন এবং পরে সেগুলো চুরি গেছে বলে রিপোর্ট করেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সবকিছু আমলে নিয়েই চুরি-ডাকাতির ঘটনার তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।

এশিয়া অঞ্চলে জাহাজে চুরি, ডাকাতি ও দস্যুতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা দ্য রিজিওনাল কো-অপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট অন কমব্যাটিং পাইরেসি অ্যান্ড আর্মড রবারি অ্যাগেইনেস্ট শিপস ইন এশিয়ার (রিক্যাপ) প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালের পর ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসে বাংলাদেশের জলসীমায় সর্বাধিক ছয়টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ২০১৯ সালেও চুরির ঘটনা শূন্য ছিল। যদিও ২০১৮ সালে চুরির ঘটনা ছিল ১১টি। ২০১৮ সালে বেশি ঘটনার কারণে কোস্ট গার্ডসহ সংশ্লিষ্টরা বেশ তৎপরতা শুরু করে। তার সুফল পাওয়া যায় ২০১৯ সালেই। ওই বছর বাংলাদেশের জলসীমায় বাণিজ্যিক জাহাজে কোনো চুরির ঘটনা ঘটেনি। একইভাবে ২০২১ সালও ছিল চুরিশূন্য। ২০২০ ও ২০২২ সালে পাঁচটি করে ঘটনা ঘটে। আর ২০২৩ সালে ঘটে মাত্র ১টি। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের জলসীমা নিরাপদই ছিল। কিন্তু আকস্মিকভাবে ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসেই ছয়টি চুরির ঘটনা ঘটে যাওয়ায় বিষয়টি আলোচনায় চলে এসেছে।

বাংলাদেশের জলসীমায় চুরি বেড়ে যাওয়ার ঘটনাকে উদ্বেগজনক মনে করছেন সমুদ্র পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, জাহাজে ছিঁচকে চুরি ও ডাকাতির ঘটনায় দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। সমুদ্রপথের বাণিজ্যেও প্রভাব পড়ে। কারণ এসব ঘটনায় অনেক সময় বাণিজ্যিক জাহাজগুলো বাংলাদেশে আসার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করে। 

তবে ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মুনতাসির রুবাইয়াত। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘রিক্যাপের প্রতিবেদনে যেসব ঘটনাকে পাইরেসি বলে উল্লেখ করা হয়, সেগুলো আসলে সেই অর্থে পাইরেসি না। আমার জানা মতে, বাংলাদেশের জলসীমায় গত ১০ বছরে দস্যুতার কোনো ঘটনা ঘটেনি। এগুলো হলো ছোটখাটো চুরির ঘটনা, জাহাজের মাস্টারদের মধ্যেই কেউ কেউ নিজেরা বাঁচতে গিয়ে অনেক সময় ছোটখাটো ঘটনাকেই রিপোর্ট করে দেন।’

অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো জাহাজের ক্যাপ্টেন তেল ও মদ বিক্রির জন্য নিজেরাই পাচারকারী চক্রকে ডেকে জাহাজে নিয়ে যান। এই সময় তেল, মদ ছাড়াও কিছু জিনিসপত্র তারা বিক্রি করে দেন। পরে সেই কোম্পানির কাছে সেগুলো ‘চুরি গেছে’ মর্মে উপস্থাপনের জন্য রিপোর্ট করে দেন। 

এ প্রসঙ্গে মুনতাসির রুবাইয়াতের বক্তব্যের সত্যতা মিলেছে গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে। বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নৌবাহিনীর বৈঠকেও মিথ্যা চুরির অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যদি কোনো জাহাজ মাস্টার চুরির সপক্ষে যথাযথ প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারেন, তাহলে মিথ্যা চুরির অভিযোগের কারণে জাহাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

রিক্যাপের তথ্য যা বলছে-

রিক্যাপের প্রতিবেদন অনুসারে, গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত চলতি বছরের ৩ মাস ২২ দিনে চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩০টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে জানুয়ারিতে। এপ্রিলের গত ২২ দিনে চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৪টি। উল্লিখিত ৩০টি ঘটনার মধ্যে ১৪টিই ঘটেছে মালাক্কা প্রণালীতে। এরপর সবচেয়ে বেশি চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায়। গত চার মাসে ওই দেশের জলসীমায় ৭টি জাহাজে চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এরপরেই রয়েছে বাংলাদেশ। গত চার মাসে বাংলাদেশের জলসীমায় ৬টি জাহাজে চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এর বাইরে ভারতের জলসীমায় তিনটি এবং ফিলিপাইনের জলসীমায় একটি ঘটনা ঘটে। 

বাংলাদেশি জলসীমায় সংঘটিত ছয়টি ঘটনার মধ্যে দুটি জাহাজে দুষ্কৃতকারীরা হানা দিলেও সফল হয়নি। বাকি চারটি জাহাজে উঠে মূল্যবান পণ্য চুরি করে নিয়ে যায়। তবে এসব ঘটনায় কোনো নাবিক হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এর মধ্যে প্রথম ঘটনাটি ঘটে গত ১৪ জানুয়ারি। ওই দিন চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের কুতুবদিয়া এলাকায় বাংলাদেশের পতাকাবাহী এমটি ওমেরা লিগ্যাসি নামের ট্যাংকারে উঠে মালামাল চুরির চেষ্টা করে দুষ্কৃতকারীরা। জাহাজের মাস্টার দ্রুত বন্দরের নিয়ন্ত্রণকক্ষ ও কোস্ট গার্ডকে অবহিত করায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। 

