সাক্ষ্য দিলেন মা
চট্টগ্রাম অফিস
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৩০ এএম
স্বামী বাবুল আক্তারের সঙ্গে নিহত মিতু। ফাইল ফটো
ভারতীয় এক নারীর সঙ্গে বাবুল আক্তারকে পরপর দুইবার ‘আপত্তিকর অবস্থায়’ দেখে ফেলার পর মিতুকে প্রথমে মানসিক অত্যাচার ও পরে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে এ কথা জানান মিতুর মা শাহেদা মোশাররফ।
চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে তিনি বলেন, ‘এক দিন বাবুল আক্তার মিতুকে নিয়ে কক্সবাজারের একটি হোটেলে ওঠে। পাশের রুমে ভারতের ওই নারীও ওঠে। ওই রুমে তার সঙ্গে বাবুল আক্তারকে সেদিন রাতে মিতু পর পর দুইবার আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে। মিতু নিজের রুমে এসে কেঁদে কেঁদে আমাকে ফোন দেয়। তখন আমি তাকে চলে আসতে বলি। কিন্তু মিতু বলে, আমার ছেলে-মেয়েরা আমাকে খারাপ মনে করবে। তাই আমি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি।’
চট্টগ্রাম মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্দুর রশিদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে শাহেদা মোশাররফের সাক্ষ্যে দেওয়া এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, ‘সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় আজ (মঙ্গলবার) মিতুর মা শাহেদা মোশাররফসহ দুজন সাক্ষ্য দেন। দুপুর ১২টায় চাঞ্চল্যকর এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর প্রথমে সাক্ষ্য দেন অবসরে যাওয়া পুলিশ পরিদর্শক মহিউদ্দিন মাহমুদ। ঘটনার সময় তিনি পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্বে ছিলেন। এরপর সাক্ষ্য দেন শাহেদা মোশাররফ।’
শাহেদা মোশাররফ তার সাক্ষ্যে জানান, ২০০২ সালের ২৬ এপ্রিল বাবুল আক্তারের সঙ্গে তার বড় মেয়ে মাহমুদা খানম মিতুর বিয়ে হয়। তখন বাবুল আক্তার বেকার ছিলেন। বিয়ের পর থেকেই তাদের সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। পরে বাবুল পুলিশে যোগ দেন। কক্সবাজারে এসপি (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) হিসেবে বদলি হওয়ার পর তিনি সেখানে ভারতীয় এক নারীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।
তিনি জানান, বাবুল আক্তার বিদেশে (মিশনে) থাকার সময় তিন-চারবার বাংলাদেশে আসেন। তবে দেশে ফিরলেও তিনি কখনও বাসায় অর্থাৎ মিতু কিংবা তার ছেলেমেয়েদের কাছে যাননি। মিশন শেষ করে তিনি চীনে চলে যান। সেখানে তিনি মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
মিতুর মা তার সাক্ষ্যে বলেন, ‘মিতুর একটি ব্যবসা ছিল। সেই ব্যবসার তিন লাখ টাকা দিয়ে মিতুকে খুন করা হয়েছে। মিতু মারা যাওয়ার পর বাবুল আক্তার আমাদের বাসায় ওঠে। ছয় মাস আমাদের বাসায় ছিল সে। সেখানে বসে সে আসামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ২০১৬ সালের ২৪ জুন তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে ফেরে। আমি তখন তাকে জিজ্ঞেস করি, চাকরি ছাড়লে কেন? তখন সে বলে, মিতু খুন হওয়ার কারণে আমাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে। আমি তাকে বলি, তোমার চাকরি ছাড়ার বিষয় কি মিতুর খুনের বিচারের জন্য?’
শাহেদা মোশাররফ জানান, বাবুল আক্তার মিতুকে খুন করার জন্য মুসাকে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে অস্ত্র কিনে দেন। মুসার স্ত্রী এ-কথা জানিয়েছেন। তিনি তার স্বামীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি মিতুকে খুন করেছ?’ তখন মুসা তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘আমি খুন না করলে বাবুল আক্তার আমাকে ক্রসফায়ারে দিত।’
শাহেদা বলেন, ‘আসামি ওয়াসিম ও আনোয়ার গ্রেপ্তার হয়েছিল। এর কিছুদিন পরেই ভোলা ধরা পড়ে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর সে আদালতে জবানবন্দি দেয়, বাবুল আক্তারের নির্দেশেই মিতুকে খুন করেছে মুসা। মিতু মারা যাওয়ার দেড় মাস পর সে যে বাসায় ছিল, ওখানে মিলাদ পড়ানোর জন্য আমরা চট্টগ্রাম আসি। এর কিছুদিন পর আসামি কালু ও শাহজাহান গ্রেপ্তার হয়। আমরা চট্টগ্রাম আসার পরে অবস্থা দেখে মনে হয়েছে, পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাবুল আক্তার মিতুকে খুন করেছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ও নিজেই মিতু হত্যার মামলা করে। পরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমার স্বামীকে বলেন, আপনারা বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২০২১ সালের ১২ মে মিতুর বাবা বাবুল আক্তারকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন।’
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৫ জুন ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড় এলাকায় খুন হন মাহমুদা খানম। তখন তার স্বামী বাবুল আক্তার বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০২১ সালের ১২ মে এ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ওই দিনই মাহমুদার বাবা মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে বাবুলসহ আটজনকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করেন। সেদিনই বাবুল আক্তারকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। সেই থেকে তিনি এখনও কারাগারে রয়েছেন। বাবুল ও তার শ্বশুরের করা দুটি মামলা তদন্ত করে পিবিআই।
বাবুল আক্তারসহ সাতজনের বিরুদ্ধে পিবিআইয়ের দেওয়া অভিযোগপত্র ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর গ্রহণ করেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট। গত বছর ১৩ মার্চ বাবুল আক্তারসহ সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত। একই বছরের ৯ এপ্রিল এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।