সাক্ষাৎকার: মেহেরুল করিম
এস এম রানা, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ১২:০৫ পিএম
আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ১২:২৬ পিএম
এসআর শিপিং লাইন্সের প্রধান নির্বাহী মেহেরুল করিম। প্রবা ফটো
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পতাকাবাহী দুটি জাহাজ সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। দুটি জাহাজই উদ্ধার প্রক্রিয়ায় নেপথ্যের নায়ক এসআর শিপিং লাইন্সের প্রধান নির্বাহী মেহেরুল করিম। তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এস এম রানা
প্র. বা : এসআর শিপিং লাইন্সের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন?
মেহেরুল করিম : এই কোম্পানির সঙ্গে আমি ২০১১ সাল থেকে যুক্ত হই। এর আগে জাহান মনি উদ্ধার প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকলেও আমি কোম্পানির নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মী ছিলাম না। যেদিন জাহান মনি উদ্ধার হয়ে ওমান পৌঁছে, কোম্পানি ওই দিনই আমাকে চাকরির প্রস্তাব দেয়। আমি দুই-তিন মাস সময় নিয়ে ভাবলাম। যেহেতু আমি তখন জার্মানির একটি কোম্পানিতে চাকরি করতাম সেহেতু ভালোমন্দ ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে যোগদান করি।
প্র. বা : এমভি আব্দুল্লাহ জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার পর্ব পর্যন্ত বলুন।
মেহেরুল করিম : এমভি আব্দুল্লাহ জলদস্যুদের কবলে পড়ে গত ১২ মার্চ। দুই দিন পর ১৪ মার্চ জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। সেই দিনই আমাদের সঙ্গে জলদস্যুদের যোগাযোগ হয়। এরপর মুক্তিবিষয়ক কথাবার্তা শুরু করি। ধীরে ধীরে সেই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে থাকি। ধাপে ধাপে কথা বলে আমরা একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হই। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে গত ১৪ এপ্রিল ভোর ৩টার দিকে জলদুস্যরা জাহাজ থেকে নেমে যায়। এর মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই নাবিকদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। একাধিক দফায় সব নাবিকের সর্বশেষ অবস্থা জানতে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছি।
প্র. বা : ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে এমভি জাহান মনি জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর উদ্ধার প্রক্রিয়ায় আপনি কীভাবে যুক্ত হয়েছিলেন?
মেহেরুল করিম : এমভি জাহান মনি জিম্মি হওয়ার সময় ২০১০ সালে আমি কেএসআরএমে কর্মরত ছিলাম না। তখন আমি একটি জার্মান কোম্পানিতে কর্মরত ছিলাম। জাহান মনি জিম্মি হওয়ার পর একপর্যায়ে কোম্পানি কীভাবে যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কোম্পানির পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়, আমি যেন জাহান মনি উদ্ধার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে কোম্পানিকে সহযোগিতা করি। এরপর আমি জার্মান কোম্পানিকে বিষয়টি অবহিত করি। জামার্নির ওই কোম্পানিও ছিল জাহাজ ব্যবসায় যুক্ত। অতএব ওই কোম্পানি বিষয়টি অনুধাবন করে এবং তিন মাসের জন্য আমাকে ছুটি দেয়। এই সময় আমি জাহান মনি উদ্ধার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হই। কিন্তু তখন আমিও নতুন ছিলাম। তারপরও জাহাজটি উদ্ধার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ আমাকে সফল করেছিলেন। তবে জাহান মনি উদ্ধার খুবই কঠিন ছিল। নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে ঘাটে ঘাটে বিপত্তির মুখে পড়তে হয়েছিল।
প্র. বা : জাহান মনি উদ্ধার প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা এমভি আব্দুল্লাহ উদ্ধারের ক্ষেত্রে কীভাবে কাজে লাগালেন?
মেহেরুল করিম : এমভি আব্দুল্লাহ উদ্ধার প্রক্রিয়ায় দুইভাবে এগিয়েছি। জাহান মনি উদ্ধারের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আবার জলদস্যুদের সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। দুই সিদ্ধান্তের পর কাজটি সহজ হয়েছে। এর বাইরে উদ্ধার প্রক্রিয়ায় যাদের সঙ্গে কথা বলা উচিত, সবার সঙ্গে সমানতালে কথা বলেছি এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছি। এমভি জাহান মনির ক্ষেত্রে সময় বেশি লাগার কারণ, জাহান মনির উদ্ধারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আনুষঙ্গিক কার্যক্রম এগিয়ে নিয়েছিলাম। আর এমভি আব্দুল্লাহর ক্ষেত্রে দুই মাধ্যমে সমানতালে কাজ করেছি। ফলে সময় কম লেগেছে। তিন মাসের পরিবর্তে এক মাসের মধ্যেই শেষ হয়েছে।
প্র. বা : ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ভারতীয় নেভি যখন জাহাজে অভিযান চালাতে চাইল, তখন বাধা দিলেন কেন?
মেহেরুল করিম : আমার মূল লক্ষ্য ছিল নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। নাবিকেরা অক্ষত ফিরলে জাহাজও ফিরবে। তাই নাবিকদের উদ্ধারের বিষয়টিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি এবং সরকারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের বার্তা পৌঁছানো হয়েছে, যাতে অভিযান পরিচালনা করা না হয়। আমরা জানি, উদ্ধার অভিযান শুরু হলে জানমালের ক্ষতি হতে পারে। এমন ঝুঁকি আমরা নিতে চাইনি। এ ছাড়া এমভি রুয়েন উদ্ধারের পর নাবিকদের কী অবস্থা হয়েছিল তার সঠিক তথ্য আমরা জানি না। আবার অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি আছে। অতএব কোম্পানি কোনো প্রকার ঝুঁকি নিতে চায়নি। সরকারও এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে।
প্র. বা : এমভি আব্দুল্লাহর নিরাপত্তা বিষয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে, কেন?