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ১৬ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়ায় নোঙর করা লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী এমভি মায়ের্সক হাই পং নামের কন্টেইনারবাহী জাহাজে হানা দেয় দুষ্কৃতকারীরা। এ সময় তারা জাহাজের রশি চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যায়। তৃতীয় ঘটনাটি ১৯ ফেব্রুয়ারির। কুতুবদিয়ায় নোঙর করা পানামার পতাকাবাহী এমটি গ্যাস কারেজ জাহাজে হানা দিয়ে জাহাজের স্টোর থেকে মূল্যবান মালামাল ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

চতুর্থ ঘটনা ঘটে ৩ মার্চ মোংলা বন্দরের হিরণ পাইলট স্টেশন এলাকায়। সেখানে নোঙর করা লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী এরা স্টার ট্যাংকারে হানা দেয় দুষ্কৃতকারীরা। তারা জাহাজ থেকে রশি (যা হেভ লাইন এবং মেসেঞ্জার লাইন নামে পরিচিত) চুরি করে নিয়ে যায়। পঞ্চম ঘটনাটি ঘটে ৩০ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে। মার্শাল আইল্যান্ডের পতাকাবাহী এএসএল লেবান জাহাজে হানা দেয় তিন দুষ্কৃতকারী। তাদের দেখে জাহাজের সাইরেন বাজানো হয়। এ সময় নাবিকেরা একত্রিত হলে দুষ্কৃতকারীরা নৌযানে করে পালিয়ে যায়। ৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের ঘটনাটি হচ্ছে ষষ্ঠ এবং এখন পর্যন্ত সর্বশেষ ঘটনা। 

প্রসঙ্গত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জলসীমায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। কিন্তু রিক্যাপ চুরি, ডাকাতি বা দস্যুতার সব ঘটনার তথ্য এক ছকে উপস্থাপন করে। ফলে সবগুলো ঘটনাই দস্যুতা প্রতীয়মান হলেও কার্যত বাংলাদেশের জলসীমায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই ছিঁচকে চুরি।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভাষ্য

এ সম্পর্কে জানতে বুধবার দুপুরে নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদের কার্যালয়ে গেলে জানা যায়, তিনি বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন। সংস্থাটির সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন শেখ মো. জালালউদ্দিনের দপ্তরে যাওয়ার পর তিনি ব্যস্ত থাকার কারণে কথা বলতে পারবেন না বলে জানান।

একই বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-সংরক্ষক (নৌ বিভাগ) ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অনেক সময় ক্যাপ্টেনরা লোকজন ডেকে জাহাজের পুরোনো মালামাল যেমন রঙ, রশি ইত্যাদি বিক্রি করেন। পরে সেগুলো চুরি হয়েছে মর্মে রিপোর্ট করেন। গত মার্চ মাসে এ ধরনের রিপোর্টের পর আমরা তদন্ত করেছি। কিন্তু তদন্ত পর্যায়ে নাবিকরা জাহাজ দুটিতে চুরির ঘটনার পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। এ কারণে জাহাজ দুটিকে শোকজ করা হয়।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘মঙ্গলবার নৌবাহিনীর সঙ্গে জাহাজে চুরির বিষয়ে মিটিং হয়েছে। নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যদি কোনো জাহাজ চুরির অভিযোগ করে তাহলে চুরির স্বপক্ষে যথাযথ প্রমাণ না দেওয়া পর্যন্ত তাদেরকে বন্দর ছাড়তে দেওয়া হবে না।’ 

এশিয়ার অন্যান্য দেশের চিত্র

রিক্যাপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভারতের জলসীমায় বিভিন্ন জাহাজে ৫টি চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সেখানে চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ঘটেছে দুটি ঘটনা। ২০২৩ সালে ভিয়েতনামের জলসীমায় জাহাজে চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে ৩টি। সেখানে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত কোনো ঘটনাই ঘটেনি। একইভাবে মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডের জলসীমায় ২০২৩ সালে মাত্র একটি করে চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তবে চলতি বছরের এ পর্যন্ত কোনো ঘটনা নেই। 

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বাধিক চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে মালাক্কা প্রণালীতে। সেখানে ২০২৩ সালে ৬৩টি ঘটনা ঘটেছে। আর চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১৪টি। 

এদিকে প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফিলিপাইনে ২০২০ সালের পর থেকে তাদের জলসীমায় অবস্থানরত জাহাজে চুরির ঘটনা ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০২০ সালে ১৩টি, ২০২১ সালে ১১টি, ২০২২ সালে ৪টি, ২০২৩ সালে ১০টি এবং চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র একটি ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। তবে শুধু ফিলিপাইনেই নয়, একই সময়ে ভারত এবং ভিয়েতনামেও জাহাজে চুরি-ডাকাতির ঘটনা কম হয়েছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা