প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৫০ পিএম
আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:২০ পিএম
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন শ্রমিক আব্দুর রাজ্জাক। তার দুই হাতেই গুলি লেগেছে। প্রবা ফটো
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বিসিক এলাকায় বকেয়া বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষের মধ্যে দুই শ্রমিককে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়েছে। তবে আরেক শ্রমিক দাবি করেছেন, তাদের তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আর পুলিশ বলছে, পাঁচজন রাবার বুলেটে আহত হয়েছেন বলে শুনেছেন তারা।
রবিবার (২১ এপ্রিল) বেলা সাড়ে ৩টার দিকে তাদের ঢামেকে ভর্তি করা হয়। ওই দুই শ্রমিক হলেন আব্দুর রাজ্জাক ও মোছাঃ চাঁদনী খাতুন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ এলাকা থেকে দুইজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আনা হয়েছে। জরুরি বিভাগে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’
তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসা সহকর্মী শাকিল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ফতুল্লার বিসিক এলাকার অবন্তী কালার টেক্সটাইল করণী গ্রুপের শ্রমিকরা দুই মাসের বেতন না দেওয়ায় তারা কাজ বন্ধ করে দেন। শাকিলের অভিযোগ, বেতনের দাবিতে আজ আন্দোলনে নামলে পুলিশ আন্দোলনকারী শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে শটগান দিয়ে গুলি করে। এতে রাজ্জাকের দুই হাতে এবং চাঁদনী খাতুনের ডান হাতে গুলিবিদ্ধ হয়। পরে তাদেরকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসেন।
তিনি জানান, আহত রাজ্জাক গাইবান্ধা সদর জেলার চকবহনপুর গ্রামের মোহাম্মদ আফসার সরকারের ছেলে। আর চাঁদনীর গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানার পারখোলা গ্রামে।
এদিকে তুষার নামে আরেক শ্রমিক দাবি করেছেন, সংঘর্ষে তাদের তিনজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধসহ ২৫ জন আহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠনো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরে আজম বলেন, ‘সংঘর্ষে পাঁচজন রাবার বুলেটের আহত হয়েছে বলে শুনেছি। তারা কোথায় আছে তা আমার জানা নেই।’
এর আগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বকেয়া বেতনের দাবিতে ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন ক্রোনী গ্রুপের রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা অবন্তী কালার টেক্স লিমিটেডের শ্রমিকরা। মালিকপক্ষ আগামী বৃহস্পতিবার বেতন দেওয়া হবে জানালে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন শ্রমিকরা। এসময় বিদ্যুতের খুঁটি ও বাঁশ ফেলে সড়কের দুই পাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সড়কে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা।
ঘটনাস্থলে শিল্প পুলিশের জলকামান নিয়ে গেলে উত্তেজিত শ্রমিকরা তা ভাঙচুর করেন। রাবার বুলেট ছুঁড়লে শ্রমিকরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এসময় শিল্প পুলিশ টিয়ারশেল ছুড়লে শ্রমিকরা কিছুটা পিছু হটলেও তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে।
পরে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ এসে শ্রমিকদের শান্ত হওয়ার আহবান জানায়। এরপর বেতন-ভাতা নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনার আশ্বাসে শান্ত হন শ্রমিকরা। পরে সড়কের যানবাহন চলাচলের স্বাভাবিক হয়।
কারখানার শ্রমিক সুমাইয়া আক্তার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের শ্রমিকদের ঈদ বা উৎসব নেই। প্রতি মাসে বেতনের জন্য রাস্তায় নামতে হয়। বাসের টিকেট কেটেও গ্রামের বাড়ি যেতে পারিনি। টাকা নেই, বাড়ি গিয়ে কী করব? আমাদের ঈদের আনন্দ শেষ করে দিয়েছে ক্রোনীর মালিক। আমরা কী মানুষ না অন্য কিছু?’
কারখানাটির সুইং অপারেটর মো. মাসুদ বলেন, ‘এপ্রিলের ৮ তারিখ কারখানা বন্ধের সময় মোবাইলে বেতন পরিশোধের আশ্বাস দিয়েও কথা রাখেনি মালিকপক্ষ। গত ৮ মাস ধরে বেতন নিয়ে এভাবে গড়িমসি করছে মালিকপক্ষ। তাই বেতনের দাবিতে আমরা রাস্তায় নেমেছি। বেতন ঢুকল এই আশায় ঈদের দিনও বারবার মোবাইল চেক করেছি। কিন্তু বেতন আসেনি। ঈদের সময় বেতন পাইনি, তাই এবার আমাদের ঈদে আনন্দ ছিল না। অন্তত অর্ধেক বেতন দিলেও তো হত।’
নারায়ণগঞ্জ শিল্প পুলিশ-৪ এর পরিদর্শক (ইনটেলিজেন্স) সেলিম বাদশা বলেন, ‘শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন বকেয়া ছিল ঈদের আগে। বোনাসও একসঙ্গে দেওয়ার কথা ছিল। ঈদের আগে বোনাস দিলেও মার্চ মাসের বেতন দিতে পারেনি মালিকপক্ষ। তবে মালিকপক্ষ কথা বলে ঠিক করে নিয়েছিল শ্রমিকদের সঙ্গে। আজ (রবিবার) কাজে যোগ দিয়েই শ্রমিকরা বেতন চান। বেতন বৃহস্পতিবার দিতে চাচ্ছিল মালিকপক্ষ।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ নিয়ে কথা চলার মধ্যেই শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করেন। মালিকপক্ষ পরবর্তীতে মঙ্গলবার বেতন দিতে রাজি হলেও শ্রমিকরা তা মানেনি। তারা আজই বেতন চান।’
সেলিম বাদশা বলেন, ‘সড়ক অবরোধ করা শ্রমিকদের সরে যেতে বললে তারা পুলিশের ওপর ব্যাপক ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এতে আমাদের কয়েকজন সদস্য আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ উপায়ন্তর না পেয়ে টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেছে।’
ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরে আজম বলেন, ‘তারা তিন মাসের বেতন-ঈদ বোনাস পাওনা আছে। একাধিকবার আশ্বাস দিলেও মালিকপক্ষ তা পরিশোধ করেনি। সকালে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে গিয়ে ফ্যাক্টরি বন্ধ দেখতে পায়। ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে গেলে শ্রমিকদের ফ্যাক্টরি থেকে বের করে দেওয়া হয়। শ্রমিকরা কারখানা থেকে বের হয়ে ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে। এ সময়ে তারা রাস্তায় বিদ্যুতের খুঁটি ফেলে ও টেবিলে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ করে।’
আশ্বাসে ফিরেছেন শ্রমিকরা
মালিকপক্ষের আশ্বাসের ভিত্তিতে শ্রমিকরা পরে বিক্ষোভ শেষ করে ফিরে যান।
ক্রোনী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসলাম সানি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঈদের আগে সব শ্রমিককে বোনাস দিয়েছি। শিপমেন্ট ঠিকমতো না হওয়ায় মার্চের বেতনটা দিতে পারিনি। আমরা আগামী বুধবারের মধ্যে সবার বেতন পরিশোধ করে দেব।’