ঈদের কেনাকাটা
মো. শামীম মিয়া, নরসিংদী
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:০০ পিএম
আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:৪২ পিএম
নরসিংদীর বাবুরহাটে অন্য বছরের তুলনায় এবার ক্রেতার সংখ্যা কম। প্রবা ফটো
পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে রমজানের আগে থেকেই প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত পাইকারি কাপড়ের বাজার নরসিংদীর (শেখেরচর) বাবুরহাটের ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন কাপড়ের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ক্রেতার সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। তাই বেচাকেনায় অনেকটাই মন্দাভাব দেখা গেছে দেশের কাপড়ের সবচেয়ে বড় পাইকারি এই বাজারে। রমজানের এক মাস আগ থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারি ক্রেতায় মুখর থাকার কথা থাকলেও এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ক্রেতাসমাগম নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তৈরি প্রায় সব ধরনের দেশীয় কাপড় মেলে এই বাজারে। ঈদ উপলক্ষে বাজারের ছোট-বড় প্রায় পাঁচ হাজার দোকানে নিত্যনতুন ডিজাইন করা পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। রমজানের এক সপ্তাহ আগে থেকেই চলে ঈদ বাজারের পাইকারি বেচাকেনা। এই হাট ঘিরে নরসিংদী জেলাসহ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে গড়ে উঠেছে কয়েক লাখ তাঁতকল। সঙ্গে কয়েকশ তাঁতসহায়ক শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
সরেজমিনেও অবশ্য খুব একটা ক্রেতাসমাগম দেখা যায়নি। ক্রেতাসংকটের কারণে অনেকটা অলস সময় পার করতে দেখা গেছে দোকানিদের। নেই কুলিদের সেই হাঁকডাক। শেষ মুহূর্তে এসে দুই-একটি দোকানে জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি কিনতে দেখা গেছে। তবে তা যৎসামান্য বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, অল্প সময়ের মধ্যেই বাবুরহাট দেশব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। একসময় কেবল রবিবারেই হাট বসত। বর্তমানে সপ্তাহে তিন দিন বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার হাট বসে। তবে ঈদ সামনে রেখে পুরো সপ্তাহেই চলছে কেনাবেচা। হাটে শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রিপিস, শার্ট পিস, প্যান্ট পিস, পাঞ্জাবির কাপড়, থানকাপড়, পপলিন কাপড়, ভয়েল কাপড়, সুতি কাপড়, শাটিং কাপড়, বিছানার চাদর, পর্দার কাপড় থেকে শুরু করে গামছাসহ পাওয়া যায় হরেক রকমের কাপড়। আর এসব কাপড় আসে স্থানীয় তাঁত ও তাঁতসহায়ক শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে। একই সঙ্গে দেশের প্রসিদ্ধ টাঙ্গাইলের শাড়ি, জামদানি, কাতানসহ বিভিন্ন প্রকারের কাপড়ের সম্ভারে বাবুরহাটের সংগ্রহকে করেছে সমৃদ্ধ।
একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার অন্য বছরগুলোর তুলনায় ক্রেতার উপস্থিতি তুলনামূলক কম থাকায় বাবুরহাটের নেই সেই বাবুগিরি। ডলারসংকটসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে কাপড় উৎপাদনে খরচ বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় উপকরণসংকটসহ নানা কারণে কাপড়ের বাজারে মন্দাভাব পড়ছে। কাপড় বেচাকেনা হ্রাস পেয়েছে। রমজানের আগেই প্রতিটি দোকানে বাহারি ডিজাইনের কাপড়ের স্টক শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঈদের আগে শেষ হাটে এসেও এখনও অর্ধেক কাপড় বিক্রি করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। ফলে এবারের ঈদ বাজারের ভরা মৌসুমেও ব্যবসায়ীদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
ব্যবসায়ী সুশীল চন্দ্র সাহা বলেন, আমরা সারা বছর ঈদ মৌসুমের অপেক্ষায় থাকি। এই সময় আমাদের কাপড়ের অনেক চাহিদা থাকে। সেজন্য আমরা বিভিন্ন প্রকার থ্রিপিসসহ থান কাপড় স্টক করে রাখি।এবার বাজারে আশানুরূপ পাইকার নেই, নেই বেচাকেনার ধুম। ঈদের আগে বৃহস্পতিবার শেষ হাট জমেছে। এখন পর্যন্ত স্টকে থাকা অর্ধেক কাপড়ও বিক্রি করতে পারিনি। ব্যবসায় লাভ তো দূরে থাক যে মূলধন খাটিয়েছি তা তুলে আনতে পারব কি নাম সে শঙ্কায় রয়েছি।
