× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মরুভূমির হাওয়া রাজশাহীতে, পানির স্তর নামছেই

রাজু আহমেদ, রাজশাহী

প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৪ ১১:০০ এএম

আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৩৮ এএম

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল কাফির রাজশাহী জেলা ও মহানগরের পরিবেশ এবং জলবায়ু নিয়ে করা গবেষণা চিত্রে দেখা যাচ্ছে রাজশাহী অঞ্চলে নগরায়ণের প্রভাবে কীভাবে সবুজায়ন ও জলাধার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছবি : সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল কাফির রাজশাহী জেলা ও মহানগরের পরিবেশ এবং জলবায়ু নিয়ে করা গবেষণা চিত্রে দেখা যাচ্ছে রাজশাহী অঞ্চলে নগরায়ণের প্রভাবে কীভাবে সবুজায়ন ও জলাধার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছবি : সংগৃহীত

পানি সংকটের আলোচনায় এত দিন উত্তরাঞ্চলে খুব বেশি করে শোনা যেত রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত তানোর উপজেলার নাম। কিন্তু গত বছর থেকে রাজশাহীর প্রায় সব উপজেলাতেই এই খরা মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে সংকট দেখা দিতে শুরু করেছে।

গবেষকরা বলছেন, প্রতিবছর রাজশাহী অঞ্চলে ৪ ফিট করে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। সেই সঙ্গে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে তাপমাত্রা। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে উধাও হচ্ছে সবুজ প্রকৃতি ও জলাধার। ওদিকে বৃষ্টিপাতও কমে এসেছে। যেটুকু বৃষ্টি হচ্ছে, সেটুকুর পানিও কোনো কাজে লাগছে না। বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, রাজশাহীর প্রকৃতিতে এখন মরুভূমির হাওয়া লেগেছে, ভূগর্ভস্থ পানি সংকটও চরম আকার ধারণ করেছে।

স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানির তীব্র সংকট তানোরে

তানোর উপজেলার মুণ্ডমালা পৌরসভার একটি বড় এলাকাজুড়েই পানির সংকট দীর্ঘদিনের। কারণ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। পাঁচন্দর মাহালীপড়া গ্রামের মাহালী সম্প্রদায়ের বসবাস। প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে তাদের গৃহস্থালি কাজ ও খাওয়ার জন্য পানি আনতে হয়। একই চিত্র বাঘা উপজেলার শিমুলিয়া ও পাটিয়াকন্দি গ্রামে। টিউবওয়েল ও ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে গত ২০ দিন থেকে পানি উঠছে না। এসব গ্রামের মানুষকেও পানি সংগ্রহের জন্য দূর-দূরান্তে ছুটতে হচ্ছে। গ্রামগুলোর প্রতিটি পরিবারের দুঃখ ও কষ্টের নাম পানি। প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার কাছে তারা অসহায় হয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের বিভিন্ন স্থানে গভীর নলকূপ থাকলেও সেগুলো থেকে এখন আর পানি মিলছে না। অনেকেই পানি নিয়ে আসছেন দূর গ্রাম থেকে। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, দূর গ্রাম থেকে পানি আনতে গিয়ে গর্ভপাত ঘটেছে পরিবারের গর্ভবতী নারীর। এ অবস্থায় অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। পাঁচন্দর মাহালীপড়া গ্রামের অনেক আবাদি জমি সেচের পানির অভাবে অনাবাদি পড়ে রয়েছে।

এমপিকে দুর্ভোগ-অনিয়মের কথা জানিয়েছে জনগণ

এদিকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, তানোর-গোদাগাড়ি, পবা-মোহনপুর, বাগমারা ও পুঠিয়া-দুর্গাপুর অঞ্চলে টিউবওয়েলের পানির স্তরের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের এমপি শাহরিয়ার আলম। ইউনিয়ন ও উপজেলার নাম উল্লেখ করে কমেন্ট বক্সে পানি সংকটের চালচিত্র তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, যাদের সাবমারসেবল (গভীর নলকূপ) দেওয়া হয়েছে, তারা যেন এই কঠিন সময়ে প্রতিবেশীদের পানি নিতে সহায়তা করেন। 

এমপির এই পোস্টের নিচে বাঘা-চারঘাট, তানোর, দুর্গাপুরসহ আশপাশের উপজেলার মানুষ এই খরায় পানি নিয়ে তাদের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরেছেন। অনেকেই তার পোস্টে মন্তব্য নিয়ে জানিয়েছেন, চারঘাট-বাঘায় পানির অভাবে বেশ সমস্যা হচ্ছে। এখানে গভীর টিউবওয়েল বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা কোনো কাজে আসবে বলে মনে করছেন না কেউ। বরং গভীর নলকূপ বসানোর ফলে পানির স্তর আরও দ্রুত নেমে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করেছেন কেউ কেউ। তারা আগামী দিনগুলো নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করছেন। সেই সঙ্গে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেছেন সরকারের গভীর টিউবওয়েল বরাদ্দ দেওয়ার কার্যক্রমে।

রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস

রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, রাজশাহীতে গতকাল শনিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ১৩ শতাংশ। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এই তামপাত্রা আরও বাড়তে পারে। বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় গরম কম অনুভূত হচ্ছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল কাফির রাজশাহী জেলা ও মহানগর নিয়ে একাধিক গবেষণা রয়েছে। বিভিন্ন সাময়িকীতেও তা প্রকাশিত হয়েছে। এই পরিবেশ গবেষক বলেন, ‘রাজশাহী জেলায় ২০০০ সালে ১৭২ বর্গকিলোমিটর জায়গাজুড়ে নগরায়ণ ঘটেছিল। ২০২০ সালে তা ৩৮৭ বর্গকিলোমিটার ছাড়িয়েছে। ২০০০ সালে ১ হাজার ২২৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে সবুজায়ন ছিল ২০২০ সালে, যা কমে নেমে এসেছে ৯২৬ বর্গকিলোমিটারে। ২০০০ সালে ২৯৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিভিন্ন জলাধার ছিল। যা কমে এখন ১৮০ বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে। ২০০০ সালে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রকৃতি নিজেই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সেদিন আর দূরে নয়, যেদিন ক্ষতিগ্রস্ত প্রকৃতির আমাদের দেওয়ার কিছুই থাকবে না।’

৮ শতাংশ জলাধার নেমে এসেছে ৪ শতাংশে

আব্দুল্লাহ আল কাফি প্রণীত ও প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে রাজশাহী নগরীর গত ৩০ বছরের (১৯৯০-২০২০) চালচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে দেখা যায়, ১৯৯০ সালে রাজশাহী নগরীতে ৮ শতাংশ জলাধার ছিল। ২০২০ সালে যা কমে ৪ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯০ সালে নগরীর ৫৭ শতাংশ এলাকাজুড়ে সবুজায়ন ছিল। ২০২০ সালে তা নেমে এসেছে ৩৯ শতাংশে। অর্থাৎ গড়ে সবুজায়ন কমেছে ১৮ শতাংশের বেশি। জলাধার ও সবুজায়ন কমার অন্যতম কারণ নগরায়ণ বা বহুতল ভবন নির্মাণ এবং উন্নয়নের নামে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বৃক্ষরোপণ করে কংক্রিটের নগর গড়ে তোলা। ১৯৯০ সালে এই শহরে নগরায়ণ ঘটেছিল মাত্র ১৫ শতাংশ এলাকায়। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ শতাংশে। বৃক্ষ নিধন, জলাধার ভরাট ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে এই ৩০ বছরে রাজশাহীর তাপমাত্রা বেড়েছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৯০ সালে এই শহরে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৭ ডিগ্রি, ২০২০ সালে যা ৪০ ডিগ্রিতে দাঁড়িয়েছে। এবার রাজশাহীর তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাবে বলে এরই মধ্যে আবহাওয়া অধিদপ্তর পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে। 

‘এ বছর প্রচণ্ড খরা হবে’ : অধ্যাপক চৌধুরী সজল

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল এই অঞ্চলের পানির ভবিষ্যৎ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে গবেষণা করে আসছেন। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘গত বছর বৃষ্টিপাত এমনিতেই কম হয়েছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বাড়েনি। গত বছরের সংকটও কাটেনি। গত বছরই বলা হয়েছিল আগামী বছর কৃষকরা পানি পাবে না। এখন প্রলম্বিত তাপপ্রবাহ চলছে। এ বছর তাই প্রচণ্ড খরা হবে। গ্রাউন্ড ওয়াটার বা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে দ্বিগুণ হারে। খরা মৌসুমে গ্রাউন্ড ওয়াটার লেবেলে পানিই থাকছে না। মরুভূমির দেশগুলোতে বৃষ্টিপাত ও বন্যা হলেও অতি বৃষ্টিপ্রবণ বাংলাদেশের এলাকাগুলোতে বৃষ্টির দেখা নাই। এ বছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও ৪ ফিট পর্যন্ত নেমে গেছে। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) যে সংখ্যক ডিপ স্থাপন করেছে তার দ্বিগুণ ডিপ এই অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে মাটির নিচে পানি থাকবে না।

সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, ‘গ্রাউন্ট ওয়াটার রিচার্জ করা ও সারফেস ওয়াটারের ব্যবহার নিশ্চিত করা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা নেই। বৃষ্টির পানির অপচয় না করে এই পানিকে কার্যকরভাবে মাটির নিচে পৌঁছে দিতে হবে। আর নদীনালার পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সেচে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। এজন্য নদীনালা, খালবিল খনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা