এমভি আব্দুল্লাহ
এস এম রানা, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১১:০৪ এএম
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১১:১৭ এএম
বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। ফাইল ছবি
গত ১২ মার্চ দুপুর। কর্মব্যস্ত কবির মঞ্জিলের পাশের অফিসপাড়া। নিজদের করপোরেট হাউজে ব্যস্ত কর্মীরা ছিলেন নিজ নিজ কাজে। এমন ব্যস্ততার মধ্যেই ভারত মহাসাগর থেকে যেন ‘বোমা’ এসে পড়ে কবির মঞ্জিলে। মেসেঞ্জারে আসা সেই বোমার নাম জলদস্যু। জলদস্যুরা ছিনতাই করেছে জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। কবির মঞ্জিলজুড়ে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। কর্মব্যস্ত অফিস মুহূর্তেই ছেয়ে যায় বিষাদের ছায়ায়।
এই কবির মঞ্জিলের বাসিন্দা চট্টগ্রামের বনেদি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহজাহান। যার হাত ধরে কবির (কেএসআরএম) গ্রুপের গোড়াপত্তন। তাকে এই ব্যবসার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন বাবা মোহাম্মদ কবির আহেমদ। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার এই ব্যবসায়ী জাহাজের মালামালের ব্যবসা করতেন বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা সীতাকুণ্ডে। সেখানেই তিনি জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ড তৈরির জন্য জমি কিনেছিলেন। কিন্তু ইয়ার্ড তৈরির আগেই ১৯৮৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন কবির আহমেদ। এরপর বাবার ব্যবসার হাল ধরে বাবার কেনা জমিতে ইয়ার্ড তৈরির মাধ্যমে কবির গ্রুপের গোড়াপত্তন করেন মোহাম্মদ শাহজাহান। প্রায় চার দশকের বেশি সময় আগে জাহাজভাঙা শিল্পের মাধ্যমে গোড়াপত্তন হওয়া কবির গ্রুপ পরবর্তী সময়ে সমুদ্রগামী জাহাজ ব্যবসায় যুক্ত হয়। গ্রুপটির মালিনাকায় এখন ২৪টি জাহাজ রয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রগামী মোট জাহাজের সংখ্যা ৯৬টি। এর মধ্যে এককভাবে ২৪টি জাহাজের বহর নিয়ে দেশের সমুদ্রগামী এক-চতুর্থাংশ জাহাজের মালিক হয়ে ওঠে গ্রুপটি। একই সঙ্গে গ্রুপটি লোহা, সিমেন্টসহ নানা শিল্প-কারখানা সম্প্রসারণ করে।
বহরে থাকা সেই ২৪টি জাহাজের একটি এমভি আব্দুল্লাহ জলদস্যুদের কবলে পড়ে ১২ মার্চ। এর আগে ২০১০ সালের ডিসেম্বর একবার কবির মঞ্জিলের বাণিজ্যিক আলো ম্রিয়মাণ হয়েছিল এমভি জাহান মনি জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর। ১৪ বছরের ব্যবধানে গ্রুপের দুটি বাণিজ্যিক জাহাজে এই আঘাত করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। সেবারও মুক্তিপণে ২৬ প্রাণ ফিরিয়েছিলেন মোহাম্মদ শাহজাহান।
কেএসআরএমের অফিস চট্টগ্রাম মহানগর বাণিজ্যিক পাড়া আগ্রাবাদের কাছেই। চট্টগ্রাম বন্দর লাগোয়া বারিক বিল্ডিং মোড়ে কবির মঞ্জিল নামের একটি ভবনে। কয়েকটি ভবন নিয়ে গড়ে ওঠা কবির মঞ্জিলে মোহাম্মদ শাহজাহানের বাস। সামনের অংশের কয়েকটি ভবন ঘিরে কেএসআরএমের করপোরেট অফিস। সেই অফিস ও মোহাম্মদ শাহজাহানের পরিবার পিনপতন নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়েছিল ১২ মার্চ দুপুরে।
জাহাজ জিম্মি হওয়া এবং জলদস্যুদের কবল থেকে জাহাজ উদ্ধারে অভিজ্ঞ প্রবীণ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহজাহান। তাই তিনি ভেঙে পড়লেন না। ভরসা রাখলেন উপরওয়ালার ওপর। এখন তার দুই সন্তান সরওয়ার জাহান রোকন এবং শাহরিয়ার জাহান রাহাত ব্যবসায় সিদ্ধহস্ত। দুইজন গ্রুপটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১০ সালে যখন এই দুই সন্তান ব্যবসায় অনেকটা নবীন ছিলেন তখন একা হাতেই জলদস্যুদের সামাল দিতে হয়েছিল মোহাম্মদ শাহজাহানকে। এবার দুই হাতে দুই শক্ত খুঁটি পেয়েছেন তিনি। তাই এক মাসের মধ্যে ১৪ এপ্রিল মুক্তিপণ দিয়ে ২৩ নাবিককে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে পেরেছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কবির গ্রুপের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী মেহেরুল করিম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, জাহাজটি সোমালিয়ান উপকূল থেকে ৫৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে। দুবাই পৌঁছতে জাহাজটিকে আরও ৭৭০ নটিক্যাল মাইল পাড়ি দিতে হবে। বর্তমানে জাহাজটি গড়ে সাড়ে ১০ নটিক্যাল মাইল গতিতে চলছে। এই হিসেবে জাহাজটি ২২ এপ্রিল সকালে হামরিয়া বন্দরে পৌঁছবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। জাহাজটি ইতোমধ্যে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা অতিক্রম করেছে। এখন যে গতিতে চলছে তাতে ২২ এপ্রিল সকালে দুবাই বন্দরে গিয়ে পৌঁছবে, যা এখন মোটামুটি নিশ্চিত।’
কবির মঞ্জিলে দীর্ঘ ৩২ দিনের নিস্তব্ধতা বা অমানিশার অন্ধকার কেটেছে নিশ্চিত করে তিনি বলেন, ‘এই সময়টুকু কীভাবে পার করেছি সেটা মুখের ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। একদিকে ২৩ নাবিকের জীবন, অন্যদিকে জলদস্যুদের হাতে থাকা বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল। এ যেন এক বিভীষিকাময় দিন। মহান আল্লাহর অশেষ রহমত, শেষ পর্যন্ত পুনরায় উজ্জীবিত হয়েছে কবির মঞ্জিল। সেই পুরোনো চেহারায় কর্মীরা নতুন উদ্যমে কাজ করছেন। এ যেন সমুদ্রজয়ের পর মুক্তির আনন্দ।’ সরেজমিনে উজ্জীবিত কর্মীদের দেখা গেছে কবির মঞ্জিলে। বিকালে কবির মঞ্জিলের অফিস পরিদর্শনের সময় দেখা গেছে, ‘কর্মীরা হাস্যোজ্জ্বল। তারা নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত। গত সপ্তাহেও যে অফিসের কর্মীদের মুখ ছিল মলিন, আজ তাদের মুখে পূর্ণিমার হাসি।’