শফিকুল ইসলাম পারভেজ নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, সারা বছরই লোকসানে ছিলাম। ঈদ উপলক্ষে লাভের আশা করেছিলাম। কিন্তু বাজারে পাইকার না আসায় বেচাকেনা অনেক কমে গেছে। লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারব না বলেই মনে করছি। ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, আমরা কাপড়ের পসরা সাজিয়ে বসে থাকলেও আশানুরূপ পাইকার পাচ্ছি না। ব্যাংকঋণ নিয়ে ব্যবসা করছি। ঈদে বেচাকেনা করতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্ত হব।
এদিকে বেচাকেনায় মন্দাভাব থাকায় অলস সময় পার করছেন দোকানের কর্মচারীরা। তারা জানান, আগে যেখানে সারা দিন ক্রেতায় মুখর থাকতÑ এখন সেখানে ক্রেতাই পাচ্ছি না। নয়ন মিয়া নামে এক দোকান কর্মচারী বলেন, প্রতি ঈদে দোকান পাইকারে মুখর থাকত। আমরা দম ফেলার সময় পাইতাম না। এখন দোকানে খালি বসে থাকি। যাও কয়েকজন পাইকার আসে তারা দাম জেনে চলে যায়।
দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদ। আর ঈদের কাপড় কিনতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ভিড় জমিয়েছে বাবুরহাটে। থরে থরে সাজানো সেই কাপড় থেকে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী কিনছেন বিভিন্ন জেলা থেকে আগত খুচরা বিক্রেতারা। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক।
খাগড়াছড়ি থেকে পাইকারি কাপড় কিনতে এসেছেন আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, প্রতিটি কাপড়েই ৮০ থেকে ১০০ টাকা দাম বেড়ে গেছে। আমরা যেই পরিমাণ লক্ষ্য নিয়ে হাটে এসেছিলাম, সে রকম কাপড় কিনতে পারিনি। তারপরও ঈদে এখানকার কাপড়ের চাহিদা থাকার কারণে ৩ লাখ টাকার কাপড় কিনেছি।
হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে বাবুরহাটে থ্রিপিস ও শাড়ি কিনতে এসেছেন সোহাগ মিয়া। তিনি বলেন, বাবুরহাটে একই জায়গায় হরেক রকমের কাপড় পাওয়া যায়। যার কারণে একাধিক হাটে না গিয়ে আমরা বাবুরহাট থেকেই সবকিছু কিনতে পারছি। এখানকার কাপড়ের গুণগত মান ভালো হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে চাহিদা অনেক। প্রতি ঈদেই বাবুরহাট থেকে কাপড় নিয়ে ব্যবসা করি।
ঢাকার মহাখালী থেকে হাটে এসেছেন ফয়সাল আহমেদ। তিনি বলেন, যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো থাকার কারণে সহজেই হাট থেকে কাপড় নিয়ে যেতে পারি। আর কাপড়ও সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। তবে এবার দাম একটু বেশি। তারপর ও আশা করছি এবারের ঈদের বিক্রির মাধ্যমে লাভবান হওয়া যাবে।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে জাকাতের কাপড় কিনতে আসা হুমায়ূন কবির বলেন, জাকাতের কাপড়ের জন্য হাটে এসেছি। প্রতি বছরই এই হাট থেকে শাড়ি-লুঙ্গি কিনি। এ বছর আমার জাকাতের পরিমাণটা হিসাব করে ওই টাকায় কয়টি শাড়ি ও লুঙ্গি কিনতে পারব একটা ধারণা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু বাজারে এসে আমার সেই ধারণা পাল্টে গেছে।
এবারের ঈদে বৈচিত্র্য এসেছে পুরুষের অন্যতম পোশাক লুঙ্গিতে। নানা নাম ও বাহারি ডিজাইনের এসব লুঙ্গি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। আমানত শাহ লুঙ্গির পরিচালক রেজওয়ান কবির শিহাব বলেন, এবার লুঙ্গির ডিজাইনে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেছি। প্রায় ২ হাজার ডিজাইনের লুঙ্গি ঈদের বাজারে এসেছে। পাইকারি ক্রেতাদের কাছে এসব ডিজাইনের লুঙ্গির আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাইকারদের মাধ্যমে আমাদের লুঙ্গি দোকানে যাচ্ছে। আমাদের ব্যবসা ভালো হচ্ছে আশা করছি। এবারের ঈদে পাইকাররাও ভালো ব্যবসা করতে পারবে।
বাবুরহাট বণিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি আবদুল বারিক বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এ বছর ব্যবসায় কিছুটা মন্দাভাব। প্রতি বছরের তুলনায় এবার হাটের অবস্থা অনেকটাই নাজুক। ঈদ মৌসুমে বাবুরহাটে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার লেনদেনের আশা করা যাচ্ছে। তবে ধারাবাহিকভাবে সুতার দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বেড়েছে কাপড়ের দামও। সুতার দাম স্থিতিশীল থাকলে কাপড়ের দামও কম হতো। যার ফলে ব্যবসায়ীদের বিক্রি আরও বৃদ্ধি পেত।