মেহেরুল করিম : এমভি আব্দুল্লাহ জলদস্যুদের কবলে পড়ার আগে ভারত মহাসাগরের নিরাপদ জোনে ছিল। সোমালিয়া উপকূলীয় এলাকা থেকে প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল। অতএব সেখানে বাড়তি নিরাপত্তার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এর পরও দুভার্গ্যজনকভাবে সোমালিয়ার জলদস্যুরা জাহাজটি কব্জায় নিল। এখন যেহেতু সরকার বাড়তি নিরাপত্তার কথা বলেছে, সেহেতু বাড়তি নিরাপত্তা থাকবে। আবার একটি কোম্পানির মাধ্যমে আমরা ইতোমধ্যেই বাড়তি নিরাপত্তা সেবা নিচ্ছি। এই কোম্পানি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে ঝুঁকির বিষয় থাকলে তা জাহাজের ক্যাপ্টেনকে আগে থেকেই অবহিত করবে।
প্র. বা : এমভি আব্দুল্লাহ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পরিকল্পনা কী?
মেহেরুল করিম : জাহাজটি দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে দুই ধরনের পরিকল্পনা আছে। এখন পর্যন্ত জাহাজের ২৩ নাবিকের মধ্যে দুইজন দুবাইয়ে নামার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। অন্যরা জাহাজে করে বাংলাদেশে ফিরতে চান। তাই ২১ নাবিক জাহাজে করে বাংলাদেশে ফিরতে পারেন। আবার যদি দেখা যায়, জাহাজটি সম্পূর্ণ ফিট অবস্থায় আছে এবং বাংলাদেশে ফিরতি পথে ট্রিপ পাওয়া গেল না, তখন হয়তো সবাইকে দুবাইয়ে নামানোর ব্যবস্থা করা হবে। তারপর অন্য একটি দল জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেবে। এখন পর্যন্ত এ রকমই সিদ্ধান্ত রয়েছে।
প্র. বা : দুটি জাহাজ জলদস্যু কবল থেকে মুক্ত করার পর আত্মমূল্যায়ন কীভাবে করবেন?
মেহেরুল করিম : ক্যাডেট কলেজ ও মেরিন একাডেমিতে লেখাপড়া শেষ করে কর্মসূত্রে শুরু হয় আমার সাগরজীবন। শিপিং লাইন্সে এখন প্রায় ৪৪ বছরের অভিজ্ঞতা আমার। এই সময়ে আমি জলদস্যুদের কীভাবে হ্যান্ডেল করতে হয় সেই বিষয়ে কিছু লেখাপড়া করি। পেপার পড়তাম। বিশ্বের কোথাও জলদস্যুতার খবর হলে সেগুলো খুঁটিনাটি পড়তাম এবং খোঁজখবর নিতাম। অর্থাৎ সাগরের দস্যুদের বিষয়ে জানার আগ্রহ ছিল আমার। কিন্তু যখন জাহান মনি উদ্ধার প্রক্রিয়ায় বাস্তবে যুক্ত হলাম তখন বুঝতে পারলাম বিষয়টি আসলে অনেক কঠিন। অনেক বিষয় এর সঙ্গে যুক্ত। সব কিছু সামাল দেওয়া সত্যিই কঠিন। জাহান মনি উদ্ধারের পর অভিজ্ঞতা অর্জন করলেও কখনও ভাবিনি দ্বিতীয় দফা আমাদের জাহাজ পুনরায় জলদস্যুদের কবলে পড়বে। কিন্তু দুভার্গ্যজনকভাবে পড়েছে। তবে এবার উদ্ধার প্রক্রিয়ায় আগের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়েছি। জাহান মনি উদ্ধারের সময় যে ভুলভ্রান্তিগুলো ছিল সেগুলো এবার করিনি। শিপিং লাইনে নানা ধরনের কাজ থাকে। কিন্তু জলদস্যুদের কবল থেকে জাহাজ মুক্ত করার মতো ঘটনা থাকে বিরল। এই বিরল কাজটি মহান আল্লাহ আমার মাধ্যমে সম্পন্ন করেছেন এজন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করি। কোম্পানির প্রতিও অশেষ কৃতজ্ঞতা। কারণ কোম্পানি যদি আমাকে এই সুযোগ না দিত তাহলে আমি এই কাজটুকু করতে পারতাম না।
প্র. বা : বিদেশি অনেক জাহাজ জিম্মি হওয়ার পর আপনার সঙ্গে অভিজ্ঞতা শেয়ার করে। আপনি তাদের কীভাবে সহযোগিতা করেন?
মেহেরুল করিম : তারা আমার অভিজ্ঞতার তথ্য নিয়েছেন। আমিও তাদের সহযোগিতা করেছি এবং ভবিষ্যতেও করব, ইনশাল্লাহ। একজনের বিপদে অন্যজনকে এগিয়ে আসতে হবে- এটাই তো স্বাভাবিক।
প্র. বা : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মেহেরুল করিম : প্রতিদিনের বাংলাদেশকেও ধন্যবাদ।